ভাইরাল গুজব ও ভয়ের ভাইরাস

গুজব ভাইরাসের গতিতে ছড়ায়। আর তা সমস্যার মোকাবিলা কঠিন করে তোলে। ছবি: এএফপি
গুজব ভাইরাসের গতিতে ছড়ায়। আর তা সমস্যার মোকাবিলা কঠিন করে তোলে। ছবি: এএফপি

হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সেটার অভাবে সাবান দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়ার পরামর্শের বাইরেও বিভিন্ন কথা শোনা যাচ্ছে। ‘রসুনের দুই কোয়া খেলে করোনা হবে না’, ‘করোনা অমুসলমানদের হয়’, অথবা ‘গোমূত্র সেবনে করোনা দূর হয়’—এসব পুরোনো গুজব, এসবের কথা বলছি না। যে গুজবের ভেতরে ঢুকেছে, তাকে কোনোভাবে সেই গুজব থেকে বের করে আনলেও সে খুব সম্ভব আরেক গুজবে ঢুকবে। বাস্তব সত্য থেকে গুজবে উত্তেজনা বেশি। গুজব নিজের পক্ষে একটি ‘বয়ান’ তৈরি করে নিজেকে মিথ্যা সান্ত্বনা বা বাহবা দেয়। যেমন আফ্রিকায় গুজব উঠেছে, আফ্রিকানদের করোনাভাইরাস হয় না। এমন সব গুজব মোকাবিলায় তাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হিমশিম খাচ্ছে।

তবে সেসব গুজব নিয়ে কথা নয়। ভালো জানাশোনা আছে, এমন মানুষের কাছ থেকেই বিভিন্ন কথা শোনা যাচ্ছে। যেমন এক গ্রুপের মতে, করোনাভাইরাস তেমন কিছুই না। মিডিয়া এটাকে নিজেদের স্বার্থে বড় করে বানিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এটাতে মোটে চার হাজার মানুষ মারা গেছে, তাও বয়স্ক অথবা ভীষণ অসুস্থ যারা, তারা। সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জায় প্রতিবছর মারা যায় আড়াই থেকে পাঁচ লাখ মানুষ। তাহলে? এত মাতামাতি কেন? এ তো সর্দিজ্বর ছাড়া কিছু নয়! শিশুদের নাকি হয় না। তাহলে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া কেন?

একটি বহুল প্রচলিত গল্প আছে। সেটা নিজের ভাষায় বলছি। একজন রাজভিক্ষুক বলল, মহারাজ, সোনার মোহর বা হিরে-জহরতের ছিটেফোঁটা না দিয়ে আজ আমাকে একটি টাকা দিন। কাল দুই টাকা, তারপরের দিন চার টাকা, এভাবে প্রতিদিন আগের দিনের দ্বিগুণ করে দিন মহারাজ। মাত্র একটি মাস এভাবে দিলেই আমি খুশি। এ আর এমনকি? দয়ালু রাজা ভিক্ষুকের এই অদ্ভুত আবদারে রাজি হলেন।

এক টাকা থেকে শুরু করে এভাবে দ্বিগুণ করতে করতে যখন ২৬/২৭ দিনের কাছাকাছি এল, তখন রাজার খাজাঞ্চির কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। একি মহামারি কাণ্ড? প্রথমে দু-চার টাকা, সেটা বেড়ে হলো দু-চার শ টাকা, তারও পরে নাহয় কয়েক হাজারই হলো! কিন্তু এখন যে এটা লাফ দিয়ে কোটিতে পৌঁছেছে? সব শুনে রাজারও চক্ষু চড়কগাছ! ২৭ দিনে হয়েছে মোট ১৩ কোটি ৪২ লাখ ১৭ হাজার ৭২৭ টাকা! ৩০ দিনে হচ্ছে ১০৭ কোটি ৩৭ লাখ ৪১ হাজার ৮২৩ টাকা! কী মহামারি কাণ্ড?

