নারীর জন্য দিবস কেন দরকার

নারীর সমতার দাবিতে মোমবাতি প্রজ্বালন করে ‘আমরাই পারি’ পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গতকাল রাত ১২টা ১ মিনিটে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।  ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
নারীর সমতার দাবিতে মোমবাতি প্রজ্বালন করে ‘আমরাই পারি’ পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গতকাল রাত ১২টা ১ মিনিটে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

কয়েক বছর ধরেই দেখছি, আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন নিয়ে আয়োজন যত বাড়ছে, যত বাড়ছে এর করপোরেট উদ্‌যাপনের তোড়, ততই এই দিবস কেন পালন করতে হবে, নারী দিবস থাকলে পুরুষ দিবস বা মানুষ দিবস নয় কেন—এসব তর্ক বাড়ছে। এর ওপর এ বছর—সারা বিশ্বের প্রতি ১০ জনে ৯ জন নারীবিরোধী—জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) পরিচালিত এমন এক আন্তর্জাতিক জরিপের ফলাফলে দেখলাম, আমার বন্ধুদের অনেকে খুব অপমানিত বোধ করে পাল্টা প্রশ্ন করছেন, নারীদের মধ্যে জরিপ করে দেখা হোক কতজন পুরুষবিদ্বেষী। আসলে বিষয়টা একদম আওয়ামী লীগ–বিএনপির মতো নয়। মানে, আপনি নারীর বিপক্ষে মানেই আপনি পুরুষ নন, আপনি পুরুষের পক্ষে মানেই আপনি নারীর বিপক্ষে নন। আপনি নারীও হতে পারেন, পুরুষও হতে পারেন। মাপকাঠি একটাই, আপনি মনে করেন কি না সমাজের সব সুযোগ আর সম্ভাবনার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার আছে। সেই হিসাবেই ইউএনডিপি দেখছে, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সহিংসতা অথবা প্রজনন অধিকার—এমন কোনো না কোনো বিষয়ে ৯১ শতাংশ পুরুষ আর ৮৬ শতাংশ নারী নারীর সামগ্রিক কল্যাণের বিরোধী অন্তত একটি বিশ্বাস ধারণ করেন।

আপনি যদি এমন পুরুষ বা নারী হন, যাঁর ভেতরে নারীবিরোধী তেমন কোনো বিশ্বাস বা ধারণা নেই, তাহলে কিন্তু আপনার একেবারেই এই জরিপের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার দরকার নেই। ঠিক যেমন আপনি যখন খবরে দেখেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর এক লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে দাবি তোলেন না, কত টাকা পাচার হচ্ছে না,তারও একটা হিসাব এবার করা হোক, ঠিক তেমনি। নাকি ‘এ এমন কোনো টাকা নয়’ বা ‘অন্য দেশে আরও বেশি হয়’, ‘এসব জরিপ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’—এসব বলে ওই সংখ্যাকে আপনি ‘রাবিশ’ প্রমাণ করে দিতে চাইছেন। কারণ, আপনারও বস হিসেবে, প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে, রাষ্ট্রের পরিচালক হিসেবে নারীকে ঠিক জুতসই লাগে না? আপনারও মনে হয় পরিবার, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র মিলে যে নিয়মে এত যুগ ধরে নারীকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে এসেছে, তা ঠিক আছে।

১৮–এর আগে, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সংজ্ঞায় শিশু বয়সে বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, সেটা আপনাকে বিচলিত করে না। কারণ, আপনি মনে করেন, মেয়েরা বিশেষ করে গ্রামের গরিব মেয়েরা এত পড়ে কী করবে? আপনি কি সেই নারী বা পুরুষ, যিনি মনে করেন নারীর জন্য নিরাপদ পথ, গণপরিবহন, কর্মক্ষেত্র এগুলো সৃষ্টি অসম্ভব? নারীর গায়ে ‘হাত তোলা’ ‘হাত লাগা’ ‘হাত পড়া’—এসবই নারীর ভবিতব্য। কাজেই সইতে না পারলে বরং ঘরে বসে বাচ্চা পালনই নারীর জন্য ভালো? তারপর আপনি যখন শোনেন, এ দেশে ঘরেই সবচেয়ে বেশি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয় নিকটাত্মীয় এবং পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের দ্বারা। আপনার আবার মনে হয়, মেয়েশিশুর ‘পোশাক’, ‘চলনবলন’ বা ‘পারিবারিক শিক্ষায়’ কোনো অসুবিধা ছিল? বা আপনি কি মনে করেন, এমন হয়, হয়ে যেতেই পারে? বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামীর হাতে মার খান, তাঁদের অনেকের অঙ্গহানি ঘটে, প্রাণও যায়—এমন পরিসংখ্যান শুনলেই কি আপনার পুরুষ নির্যাতনের পরিসংখ্যান নেই কেন, সেই প্রশ্ন তুলতে ইচ্ছা করে? আপনার মেধাবী সহকর্মী বা সাবেক সহপাঠী কিংবা আপনার বোন বা স্ত্রী যখন মা হয়ে সন্তান লালনপালনে কর্মক্ষেত্র বা রাষ্ট্র থেকে কোনো সহযোগিতা না পেয়ে চাকরি ছেড়ে গৃহবন্দী হন, আপনি তখন কি ভাবেন, এটাই স্বাভাবিক? এই নিয়ে তাঁর মনোবেদনা আপনার বিলাসিতা মনে হয়?

এমন আরও হাজারো প্রশ্নের উদাহরণ দিতে পারি। এসবের যেকোনো একটির বা একাধিকের পক্ষে আছেন বলেই কি আপনার নারী প্রসঙ্গ, সমতার প্রশ্ন এলেই পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যায় সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র, রাজনীতির নানা বাস্তবতা তুলে ধরতে ইচ্ছা করে? আপনার যুক্তি কি এমন যে আগে তো নারীরা সেনাবাহিনী–পুলিশে ঢুকতেই পারতেন না, এখন তো শুনি যুদ্ধবিমান চালাচ্ছেন! মানে, যুক্তিটা কি ওই মানের যে যানজট, নিরাপদ সড়ক, বায়ুদূষণ—এসব নিয়ে কথা বলার কী আছে, আগে তো কারও পায়ে স্যান্ডেল আর নারীদের গায়ে ব্লাউজই ছিল না।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং স্পিকার—সব নারী এমনকি জেলে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী, তিনিও নারী;কিন্তু ৩০০ জন নির্বাচিত সাংসদের মধ্যে বাংলাদেশে মাত্র ২২ জন নারী, অর্থাৎ ৭ শতাংশের মাত্র কিছু বেশি নারী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বাবার আসন, বাবার এলাকা রাজনীতিতে প্রবেশের সবচেয়ে মোক্ষম চাবি। এ দেশে নারীদের উত্তরাধিকারসূত্রে মালিকানা থাকা জমির পরিমাণ ৪ শতাংশের বেশি নয়। আপনি অবাক? আমিও অবাক। জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, ৯০ শতাংশের বেশি মুসলমান, ধর্ম অনুযায়ী পুত্রের অর্ধেক সম্পদ কন্যার পাওয়ার কথা, তাহলে জমির মালিকানায় এমন বৈষম্য এই দেশে কেন? যা–ই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি। তার মানে, নারীর জমি নেই, বাড়ি নেই, এলাকা নেই—কাজেই ব্যবসার ঋণের জন্য, দলের পদের জন্য, নির্বাচনের আসনের জন্য তাঁর বিবেচিত হওয়ার সুযোগও নেই।

