জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কি আবাসিক চরিত্র হারাচ্ছে

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) নানাবিধ পরিচয় আছে। গ্রিক অ্যাম্ফিথিয়েটারের আদলে নির্মিত মুক্তমঞ্চ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, অনিয়ম-অন্যায়বিরোধী প্রতিবাদ, প্রতিরোধের উর্বর ভূমি এই বিশ্ববিদ্যালয়। জাহাঙ্গীরনগরই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে শিক্ষার্থীরা সাহসের সঙ্গে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন–প্রতিরোধ শুরু করেছিলেন। জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরা দেখিয়েছেন কীভাবে রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে প্রতিবাদ জারি রাখতে হয়। এসব দিক থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একটি স্বতন্ত্র পরিচয় আছে—দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিক হলগুলোয় একটি করে সিট বরাদ্দ নিশ্চিত থাকবে। কিন্তু প্রায় দুই দশক ধরে একটু একটু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি এই পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসছে। একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় সবার অলক্ষ্যে অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হচ্ছে। বিষয়টি খুব বেশি আলোচনায়ও আসছে না। হয়তো আমরা খেয়াল করছি না বা সারা দেশের মতোই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যায়-অনিয়ম এতটাই সহনীয় যে আবাসিক চরিত্র হারানোকে বড় করে দেখছে না।

গতকাল ১০ মার্চ থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ব্যাচের ক্লাস শুরু হয়েছে। নিয়ম অনুসারে ক্লাস শুরু হওয়ার দু–তিন দিন আগে থেকেই শিক্ষার্থীদের হলগুলোয় সিট বরাদ্দ দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু এবার কয়েকটি হল বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে হলে কোনো আসন বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব না। কমপক্ষে তিনটি হলে এ রকম বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এমনকি গণরুমেও থাকতে দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ দায়িত্বে থাকতে হবে। এই অবস্থায় দূরদূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে ক্যাম্পাসের আশপাশে বাসা ভাড়া নিতে বাধ্য হবেন। একজন শিক্ষার্থী যদি বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের পুরোটা হলেই থাকতে না পারেন, তবে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধা তিনি কীভাবে পাবেন।

আমি নিজে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬তম ব্যাচে পড়েছি। আমাদের সময় মোট হল ছিল নয়টি। শিক্ষার্থী ছিল ৪ হাজার ৫০০–এর মতো। আর এখন হলের সংখ্যা ১৬। শিক্ষার্থীর সংখ্যা সম্ভবত ১২ হাজারের বেশি। আমাদের সময় আবাসিক সমস্যা এতটা প্রকট ছিল না। কিন্তু এখন শিক্ষার্থীকে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই তীর্থের কাক হয়ে বসে থাকতে হয় কখন হলে একটা সিট পাওয়া যাবে। কেউ কেউ নাকি বড় একটা সময় গণরুমেই পার করে দেন।

এখন নতুন নতুন হল হয়েছে। কিন্তু হলে সিট–সংকটের সমাধান হচ্ছে না কেন? একসঙ্গে অনেকগুলো ব্যাচ থাকার কারণে জট তৈরি হয়েছে বলে অনেকেই জানিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গিয়েছে, ৩৯ ব্যাচ থেকে আবাসিক সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে। তবে এই সমস্যার শুরু ২৮ বা ২৯ ব্যাচ থেকে ২০০০ বা ২০০১ সালের দিকে। ওই সময় শিক্ষার্থীদের হলে সিট দিতে না পারা কারণে বিআরটিসি বাস ভাড়া করে ঢাকা থেকে শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়া করানো হতো।