তার মানে হচ্ছে, কোনো কিছুকে দ্বিগুণ করতে থাকলে হঠাৎই সেটা অবিশ্বাস্য পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।

দ্বিগুণের জায়গায় প্রতিদিন তিন গুণ দিতে হলে? সেদিকে আর বেশি পা না বাড়াই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল বিষয়টাও তাই। একজন মানুষ দুজনকে দিচ্ছে, সেই দুজন আরও দুজনকে। যদি কোনোভাবে এই বৃদ্ধিটাকে বন্ধ করা না যায়, তাহলে এক মাসেই সব সয়লাব হয়ে যাবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এভাবে কয়েক ঘণ্টায় ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। সেখানে দিন লাগছে না। প্রতি মিনিটেই একজনের কাছ থেকে পাঁচজন, সেই পাঁচজন দিচ্ছে আরও পঁচিশজনকে। কিছু পরেই অবিশ্বাস্য গতি, পৌঁছে যাচ্ছে অবিশ্বাস্যসংখ্যক মানুষের কাছে।

কিন্তু ভাইরাল কথাটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়েছে ভাইরাস নামক সত্যিকার জীবাণুর কাছ থেকে। এই জীবাণু, একজন মানুষের কাছ থেকে তিনজনের কাছে (কথার কথা), সেই তিনজনের কাছ থেকে নয়জনের কাছে, এভাবে যদি ছড়াতে থাকে, তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই কী অবস্থা হবে? সেই অবস্থাটার নাম ভাইরাল হওয়া। সেই অবস্থাটাকে বোঝাতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো কিছু দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে বলা হয় ভাইরাল হয়েছে। এটা আক্ষরিক অর্থ নয়, ভাবার্থ মাত্র। এই ব্যাপারটাই মহামারি। হ্যাঁ, একটু বেখাপ্পা লাগলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মহামারির আকারে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, আর ভাইরাল হয়েছে বলা একই কথা।

এই বিষয়টিতে আরেকটু মনোযোগ দেওয়া যাক। কারণ, করোনাভাইরাস বা যেকোনো ভাইরাসের সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর ভীষণ উদ্বেগ ও সতর্কবাণীর কারণটা তাহলে বোঝা হবে। ধরা যাক, সেই চতুর ভিক্ষুক প্রতিদিন দ্বিগুণ না বলে বলল, মহারাজ প্রতিদিন আমাকে একটি করেই টাকা দিন। তাহলে সে ৩০ দিনে কত টাকা পেত? মাত্র ৩০ টাকা। কোথায় ১০৭ কোটি, আর কোথায় মাত্র ৩০ টাকা? এভাবে এটা ১ দশমিক ৫ সূচক হারে বাড়লে যে সংখ্যাটি হবে, তাও অনেক ছোট, কিন্তু ১ হারে বাড়ার থেকে অনেক অনেক বড়, ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০। এই বিষয়টিকে বলে এক্সপোনেন্সিয়াল গ্রোথ, বাংলায় সূচকীয় হারে বৃদ্ধি। সেই ‘২’ বা ‘১ দশমিক ৫’ হলো সূচক। সূচক সামান্য বাড়লেই তুলকালাম কাণ্ড হয়ে যাচ্ছে।

ভাইরাসের বেলাতেও তাই। তবে ভাইরাস প্রতিদিন ছড়াচ্ছে না। আক্রান্ত মানুষটি প্রথম বেশ কিছুদিন সেটা নিজের কাছেই রাখছে (ইনকিউবেশন পিরিয়ড)। সেগুলো আমলে নিয়েই ভাইরাসের বৃদ্ধির সূচক তৈরি করা হয়। একজন আক্রান্ত মানুষ যদি গড়ে প্রতিদিন ১ দশমিক ৩ জন মানুষের কাছে ছড়ায়, তাহলে পাঁচটি সংক্রমণ সাইকেলের মধ্যেই ৪৫ জন মানুষ আক্রান্ত হবে। যদি ছড়ানোর সূচক ২ দশমিক ৬ হয়, তাহলে দ্বিগুণ নয়, সেটা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৩৬৮ জনে।