তবু নারী-পুরুষ আমরা অনেকেই ভাবছি, সমতা অর্জিত হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর থেকে ৫০ বছরে দেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ৪ শতাংশ থেকে ৩৭ শতাংশের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। এর মধ্যে রাজপথের পুলিশ, অফিসের বড় কর্তা, জেলার প্রশাসক, টেলিভিশনের কড়া সাংবাদিকসহ নানা চটকদারি পদে নারীর দাপুটে ভূমিকা দেখে ভাবাই স্বাভাবিক, সমতা এসে গেছে; কিন্তু এখনো ৪০ শতাংশ কর্মজীবী নারীর ৯০ শতাংশের বেশি কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে, অর্থাৎ তাঁদের কাজের কোনো হিসাব নেই। যেমন প্রায় ৮০ শতাংশ নারী কাজ করেন কৃষি খাতে। বাংলাদেশের কৃষি, গবাদিপশু, হাঁস–মুরগি পালন প্রক্রিয়ার সিংহভাগ কাজ করেন নারীরা, অথচ নারী শ্রমিক মজুরি পান পুরুষের অর্ধেক। আর স্বামী বা বাবার জমিতে কাজ করেন মজুরিবিহীন; কিন্তু নারী সরকারের কৃষক তালিকায় উঠতে পারেন না। কারণ, তালিকায় ওঠেন কেবল পরিবারপ্রধান। নারী বীজ, সার, কীটনাশক বরাদ্দের কার্ডও পান না। কারণ, তা পেতে জমির মালিকানা থাকতে হয়।

সমতা অর্জিত হয়ে গেছে, নারীর আবার আলাদা সুবিধা, আলাদা দিবস দরকার কী—এ রকম ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর একদল ছাত্রীও নারী কোটা বাতিল চাইলেন এবং সব কোটাই বাতিল হলো। অথচ গত চারটি বিসিএসে দেখা গেছে, কোটাসুবিধা বহাল থাকার পরও নারীদের চাকরি পাওয়ার হার ৩৮ শতাংশ থেকে কমে ২৬ শতাংশে এসেছে। যে নারীরা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বসে বিশ্ব জয় করবেন ভাবছেন, বিসিএস পরীক্ষা যত দিনে হবে, তত দিনে তাঁদের বিয়ে হবে, সন্তান হবে, পরীক্ষা দিতে স্বামীর অনুমোদন লাগবে, স্বামী–সন্তানের দেখভালের ব্যবস্থা করে তবে তাঁকে পরীক্ষায় বসতে হবে। চাকরি হলে শ্বশুরবাড়ির অনুমতি নিয়ে যেতে হবে, অনেক ক্ষেত্রেই আর তা করা হয়ে উঠবে না। ডানা কাটা পড়বে।

এই ডানা কাটার ব্যবস্থা যত দিন থাকবে, তত দিন নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতা থাকবে। ডানা কাটার পক্ষে যুক্তিধারী মানুষের সংখ্যা যত দিন ১০ জনে ৯ জন থাকবেন, তত দিন নারী দিবসের বদলে মানুষ দিবস করার সুযোগ ঘটবে না। আর আপনি যদি হন ৯ জনের বাইরে থাকা ১ জন নারী বা পুরুষের প্রতিনিধিত্ব করা মানুষ, তবে আপনার কাজ, আজ থেকে চারপাশের অসাম্যের বিরুদ্ধে আপনার সাধ্য অনুযায়ী কিছু করা। আপনি জীবনসঙ্গী হলে সংসার আর সন্তান লালনপালনে কাজ ভাগ করে নিন, ভাই বা বোন হলে সম্পদে ন্যায্য অধিকারের ব্যবস্থা করুন, বাবা বা মা হলে সন্তানকে বলুন, কখনো কোনো পরিস্থিতিতে তার ডানা আপনি ছেঁটে দেবেন না। আমাদের মাত্র ১০ শতাংশের পৃথিবীর সমতার মুক্ত আকাশে পাখা মেলে উড়ুক আমাদের সন্তানেরা—নারী বা পুরুষ হয়ে নয়, মানুষ হয়ে। আমাদের আকাশে বাড়তে থাকুক পাখিদের ভিড়।

নবনীতা চৌধুরী: ব্র্যাকের পরিচালক