করোনার বিপদ কেন (এখন পর্যন্ত) উন্নত দেশে বেশি

চীন যখন করোনাভাইরাসের আক্রমণ মোটামুটি সামলে এনেছে, তখন মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ইতালিতে। ইউরোপের প্রায় প্রতিটা দেশ কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত। ইতালি, জার্মান, ফ্রান্স ও স্পেন এর মধ্যেই নাজেহাল অবস্থায় চলে গেছে। ইতালি পুরো দেশ ধরেই কোয়ারেন্টাইন শুরু করে দিয়েছে, খুব প্রয়োজন ছাড়া কারও বাইরে বের হওয়া নিষেধ। ইতালিতে ১১ মার্চ পর্যন্ত মৃত্যুহার এসে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। জার্মান চ্যান্সেলর ঘোষণা দিয়েছেন, সামনের দিনে তাঁদের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হতে পারে।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, এই রোগের বিস্তার ইউরোপ-আমেরিকা বা ‘উত্তর গোলার্ধে’ কেন বেশি?

প্রথমত শীতপ্রধান দেশে বাড়ি, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, বাস, ট্রেন—সবকিছু ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে বদ্ধ থাকে। সেই কারণে কোনো ট্রেনে বা বাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত যাত্রী থাকলে বাকি সবাই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা দেশগুলোয় যদিও জনসংখ্যা তুলনামূলক কম, কিন্তু বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশি। ইউরোপের প্রায় প্রতিটা দেশেই ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে মানুষের সংখ্যা সেই দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের কাছাকাছি। কোভিড-১৯–এ যেহেতু বয়স্ক মানুষ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, সে কারণে গুরুতর রোগীর সংখ্যাও তুলনামূলক বেশি। এ ক্ষেত্রে তাদের উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা খুব কার্যকর হচ্ছে না। অন্যদিকে, আফ্রিকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব কম, দরজা–জানালা খোলা-বদ্ধ থাকে না। শীতপ্রধান দেশে বাড়ি, গাড়ি, যানবাহন বদ্ধ থাকে। এ ছাড়া ইউরোপের ভেতরে অবাধ যাতায়াত এবং শুরুতে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত করা এবং কোয়ারেন্টাইনে নেওয়াটা খুব দ্রুত করা হয়তো সম্ভব হয়নি। তবে এই দুটি কাজই জাপান শুরুতে আর দক্ষিণ কোরিয়া একটু দেরিতে দক্ষতার সঙ্গে করতে পেরেছে।

উন্নয়নশীল বা দক্ষিণের দেশগুলোর ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করলে দেখব, তারা শুরুতে ১ জন, ২ জন বা ১০ রোগী শনাক্ত করেছে, তারপর আর নতুন পাওয়ার হার খুবই কম। অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন, গরমে এই ভাইরাস বাঁচতে পারে না। তা হয়তো হতে পারে। তবে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ওমান, কুয়েতে সারা বছর গরম থাকার পরও কোভিড-১৯–এর রোগী পাওয়া যাচ্ছে। আর গবেষকেরা বলছেন, ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে তাপমাত্রা গেলেই তবে করোনা ভাইরাস মারা যায়। পৃথিবীর কোনো দেশের তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি ওঠে না, সুতরাং কোনো দেশের গরম তাপমাত্রায় কোভিড-১৯ হবে না, সে সুযোগটা নেই। এখন রোগী পাওয়া না পাওয়ার যথার্থতা বুঝতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চীনের মতো অস্বাভাবিক হারে নিউমোনিয়া রোগী বাড়ছে কি না, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

মহামারি নিয়ন্ত্রণের বেলায় মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যখন খুব দক্ষতার সঙ্গে অল্প রোগীকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়, তখন কোয়ারেন্টাইন কাজ করে। কিন্তু একটা সময় যখন কে আক্রান্ত আর কে আক্রান্ত না, সেটা আর ধরতে পারা সম্ভব হয় না, তখন ইতালির মতো পুরো দেশকে কোয়ারেন্টাইনে নিতে হয়। প্রত্যেককে একে অন্যদের থেকে আলাদা থাকতে হয়, কিন্তু সেটা শেষ উপায়।

অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে খুব বেশি না, মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর একটি, এত অল্প জায়গায় এত মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। ১৬ কোটি মানুষের দেশে তাই বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ৮০ লাখেরও ওপরে। এ ছাড়া বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, খাদ্যদূষণে আমাদের অবস্থা এমনিতেই জেরবার। তাই করোনাভাইরাসে ঝুঁকিপূর্ণ না, এমন কোনো পরিবার হয়তো বাংলাদেশে পাওয়াটা কঠিন হবে।

এ ছাড়া আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখনো খুব শক্তিশালী না, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অপ্রতুল। ভবিষ্যতের এই ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় এখন থেকে প্রস্তুতি শুরু করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আইইডিসিআর যে হটলাইন করেছেন, সেখানে দুই স্তরের সেবা থাকতে পারে। প্রথম স্তরে সাধারণ তথ্য দেওয়া হবে, যদি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হয়, প্রথম স্তর থেকে ডাক্তারের সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দেওয়া হবে। ডাক্তাররা একটা চেকলিস্ট ফলো করবেন, যেমন বয়স কত? আগে থেকে কোনো রোগে আক্রান্ত কি না, কোনো ওষুধ খাচ্ছেন কি না? এগুলো শুনে নিশ্চিত হবেন যে রোগী ঝুঁকিপূর্ণ, নাকি ঝুঁকিপূর্ণ না। তারপর ঝুঁকিপূর্ণ হলে তাকে নিকটস্থ ডেজিগনেটেড হাসপাতালে নিরাপদ কোনো বাহনে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাস অত্যন্ত সংক্রামক, তাই অন্য রোগীদের নিরাপদে রাখার জন্য ডেজিগনেটেড হাসপাতালে কোভিড-১৯ ছাড়া অন্য কোনো রোগী রাখা যাবে না এবং গাড়ির ড্রাইভার থেকে শুরু করে ডাক্তার–নার্স সবাইকে সব সময় প্রতিরক্ষামূলক জিনিসপত্র, যেমন: গাউন, গ্লাভস, জুতা, মাস্ক, চশমা ইত্যাদি দিয়ে রাখতে হবে। কারণ, তাঁরা আক্রান্ত হলে পরে চিকিৎসা দেওয়ার আর কেউ থাকবে না।

সর্বোপরি ডেঙ্গু, কোভিড-১৯–এর মতো অন্যান্য রোগ মোকাবিলার জন্য দরকার তড়িৎ রোগী শনাক্তকরণ এবং দক্ষ মনিটরিং ব্যবস্থা। ডিজিটাল এপিডেমিওলজি বিশ্বে এই মুহূর্তে কোথায় কতজন কোভিড-১৯ রোগী আছে, সেটা যেমন দেখাচ্ছে, তেমনি করোনা বা ডেঙ্গুর মতো পরিস্থিতিতে দেশের ভেতরের পরিস্থিতি ‘প্রকৃত সময়ে’ জানতে এবং করণীয় ঠিক করতে নিজেদের একটা ডিজিটাল এপিডেমিওলজিক্যাল সার্ভেল্যান্স সিস্টেম থাকাটা জরুরি। রোগ এবং রোগী চিহ্নিত করতে আর অবস্থান নির্ণয় করতে চীনের ১১ দিন দেরিতে শুরু করার মাশুলও যে কত বড় হতে পারে,কোভিড-১৯ তার বড় উদাহরণ। আমরা প্রস্তুতি নিতে দেরি করতে চাই না।

আতিক আহসান: স্বাস্থ্য নৃবিজ্ঞানী