এরপর থেকেই জাহাঙ্গীরনগরের আবাসিক চরিত্র একটু একটু করে হারাতে শুরু করে। আমাদের সময় মীর মশাররফ হোসেন হলে কয়েকজনকে ক্যানটিন ও হলের লাইব্রেরিতে থাকতে বলা হয়েছিল। এ ছাড়া অন্যান্য হলের সব শিক্ষার্থী যথানিয়মেই সিট বরাদ্দ পেয়েছিলেন। এমনকি অন্যান্য হলে কিছু কিছু সিট ফাঁকাও থাকত। মীর মশাররফ হোসেন হলে সিট না পেয়ে অনেকেই অন্য হলে গিয়ে থেকেছেন। পরে আবার ফিরেও গিয়েছেন। এখন শুধু কাগজে–কলমেই আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়।

সেশনজট কমানো কথা বলে হলে সিট খালি হওয়ার আগেই ক্লাস শুরু কোনো সুফল মেলেনি। আন্দোলন–সংগ্রামের কারণে সেশনজট কমছে না বলে সব সময়ই সরকারপন্থী শিক্ষকেরা বলেন। এর পাশাপাশি শিক্ষকদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজট তৈরি হয়। অনেক শিক্ষক পরীক্ষার খাতা দেখতে অযথাই বিলম্ব করেন। এসব শিক্ষককে আবার কিছু বলাও যায় না। শিক্ষকদের অনেকেই দুপুরে বাসায় গিয়ে ভাতঘুম দেন।

দুপুরের পর খুব বেশি ক্লাস হয় না। আন্দোলন–ধর্মঘটের কারণে যে জটের তৈরি হয়, তা দুইবেলা ক্লাস করে নিয়মিত পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশ করে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। শিক্ষকেরা আরও দায়িত্বশীল হলে আজকের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। সেশন জট কমানোর জন্য দুইবেলা ক্লাস–পরীক্ষা নেওয়ার আগ্রহ না থাকলেও সন্ধ্যাকালীন কোর্স ও সপ্তাহান্তের কোর্স নিয়ে তাদের আগ্রহের কমতি নেই। আরও মজার বিষয় হচ্ছে, আন্দোলন–প্রতিবাদ চলাকালে শিক্ষকেরা সান্ধ্য ও সপ্তাহান্তের কোর্স নিয়মিত সময়েই শেষ করে দেন।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, কিছু না বুঝেই নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়। বিভাগগুলোর প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নেওয়া হয় কম। যত নতুন বিভাগ, তত বেশি নিজেদের লোকদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যায়। এসব বিভাগ খোলার কারণে ধারণ ক্ষমতার বেশি শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে বাধ্য হন। জাহাঙ্গীরনগরও এই সমস্যা থেকে মুক্ত না। পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ না থাকার পরও নতুন নতুন বিভাগ শুরু করা হয়েছে। এতে শিক্ষকরাজনীতির সুবিধা হয়। ভোট বাড়ে। কিন্তু সমস্যায় পড়েন শিক্ষার্থীরা। গণরুমে থাকতে হয় আর ক্লাস করার জন্য এদিক–সেদিক ছুটে বেড়াতে হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতীকমাত্র। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই একই অবস্থা বিরাজ করছে। অনেক শিক্ষকই ক্লাস ও পরীক্ষার বিষয়ে মনোযোগী নন। শিক্ষকতা ও গবেষণা থেকে প্রভোস্ট, প্রক্টর, হাউস টিউটর হওয়ার দিকে বেশি নজর থাকে তাঁদের। অনেকে সপ্তাহে এক দিন বিভাগে আসেন। বেশির ভাগই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। এমনও অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো কোনো সমস্যা না; বরং এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। একজন ভালো শিক্ষক যখন একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় পাঠদান করেন, তখন শিক্ষার্থীরাই উপকৃত হন। সমস্যা হয় তখনই, যদি শিক্ষকেরা নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা সম্পন্ন না করে বিভিন্ন জায়গায় ব্যস্ত থাকেন। এতে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমেই সমস্যার খাদে গড়িয়ে যেতে শুরু করে। জাহাঙ্গীরনগরও এই গড়ানি দিতে দিতে আবাসিক থেকে অনাবাসিক হয়ে যাচ্ছে। একে এখন আর আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বলার কোনো জো নেই।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক