মন্ত্রী বড়, না সাবেক সাংসদ?

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সাবেক সাংসদ এ কে এম এ আউয়াল। ফাইল ছবি
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সাবেক সাংসদ এ কে এম এ আউয়াল। ফাইল ছবি

আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সাংসদ কিংবা নেতা-কর্মীদের চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। বিরোধী দল ভঙ্গুর, এলোমেলো। আইনি-বেআইনি খড়্গের নিচে পড়ে গণমাধ্যম আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দুর্বল। নাগরিক সমাজ দিগ্ভ্রান্ত, মাঝেমধ্যে তারা এক–আধটু বক্তৃতা–বিবৃতি দেয় বটে; তা অতি ক্ষমতাধর আওয়ামী লীগকে সামান্য স্পর্শ করতে পারে না। 

এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ একমাত্র আওয়ামী লীগ। সরকারের প্রতিপক্ষও আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার পরও এ রকম একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সবকিছু ছিল আওয়ামী লীগময়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সরকার যে দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, ঘুষবাজির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছিল, তাতে এখন পর্যন্ত  বিরোধী দলের কোনো নেতা-কর্মীর কারও নাম আসেনি। দুর্নীতির দায়ে, টেন্ডারবাজির দায়ে যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং যাঁদের বাড়িঘরে তল্লাশি চালানো হয়েছে, তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের কিংবা এর সহযোগী যুবলীগ, কৃষক লীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।

ওবায়দুল কাদের সাহেবরা কথায় কথায় বলেন যে আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। অপরাধী যে দলেরই হোক না কেন, শাস্তি পাবে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন কথা বলে। অতীতের মতো পিরোজপুরের ঘটনায়ও আইন নিজস্ব গতিতে চলেনি। এ ক্ষেত্রে কী কী আইনি ব্যত্যয় ঘটেছে, সে সম্পর্কে গত বৃহস্পতিবার সহকর্মী মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোয় লিখেছেন।

আমরা পিরোজপুরের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করলে দেখতে পাব, এ কে এম এ আউয়াল সাংসদ থাকাকালে সেখানে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। ২০১৭ সালের ১১ জুন প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: ‘তিনি টাকা ছাড়া কিছু বোঝেন না’। সাংসদের আপন ভাই পৌরসভার মেয়র হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি (আউয়াল) টাকা ছাড়া কিচ্ছু বোঝেন না।’ তাঁর অভিযোগ, ‘আমি জিয়ানগর (বর্তমানে ইন্দুরকানি) ও মঠবাড়িয়া উপজেলায় চারটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছি। সাড়ে ১৩ কোটি টাকার কাজটির জন্য তিনি আমার কাছ থেকে ৮০ লাখ টাকা ও ২ হাজার ডলার নিয়েছেন।’

 সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলের গুরুতর অভিযোগও আছে আউয়ালের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এ বিষয়ে সরকারের কাছে নালিশ করলে তিনি তাঁর সমর্থক এলাকার একদল হিন্দু নেতাকে ঢাকায় নিয়ে এসে সংবাদ সম্মেলন করিয়েছিলেন, যাঁরা সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারেননি। 

শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু বিচারক সাবেক সাংসদ আবদুল আউয়াল ও তাঁর স্ত্রীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়ার পর তাঁদের অনুসারীরা পিরোজপুর–হুলারহাট সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে সড়ক অবরোধ করেন। শহরের সার্কিট হাউস এলাকায় সড়কে আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবাদ জানান। পিরোজপুর-পাড়েরহাট সড়কের কয়েকটি স্থানে গাছের গুঁড়ি ফেলে ও আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন সড়কে তাঁরা মুজিব বর্ষ উপলক্ষে বসানো বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যত ফেস্টুন ও বিলবোর্ড ছিল, তা–ও ভাঙচুর করেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিজেই সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘পরিস্থিতি’ নিয়ন্ত্রণে আনতে সাবেক সাংসদ ও তাঁর স্ত্রীকে জামিন দেওয়া হয়েছে। আদালতের জামিন হয় মামলার গুণাগুণের ভিত্তিতে; বাইরের পরিস্থিতি বিবেচনা করে নয়। মন্ত্রীর দাবি, আদালতকক্ষে বিচারক অসৌজন্যমূলক ও রূঢ় আচরণ করেছেন। এ কারণে সব আইনজীবী আদালত বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু আদালতকক্ষে উপস্থিত ছিলেন এ রকম একাধিক আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, সেদিন আদালতকক্ষে কোনো ‘পরিস্থিতি’র সৃষ্টি হয়নি।

 এ কে এম এ আউয়ালের আইনজীবীরা মামলাটি সবার আগে শুনানির দাবি জানিয়েছিলেন। বিচারক বলেছেন, যেসব মামলার সাক্ষী উপস্থিত আছেন, সেগুলো আগে হওয়া উচিত। তিনটি মামলার পর এ কে এম এ আউয়ালের মামলার শুনানি শুরু হয়। আউয়াল ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের তিনটি মামলা ছিল। বিচারক এর মধ্যে দুটিতে জামিন দেন এবং একটিতে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে আদালতকক্ষ ত্যাগ করেন। ফলে আইনমন্ত্রীর উল্লিখিত পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগই ছিল না। পরে আউয়ালের আইনজীবীরা আসামিকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার আবেদন জানালে বিচারক সম্মতি দেন। এই আদেশ হয় ১২টার দিকে। পরবর্তী বিচারক এসে আউয়াল দম্পতিকে জামিন দেন বিকেল চারটায়। এই দীর্ঘ সময় অভিযুক্তদ্বয় আদালতেই অবস্থান করছিলেন। তাহলে কি তাঁরা আগেই জানতেন যে পূর্ববর্তী বিচারকের আদেশ বাতিল হবে এবং জামিন পাবেন।

বিচারক আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে আইনজীবীদের আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত কীভাবে হয়েছে, কীভাবে তাঁর বদলির আদেশ হয়েছে, কীভাবে চার ঘণ্টার ব্যবধানে বিচারকের রায় উল্টে দিয়ে অভিযুক্তকে জামিন দেওয়া হয়েছে, সেসব এখন সর্বমহলে সরস আলোচনার বিষয়। আবারও প্রমাণিত হলো, নিম্ন আদালত স্বাধীন নয়। নির্বাহী বিভাগ যা চায়, সেটাই তারা করতে বাধ্য হয়।

খালেদা জিয়ার জামিনের দাবিতে বিএনপি কোনো কর্মসূচি নিলে আওয়ামী লীগের নেতারা সমস্বরে বলে ওঠেন, এটি আদালত অবমাননার শামিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ আবদুল আউয়ালের জামিন বাতিল হওয়ার পর পিরোজপুরে যে অরাজক অবস্থা তৈরি হলো, সে সম্পর্কে তাঁদের মুখে রা নেই। কিছু বলেন না। আইনমন্ত্রী যে পরিস্থিতির কথা বলেছেন, তাতে মানুষ ধরে নেবে বাংলাদেশের আদালত যে আদেশই দিন না কেন, চার ঘণ্টার মধ্যে তা বদলানো সম্ভব। তবে সে জন্য ‘পরিস্থিতি’ সৃষ্টি করতে হবে। এই বাস্তবতায় জনমনে এই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, বিএনপি কোনো ‘পরিস্থিতি’ তৈরি করতে পারলে কি খালেদা জিয়ারও জামিন মিলবে? সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হোক, সেটাই কি চান ক্ষমতাসীনেরা? 

জামিন পাওয়ার পর সাবেক সাংসদ আবদুল আউয়াল সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘পিরোজপুর-১ (সদর, নাজিরপুর, নেছারাবাদ) আসনের সাংসদ ও মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম দুদককে প্রভাবিত করে তিনি ও তাঁর স্ত্রী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী লায়লা পারভীনের বিরুদ্ধে তিনটি মিথ্যা মামলা করিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি স্বাধীন সংস্থা দুদককেই প্রশ্নবিদ্ধ করেননি, সরকারের দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের প্রতিও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। 

 সাবেক সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এর মধ্যে একটি মামলায় তাঁর স্ত্রী ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লায়লা পারভীনকেও আসামি করা হয়েছে। দুদক বরিশাল সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সাবেক সাংসদ এ কে এম এ আউয়াল ও তাঁর স্ত্রী লায়লা পারভীন পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা সদরের ছোট বৈচাকাঠি মৌজার ০.০৩ একর খাসজমি ভুয়া ব্যক্তিদের নামে বন্দোবস্ত দেখিয়ে ওই জমিতে দ্বিতল ভবন নির্মাণ করে অবৈধভাবে দখলে রেখে দণ্ডবিধির ৪২০.৪০৯/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

অপরদিকে এ কে এম এ আউয়াল ক্ষমতার অপব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে পিরোজপুর সদর উপজেলার খোমারিয়া মৌজার অর্পিত সম্পত্তিসহ অন্যদের জমি অবৈধভাবে দখল এবং রাজাপুকুর নামে পরিচিত সরকারি পুকুর ভরাট করে মোট ০.৪৪ একর সম্পত্তি নিজ দখলে রেখে দণ্ডবিধির ৪২০/৪০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করায় কমিশনের অনুমোদনক্রমে এ কে এম এ আউয়ালের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করা হয়েছে। দুদক বরিশাল সমন্বিত কার্যালয়ে মামলাটি করেছেন উপপরিচালক মো. আলী আকবর।প্রাথমিক অনুসন্ধানে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কমিশনের অনুমোদনক্রমে উপপরিচালক মো. আলী আকবর বাদী হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

জামিন নিয়ে সাবেক সাংসদের অনুসারীরা এমন অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন, যাতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম পিরোজপুর সফর বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, মন্ত্রী বড়, না দুদকের মামলার আসামি সাবেক সাংসদ আউয়াল?

এ কে এম এ আউয়াল সাংসদ হিসেবে পিরোজপুরে একটানা ১০ বছর রাজত্ব করেছেন। তখন তাঁর প্রভাব–প্রতিপত্তি নিজের নির্বাচনী এলাকায়ই সীমিত ছিল। এখন সাংসদ না হয়েও সেই প্রতিপত্তি আইন মন্ত্রণালয় ও আদালত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।

এই ধারা কোথায় গিয়ে ঠেকবে? 

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]