এ জন্যই জানা প্রয়োজন, একটি নতুন ভাইরাস কীভাবে এবং কত সূচকীয় হারে ছড়াচ্ছে। সে বিষয়েই চলছে জোর গবেষণা, সেখানেই ভীষণ কিছু ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা। সূচক সামান্য বেশি হলেই কিছুদিনের মধ্যে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে।

করোনাভাইরাস ছড়ানোর সূচক হিসাব করে বের করা হয়েছে, ২ দশমিক ৬। সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার সূচক পাওয়া গেছে ১ দশমিক ৩। সেখানেই ইনফ্লুয়েঞ্জার থেকে করোনাভাইরাস বিষয়ে ভয়টাও সূচকীয় হারে বেশি। সে জন্যেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেশি বাড়ার আগেই এই সূচকীয় চক্রকে ভেঙে ফেলাটা এত জরুরি। চক্রটাকে ভাঙার জন্যই কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছে। সে জন্যই অনেক দেশ সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে। এমনকি নিজের দেশের কোনো শহর বা অঞ্চলকেও দেশের অন্য অংশ থেকে আলাদা করে রাখছে। আজই ইতালি পুরো দেশকে রেড জোন ঘোষণা দিল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ঘরেই থাকুন, কোনো জায়গায় যাওয়ার প্রয়োজন হলে আগে অনুমতি নিন।

সেই মানুষটি অসুস্থ কি না, সেটা দেখা হবে, হলে আর তাকে যেতে দেওয়া হবে না। এসব আসলে ২ দশমিক ৬ সূচক হারে সংক্রমণের ভয়াবহ বৃদ্ধি ঠেকানোর প্রচেষ্টা। এমনকি এর ওপরে ইতালির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বলেও সে দেশের প্রধানমন্ত্রী অকপটে স্বীকার করছেন।

কোনো দেশে একটি মানুষেরও যদি এই ভাইরাস না থাকে, তাহলে ছড়ানোর প্রশ্নই আসছে না। যদি কিছু মানুষের হয়েই যায়, তখন স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা দরকার পড়বে। যেন মানুষ কাছাকাছি না আসতে পারে। বড় জমায়েত বন্ধ করা, এসবই হচ্ছে সেই একটি সংখ্যার ১০৭ কোটি হয়ে যাওয়াটাকে ঠেকানো। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার মতো করে করোনাভাইরাস যেন ভাইরাল না হয়, সে জন্য তার সূচকীয় হারে অবাধ ছড়ানোতে বিঘ্ন ঘটানো জরুরি। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, এ ডেঙ্গু না হলেও এর সংক্রমণ ডেঙ্গুর থেকে ভয়াবহ। শুধু মৃত্যুহারের জন্য নয়, সংক্রমণের বিপজ্জনক সূচকের কারণে এই রোগ মারাত্মক। অনেক কিছু অজানা থাকার কারণেও একে বাড়তে দেওয়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এ আবার লুকিয়ে থেকে পরের শীতে আসবে। অভিযোজন করে যদি নতুন রূপে আসে, মানবজাতির জন্য সাংঘাতিক হুমকি। একে যেভাবেই হোক এখনই ঠেকাতে হবে। সে কথাই দেশে-বিদেশে সব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে।

সবাই করোনাভাইরাসের ব্যাপারে সঠিক তথ্য জেনে, সচেতন হয়ে সহযোগিতা করলেই সমাজ ও পৃথিবীর হুমকি এই ভাইরাসের মূলোৎপাটন করা সম্ভব হবে।

মোস্তফা তানিম: বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লেখক।