পিটিআইয়ের প্রশিক্ষকদের কাণ্ড

শিক্ষকেরা হবেন আদর্শ, তাঁদের আচরণ হবে অন্যদের কাছে অনুকরণীয়। শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরাই শুধু পাঠ নেয় না, সমাজও অনেক কিছু শেখে। কিন্তু আমাদের সামাজিক অবক্ষয় এমন স্তরে এসে পৌঁছেছে যে পিটিআইতে প্রশিক্ষণ নিতে এসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নারী শিক্ষকেরা প্রশিক্ষকদের কাছে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ঘটনাটি এতই ভয়াবহ যে, বিবেকের তাড়না থেকে একজন প্রশিক্ষক প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর তিনি এখন সুস্থ। তাঁর দাবি, ‘চোখের সামনে প্রশিক্ষণার্থীদের ওপর চার সহকর্মী যৌন হয়রানি করে যাচ্ছিলেন। আমি কিছু করতে পারছিলাম না।’

গত শুক্রবার রাতে প্রশিক্ষক দেবব্রত বড়ুয়ার আত্মহত্যাচেষ্টার ঘটনার পর পিটিআইতে নারী নির্যাতনের ঘটনাটি ফাঁস হয়। এরপর আক্রান্ত প্রশিক্ষণার্থীরাও সরব হন। তাঁরা ক্লাস বর্জন করে ইনস্টিটিউট মাঠে সমাবেশ করে অভিযুক্ত চার প্রশিক্ষক ফারুক হোসেন, সবুজ কান্তি আচার্য ও জসীম উদ্দিন ও রবিউল ইসলামের বিচার দাবি করেন। পিটিআইয়ের অভিযুক্ত চার প্রশিক্ষক অবশ্য নিজেদের নির্দোষ দাবি করে বলেছেন। অভিযোগ তো কেবল একজন প্রশিক্ষক করেননি, ইনস্টিটিউটের ৫০ জন নারী প্রশিক্ষণার্থী করেছেন। কোনো প্রশিক্ষণার্থী অপমানিত ও লাঞ্ছিত না হলে তাঁর প্রশিক্ষকের নামে গুরুতর অভিযোগ আনতে পারেন না।

পিটিআইয়ের যৌন নিগ্রহের ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসন ও শিক্ষা বিভাগের উদ্যোগে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গঠিত কমিটি কাজ শুরু করেছে মাত্র। কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তাঁদের তদন্তকাজ শেষ করতে সময় লাগবে। কিন্তু শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক রাশেদা বেগমের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি এক দিনেই রিপোর্ট দিয়েছে। যে উদ্দেশ্যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেই যৌন নিগ্রহের বিষয়টি তদন্তে অনুপস্থিত। যুক্তি দেওয়া হয়েছে, অভিযুক্ত চার প্রশিক্ষক প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় তাঁদের যৌন হয়রানির তদন্ত করতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। তাহলে শিক্ষা বিভাগের এই তদন্ত কমিটি কেন করা হলো? এটা তো অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মূল যে অভিযোগ, তাকে হালকা করবে। যেখানে যৌন নিগ্রহের ঘটনায় পিটিআইয়ে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে, প্রশিক্ষণার্থীরা শ্রেণিকক্ষ ছড়ে মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন, সেখানে তদন্তের নামে এই প্রহসনের অর্থ কী।

সুষ্ঠু তদন্ত না হলে অভিযুক্তরা অপরাধী কি না, সেটি কীভাবে নির্ধারিত হবে? এত দিন কেউ মুখ খোলেননি বলে প্রমাণ হয় না যে অভিযুক্তরা নিরপরাধ। যে চার প্রশিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এসেছে, কর্তৃপক্ষ তাঁদের প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে প্রত্যাহার কোনো শাস্তি নয়। এখনই তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া গেলেও অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে তাঁদের অন্তত সাময়িক বরখাস্ত করা উচিত।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতনের প্রতিকার ও প্রতিরোধে ২০০৯ সালে হাইকোর্ট গাইডলাইন বা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতনবিরোধী কমিটি গঠনের কথা থাকলেও বেশির ভাগেই কোনো কমিটি করেনি। আর যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি আছে, তা–ও অনেকটা নিষ্ক্রিয়। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাতে যৌন নির্যাতনবিরোধী কমিটি গঠন করে, সেই ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ আশা করছি।