প্রতিটি অফিসে থাকবে জেন্ডার কোড

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ একটা রেকর্ড করেছে। একটানা ২৯ বছর দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী। কথাটা সেদিন আমাদের গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় মনে করিয়ে দিলেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রথম আলো ও সেভেন রিংস সিমেন্টের উদ্যোগে আমরা আলোচনা বৈঠকের আয়োজন করেছিলাম। বিশেষভাবে নারী স্থপতি ও প্রকৌশলীর আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা—এ বিষয়টি আমাদের আলোচনায় প্রাধান্য পায়।

বুয়েটের ইমেরিটাস অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া স্মরণ করিয়ে দেন যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অভীষ্ট-৫-এ জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে। আমাদের সেই অভীষ্ট অর্জন করতে হলে দরকার বিশেষ পদক্ষেপ। দেশে মহাসড়ক, সেতু, উঁচু ভবন নির্মাণকাজ বাড়ছে। তাই আগামী দিনে আরও স্থপতি ও প্রকৌশলী দরকার। তাঁদের জন্য ভালো কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করলে দেশ উপকৃত হবে।

নারীর অবস্থান এখন অনেকটা ভালো। পড়াশোনায়, দেশ শাসনের উঁচু পদে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি, ব্যবসা, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্প ও কৃষিতে আজকাল নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেশি। কিন্তু তারপরও সমস্যা আছে। ঘরে-বাইরে নির্যাতন, বঞ্চনা, অধিকারবৈষম্য, তুচ্ছতাচ্ছিল্য তো আছেই, তার ওপর চাকরি করার জন্য ঘরে গঞ্জনা সইতে হয়। অফিসে বসের ধমকানি তো আছেই। এই সব সয়ে নিয়েই একজন নারীকে চাকরি করতে হয়।

‘বাড়ির বউ এত রাতে অফিস থেকে ফেরে? চাকরি করে টাকা রোজগারের দরকার কী?’ এমন কথাও শ্বশুরবাড়িতে শুনতে হয়। আলোচনার সময় বলছিলেন একজন প্রকৌশলী। এই হলো চাকরিজীবী নারীর অবস্থা। তাঁকে বাচ্চা সামলাতে হয়। বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে অফিসে যেতে হয়। আবার দুশ্চিন্তায় মরতে হয়। কারণ, দুপুরে স্কুল ছুটির পর সন্তান বাসায় ফিরবে কীভাবে? এখানে পাশে দরকার স্বামীকেও। অনেক ক্ষেত্রে সেই সৌভাগ্য জোটে না।

আমাদের স্কুলগুলোতে ছুটির পর প্রয়োজনে বাচ্চাদের বিকেল পর্যন্ত স্কুলেই রেখে দুপুরের খাওয়া, বিশ্রাম, খেলার ব্যবস্থা করা হলে চাকরিজীবী মা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। ভালো পরিবেশ ও ভালো যত্নের ব্যবস্থা থাকলে নারীর চাকরি করা সহজ হয়। বিদেশে তো এ ব্যবস্থা সবখানে।

সংসার না ক্যারিয়ার? এ প্রশ্ন চাকরিজীবী নারীদের অনেকের জীবনে প্রধান হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে খুরশীদ আলমেহের নিজের প্রতিষ্ঠানে একটি আধুনিক সমাধানের ব্যবস্থা করেছেন বলে জানান। তাঁদের অফিসে ‘ফ্লেক্সি টাইম’ ব্যবস্থা রয়েছে। অফিসে বা বাসায় অনলাইনে কর্মীরা কাজ করেন। সপ্তাহের সাত দিনই কাজের দিন আবার সাত দিনই এক অর্থে ছুটির দিন! চাকরির বাঁধাধরা সময় নেই। নির্দিষ্ট সময়ে যাঁর যাঁর দায়িত্বের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। সপ্তাহে অন্তত এক দিন একবার কর্মীরা একসঙ্গে বসেন। কাজের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করেন। এ ধরনের অফিস ব্যবস্থায় নারী কর্মীদের কাজের গুণ-মান ও পরিমাণ বেড়ে যায় বলে অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে। ব্রিটেন-আমেরিকায় আজকাল অনেক অফিস এ নিয়মেই চলে। আমরাও অন্তত নারী কর্মীদের জন্য অফিসে ‘ফ্লেক্সি টাইম’ ব্যবস্থা চালু করতে পারি।

অফিসের কাজে নারী কর্মীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু বেশির ভাগ অফিসেই লিখিত জেন্ডার কোড বা নারীর প্রতি আচরণ বিধিমালা নেই। থাকলেও হয়তো আছে কাগজে-কলমে। প্রয়োগ নেই। গার্মেন্টস শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভবনে আগুনপ্রতিরোধী ব্যবস্থা আছে কি না, আগুন লাগলে কোন সিঁড়ি দিয়ে কর্মীরা বের হবেন, সেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেই প্রতিষ্ঠানের পোশাক ক্রেতারা কিনবেন কি না, তার সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। এটা ‘কমপ্লায়েন্স’ সনদ। অনুরূপভাবে আমাদের অফিসগুলো নারীর কাজের জন্য অনুকূল কি না, সে রকম ‘কমপ্লায়েন্স’ সনদের ব্যবস্থা করলে নারী আরও বেশি সংখ্যায় অফিসের কাজে যোগ দিতে পারবেন।

সমাজে নারী-পুরুষ যদি সমান হারে কাজ না করেন, তাহলে আর্থসামাজিক উন্নয়ন কঠিন। এবারের নারী দিবসের মূল স্লোগান হলো, সমতার জন্য সবাই। নারীর অধিকার বাস্তবায়নের জন্য সমতাভিত্তিক প্রজন্ম গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছে। সেভেন রিংস সিমেন্টের পরিচালক তাহ্‌মিনা আহমেদ সমতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, নারী-পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ করা উচিত নয়।

জেন্ডার সমতাভিত্তিক একটি সমাজে যেতে হলে দরকার সামাজিক সচেতনতা। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলেই আমরা বলতে পারব, দেখো, আমরা নারীর সমানাধিকার ও ক্ষমতায়ন শুধু কথায় নয়, কাজেও প্রতিষ্ঠা করেছি।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]