আগস্টের আগে পেঁয়াজ আমদানি নয়

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

গত রোববার হাটের দিনে কাশিনাথপুরের জমজমাট বাজার। দূরদূরান্ত থেকে ফড়িয়ারা চলে আসেন আগের দিন। নতুন পেঁয়াজ বাজারে উঠতে শুরু করায় ফড়িয়াদের আগ্রহ বেশি। মুড়িকাটা পেঁয়াজের পাশাপাশি চৈতালি পেঁয়াজের আগাম জাতেরও দেখা মিলল হাটে। কাশিনাথপুরের বাতেন সিড স্টোরের কাছে এক চায়ের দোকানে তখন চলছিল জমজমাট চায়ের আসর। রং চা, দুধ চা, চিনি ছাড়া চা, মালাই চাসহ বিভিন্ন নামের চা। হরেক রকমের খদ্দেরের হরেক চাহিদা। জি কে শামীমের জামিন, করোনাভাইরাস, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য, ইত্তেফাক, প্রথম আলো, বণিক বার্তা—সবই আছে চায়ের আলোচনায়। তবে সব আলোচনা ছাপিয়ে বারবার ফিরে আসে পেঁয়াজের দাম।

‘চোদ্দ শ আশি মুড়িকাটা, গত বিস্যুতবারের (বৃহস্পতিবার) চেয়ে কুড়ি টাকা কম। দাম আরও নামবে।’ কাশিনাথপুরের হাট বসে রোববার আর বৃহস্পতিবার। গত বৃহস্পতিবার মুড়িকাটা পেঁয়াজের মণ (চল্লিশ কেজি) ছিল পনেরো শ টাকা। দুই দিন পর কুড়ি টাকা কম চৌদ্দ শ আশি। মুড়িকাটা পেঁয়াজ বেশিদিন ঘরে রাখা যায় না, তাই চাষি–জোতদার কেউই ধরে রাখে না মৌসুমের প্রথম দিকে ওঠা এই পেঁয়াজ। তা ছাড়া অসময়ে বৃষ্টির উৎপাত দেখে যে পেঁয়াজ দু–এক সপ্তাহ পরে খেত থেকে তুললে চলত, সেটাও উঠিয়ে হাটে নিয়ে আসছে চাষি। হাটে আমদানি বাড়লেই দাম কমে। কাশিনাথপুরের হাটে দাম কমার সেটাই মূল কারণ।

তবে ‘পেপার’–এর লোকদের ধারণা অন্য। তাঁদের মতে, ইন্ডিয়া পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ায় বাজার পড়ে যাচ্ছে। যেকোনো সময় ইন্ডিয়ার পেঁয়াজ চলে আসবে। চায়ের দোকানের চুলার আড়ালে বসে থাকা হারান মণ্ডল তাঁর চায়ের কাপ ফিরিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘ধরো ইনডিয়ার পেঁয়াজ এখন কারাগারে আটক, চট করে ছাড়ান পাবি না।’ হারান মণ্ডল ঢাকার কাগজ থেকে হুবহু পড়ে শুনিয়ে দিলেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের মন্তব্য, ‘আমি ক্যাবিনেটেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনে রিকোয়েস্ট করেছি, যখন হারভেস্ট শুরু হবে তখন যেন পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করা হয়। গত ক্যাবিনেটে আলোচনা হয়েছে। সেখানে বাণিজ্যমন্ত্রী (বিষয়) তুলেছিলেন, আমরা কৃষি মন্ত্রণালয় কী করছি? বলেছি, আমরা চাষিদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পেয়েছি। (পেঁয়াজ চাষের) আওতা যথেষ্ট বেড়েছে। আশা করি অসুবিধা হবে না।’ হারান মণ্ডলের ছেলে প্রোমোশন পেয়ে সম্প্রতি উপসচিব হয়েছেন। তাই তাঁর কথার ভার বেশি। আগের মতোই এখনো রেফারেন্স ছাড়া কথা বলেন না। ‘ছেলে বলছে’ এমন কথা যে একবারও বলেন না, তা বলা যাবে না। তবে ‘পেপার’–এর রেফারেন্সে থাকেন বেশি। মানুষ এখনো ছাপা কথাকে বিশ্বাস করে।

আতর আলির গদিঘরের শান্তিচরণ এতক্ষণ সবার কথা শুনছিলেন চুপচাপ। তাঁর হাতেও একটা খবরের কাগজ। আতাইকল, বেড়া, কাশীনাথপুর—সব মোকামেই তাঁর ঘোরাফেরা। হিলি, বেনাপোল, ভোমরা—সব বর্ডারেই তাঁকে আমদানির কাজে যেতে হয়। তিনি বলেন, ‘দ্যাখেক কত দিন আটকায়ে রাখবার পারে! খবর তো রাখো না, কত আটক টেবিলের তল দি জামিন হয়া যাচ্ছে। পেঁয়াজের জামিন এখন যখন তখন।’

নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় ভারত থেকে আবার পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা। মার্চ মাস থেকেই থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে সরকারের অনুমতি চেয়েছেন তাঁরা। ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের মহাপরিচালক অমিত যাদবের সই করা ওই নির্দেশনায় পেঁয়াজ রপ্তানির সব নিষেধাজ্ঞা শুধু প্রত্যাহারই করা হয়নি, বরং পেঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানিমূল্যের শর্তটিও সেখানে আর নেই। অর্থাৎ আমদানিকারক ভারত থেকে যে দামে পেঁয়াজ কিনবে, সেই দামেই এলসির মাধ্যমে দেশে আমদানি করতে পারবে। হিলি স্থলবন্দরের পেঁয়াজ আমদানিকারক নাজমুল ও আহম্মেদ আলী সরকার স্থানীয় সাংবাদিকদের সে রকমই জানিয়েছেন। ভারতের এই ঘোষণার পাক্কা কাগজ সেই দেশের রপ্তানিকারক বন্ধুদের মাধ্যমে হিলির আমদানিকারক বন্ধুদের হাতে চলে আসে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। তারপর তাঁরা আর সময় নষ্ট না করে আমদানির আবেদন করেন। আসন্ন রমজান মাসের দোহাই দিয়ে দেশের বাজারে পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদাকে ঘিরে তাঁরা এলসি খুলতে চান। দ্রুত আমদানি করতে চান। ঢাকায় তাঁরা হরদম কথা বলছেন, ইন্ডিয়ার পেঁয়াজের জামিন ঠেকানো কঠিন হবে। চায়ের দোকানে জিরোতে আসা ব্যাপারী–চাষি সবাই হাঁ করে শান্তিরঞ্জনের কথা শোনে। কথার ফাঁকে শান্তিরঞ্জন একবার হিলি একবার বেনাপোলের সঙ্গে কথা বলে।

আড়তদার–জোতদারদের এসব আলোচনায় চাষি হারুন প্রামাণিকেরা কোনো কূলকিনারা পান না। অনেক কষ্টে অনেক ধারদেনা করে তাঁরা পেঁয়াজের আবাদ করেছেন। হারুনদের সরল হিসাবে (যার মধ্যে ব্যক্তিগত আর পারিবারিক খাটাখাটনির কোনো হিসাব ধরা হয় না) এবার তাঁদের এক বিঘা পেঁয়াজ লাগাতে খরচ পড়েছে ২০ হাজার টাকা। সে হিসাবে মাঠপর্যায়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ পড়ে অন্তত ৩০ টাকা। কাশিনাথপুরে এখনই পাইকার হাঁকছে কেজিপ্রতি ৩৭ টাকা। কৃষিমন্ত্রী অবশ্য মনে করছেন, এ রকম দাম থাকলেও কৃষকের লাভ থাকবে।

কৃষি গবেষণা যে জাত উদ্ভাবন করে মাঠে ছেড়েছে, তাতে জমিতে উৎপাদন দ্বিগুণ না হলেও কাছাকাছি হবে। আগে যেখানে প্রতি হেক্টরে ১০-১১ টন হতো, সেটা এবার হবে ১৮-১৯ টন। সবার কাছে নতুন বীজ পৌঁছালে, কৃষক ন্যায্যমূল্য পেলে, আগামীতে পেঁয়াজের চাষ বাড়বে। পেঁয়াজের বর্তমান ঘাটতি কমে যাবে, এমনকি পেঁয়াজে স্বনির্ভরও হতে পারে দেশ। এ মুহূর্তে ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে ঢুকলে উৎপাদনে স্বনির্ভর হওয়া দূরে থাক, কৃষক আর পেঁয়াজ চাষের কথা মুখেও আনবেন না।

পেঁয়াজ আমদানির ব্যাপারে কৃষিমন্ত্রীর যে জোর আপত্তি আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি কতটুকু পারবেন আমদানির জোয়ার সমলাতে; সেটা ভাবার বিষয়। কৃষকের স্বার্থে দেশের কল্যাণে আমদানির মচমচে ব্যবসা রুখতে হলে তড়িৎ ও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন বলেছেন, ‘ভারত থেকে পেঁয়াজ আনব না এমন সিদ্ধান্ত ছিল না। তবে মন্ত্রী মহোদয় (বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি) বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করব না। তবে সেটা লিখিত (সিদ্ধান্ত) হয়নি। ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তও এখন পর্যন্ত হয়নি।’ ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টা দেখছি। এটা নিয়ে কথা বলার সময় এখনো হয়নি। গভীরভাবে বিষয়টি দেখছি। কৃষকের ক্ষতি হয় এমন কিছু করব না।’ (৪ মার্চ, ২০২০ দেশ রূপান্তর)।

লাঠি না ভেঙে সাপ মারতে ব্যাকুল আমলাতন্ত্র আর যা–ই করুক, তারা যে কৃষকের স্বার্থের কোনো প্রতিনিধিত্ব করে না, সেটা সবার জানা। তাই পেঁয়াজচাষিদের ধোঁয়াশায় না রেখে পেঁয়াজ আমদানির সব কার্যক্রম কমপক্ষে জুলাই–আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া উচিত। পেঁয়াজের জাহাজ, ট্রাক কোনো অবস্থাতেই যেন আগস্টের আগে আমাদের কোনো বন্দরে না থামে।

কৃষিবিদ ড. সদরুল আমিনেরও তাই মত, তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার বিষয় মাথায় রেখে আপাতত পেঁয়াজ আমদানির বিষয় মাথা থেকে বাদ দিতে হবে। আর আমদানি যদি করতেই হয়, তাহলে আগস্টের পরে।
লেখক: গবেষক