আদালতে অভিনব সাজা

প্রচলিত আইনটি অচল হয়ে পড়েছিল। এমনকি আইনটি প্রয়োগে কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্ট নির্দিষ্টভাবে পরিপত্র জারি করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিচার প্রশাসন থেকে সাড়া মিলছিল না। আইনটি হলো প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০। মাগুরার বিচারকেরা এই ক্ষেত্রে একটি ভালো নজির স্থাপন করেছেন। মাদকদ্রব্য–সংক্রান্ত এক মামলায় অভিযুক্ত নয় তরুণকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়নি। আদালত তাদের ‘শাস্তি’ হিসেবে বই পড়া, সিনেমা দেখা ও গাছ লাগানোর আদেশ দিয়েছেন। এ মাসেই পারিবারিক বিরোধের আরেকটি মামলায় একই ধরনের রায় হয়। চাচির মাথায় আঘাত দেওয়ার দায়ে আরেক যুবককে এক বছরের প্রবেশন (কারাগার এড়িয়ে শাস্তি) দেওয়া হয়।

৩৫ লাখের বেশি মামলার চাপে আমাদের বিচার প্রশাসনের অবস্থা কাহিল। আবার কারাগারগুলোকেও ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক রাখতে হচ্ছে। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে সরকার ও বিচার বিভাগ বিরোধ নিষ্পত্তির বিকল্প ব্যবস্থা (এডিআর) চালু করতে উদ্যোগী হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে তাতে কাঙ্ক্ষিত ফল মেলেনি। অবশ্য এ ক্ষেত্রে মামলা সংশ্লিষ্ট বা বিচার প্রার্থীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা মুখ্য ভূমিকা রাখে। কিন্তু প্রবেশন দেওয়ার বিষয়টি বিচারকের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় প্রবেশন কথাটি অনালোচিত বা অপরিচিতই থাকল, এটি দুর্ভাগ্যজনক।

বিদ্যমান আইনে লঘু অপরাধী, প্রথম অপরাধী এবং আইনের সংস্পর্শে আসা বা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়া শিশুদের প্রবেশন মঞ্জুরের সুযোগ রাখা হয়েছে। জীবনে যারা প্রথমবারের মতো অপরাধ করেছে, ভবিষ্যতে তার পুনরাবৃত্তি না করা এবং নিজেকে সংশোধন করে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে দোষী সাব্যস্ত হলেই কারাপ্রকোষ্ঠের জীবন অনিবার্য—সেটা অপরাধবিজ্ঞান বলে না।
বরং সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রবেশন অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়ে থাকে। যেসব উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ আইনের শাসনবিষয়ক সূচকে ওপরের দিকে রয়েছে, তারা কিছু লঘু অপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে এমন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রবেশন বা গিল্টি প্লিডিংস বা স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করার মতো প্রথাগুলো গতিশীল করার চেষ্টা করে। এভাবে অনেক লঘু অপরাধীকে কারারুদ্ধ না করেও সমাজের অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণে রাখা কিছু মাত্রায় সম্ভব। এটা সে সব দেশের আইনের শাসনের সঠিক চর্চারই অন্তর্ভুক্ত রীতি। এভাবে তারা সুশাসন বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে।

আমরা আশা করি, মাগুরার আদালত থেকে প্রবেশন লাভকারী তরুণেরা এবং তঁাদের অভিভাবকেরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন; তাঁরা নিজেদের সংশোধন করার এই সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগাবেন। বই পড়ার শাস্তিকে তাঁরা শাস্তি হিসেবে গ্রহণ না করে নিজের মননের উন্নতি সাধনের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করবেন। তাঁরা আদালতের প্রত্যাশা পূরণ করলে এটি আমাদের বিচার প্রশাসনে একটি নতুন ধারার সূচনা ঘটাতে পারে। যে বিচারকেরা ‘স্বেচ্ছাধীন’ এখতিয়ার প্রয়োগে দোটানায় থাকেন, তাঁরাও অনুপ্রাণিত হতে পারেন। ১৯৬০ সালের আইনটি ছাড়াও কারাগারে আটক সাজাপ্রাপ্ত নারীদের বিশেষ সুবিধা আইন, ২০০৬ এবং শিশু আইন ২০১৩ মোতাবেক সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রবেশন ও আফটার কেয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সুতরাং বিচার প্রশাসন, সমাজসেবা অধিদপ্তর, আইনজীবী ও অভিভাবকদের মধ্যে একটি সমন্বয়ের দরকার পড়বে। এমনকি আইন বলেছে, নাগরিকেরাও নজরদারিতে অংশ নেবেন। কোনো ব্যত্যয় দেখলে তাঁরা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন।