মুজিব বর্ষ ও একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা

চারদিকে ভীষণ দুঃসংবাদ। করোনাভাইরাস ১১৮টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। মোট আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার ৮৬৩ জন। মারা গেছে ৪ হাজার ৬০০, যার মধ্যে চীনেই ৩ হাজার ১৬৯। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যে করোনাভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করেছে। স্বস্তির খবর যে বাংলাদেশে এখনো কেউ মারা যায়নি। যে তিনজন আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁরা দুজনই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তাঁদের একজন বাড়ি ফিরেছেন। বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ বেশি না হলেও যোগাযোগ, পর্যটন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাত্মক ধাক্কা দিয়েছে। সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, জনসচেতনতা তৈরির চেষ্টা চলছে। এগুলো ইতিবাচক। আবার করোনা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের প্রাত্যহিক বাহাস দেখে মনে প্রশ্ন জাগে জাতীয় দুর্যোগেও যদি আমাদের নেতারা দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, তাহলে কবে করবেন?

এই ভয়াবহ দুঃসময়েও শুক্রবারের পত্রিকায় বেশ কটি ইতিবাচক খবর এসেছে। আজকের কলামও সেসব নিয়ে। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা-মাওয়া-ফরিদপুর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন করেন, এখন থেকে ঢাকা থেকে মাওয়া যেতে বা মাওয়া থেকে ঢাকা আসতে লাগবে ২৭ মিনিট। এটি আমাদের সড়ক যোগাযোগে মাইলফলক অগ্রগতি। কিন্তু একই সঙ্গে এই প্রশ্ন করাও জরুরি, মাওয়া থেকে এসে বুড়িগঙ্গা পার হওয়ার পর মিরপুরে বা উত্তরা যেতে কত সময় লাগবে? বুড়িগঙ্গা পার হওয়ার পর মিরপুরে যেতে যদি দেড় বা দুই ঘণ্টা লেগে যায়, তাহলে এক্সপ্রেস হাইওয়ে খুব কাজে আসবে বলে মনে হয় না। প্রশাসন থেকে শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শিল্পকারখানা—সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক করার যে উন্মাদনা চলছে, অবিলম্বে তা বন্ধ করতে হবে। আগামী ৩০ বা ৫০ বছরে ঢাকা শহর কী রূপ নিতে পারে, পরিকল্পনাবিদদের মাথায় সেটি রাখতে হবে। ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ কমাতে হবে।

সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে যত বিরূপ সমালোচনাই হোক, বদলানোর নজির নেই বললেই চলে। বরং সমালোচকেরা এক কথা বললে, নীতিনির্ধারকেরা পাঁচ কথা শুনিয়ে দেন। এবারই কিছুটা ব্যতিক্রম দেখলাম। ২০২০ সালের একুশে ও স্বাধীনতা পদক ঘোষণার পর সরকার-সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকেই জোরালো প্রতিবাদ ওঠে। স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় এমন ব্যক্তিদের নামও আছে, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো অবদানই নেই। সাহিত্যে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়েছিল এস এম রইজ উদ্দিন নামের এক সাবেক আমলাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর যেসব কবিতা ভাইরাল হয়েছে, সেগুলো পাঠ–অযোগ্য। ব্যাপক সমালোচনার মুখে গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যে সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করা হয়, তাতে রইজ উদ্দিন আহম্মদের নাম নেই। এই তালিকা অনুযায়ী এই পুরস্কার পাচ্ছেন যথাক্রমে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতীক, মরহুম কমান্ডার (অব.) আবদুর রউফ, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুহম্মদ আনোয়ার পাশা ও আজিজুর রহমান; চিকিৎসাবিদ্যায় অধ্যাপক ডা. মো. উবায়দুল কবীর চৌধুরী ও অধ্যাপক ডা. এ কে এম এ মুক্তাদির; সংস্কৃতিতে কালীপদ দাস ও ফেরদৌসী মজুমদার। এ ছাড়া শিক্ষায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের ভারতেশ্বরী হোমস এবার স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছে। ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার কথা রয়েছে।

 এ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক যে যুক্তি দিয়েছেন, সেটি খুবই হাস্যকর। তিনি বলেছেন, ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে রইজ উদ্দিনের নাম সুপারিশ করা হয়েছিল। পরে তারা তাঁর নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সাহিত্যের বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় কীভাবে সুপারিশ করে? সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নামে সরকারের একটি মন্ত্রণালয় আছে, যার অধীনে শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘরের মতো প্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকেই শিল্প-সাহিত্যে কীর্তিমান মানুষের নাম সুপারিশ করার কথা। মন্ত্রীর কথা অনুযায়ী, ভূমি মন্ত্রণালয় যদি সাহিত্যে কারও নাম সুপারিশ করেও থাকে, মন্ত্রিসভা কমিটির দায়িত্ব ছিল তা যাচাই-বাছাই করা। মন্ত্রিসভা কমিটি কুরিয়ার সার্ভিস নয়, এখানকার কাগজ ওখানে পাঠিয়ে দিলে কর্তব্য শেষ হয়। দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক নিয়ে এই ছেলেখেলা আর কত দিন? অপাত্রে রাষ্ট্রীয় পদক দেওয়া হলে পদককেই অসম্মান করা হয় না, পদকদাতাও অসম্মানিত হন। এই কাজ পূর্বাপর সব সরকারের আমলেই হয়েছে। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালে তো এক চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেছিলেন।

এবার পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচন নিয়ে দু–একটি কথা বলতে চাই। একসময় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচনকে জনমত যাচাইয়ের মাপকাঠি ভাবা হতো। বিশেষ করে দেশের সচেতন অংশ কী ভাবে, কী চায় সেসব জানা যেত। কিন্তু সেই অবস্থা এখন নেই। সাংবাদিক ইউনিয়ন রাজনৈতিক কারণে অনেক আগেই ভাগ হয়ে গেছে। বিএমএর চেয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ও ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) বেশি প্রভাবশালী। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে এখন বিরোধী দলের সমর্থক প্যানেলের জয়ী হওয়ার সুযোগ কম। গত ১০-১১ বছরে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের ৯৯ শতাংশ সরকার-সমর্থক।

আশার কথা, আইনজীবীরা এখনো পেশাদারত্ব মেনে চলছেন। তাদের মধ্যে বিভক্তি থাকলেও বৈরিতা নেই। বিভিন্ন আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোনোটিতে সরকার-সমর্থকেরা জয়ী হয়েছেন, কোনোটিতে বিরোধীরা। আবার কোনোটির ফলাফল মিশ্র। গত বৃহস্পতিবার আইনজীবীদের সর্বোচ্চ ফোরাম সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনেও মিশ্র ফল পাওয়া গেছে। এমন সময়ে নির্বাচনটি হলো যখন বিভিন্ন মামলা নিয়ে আদালতপাড়া সরগরম। ফলে সারা দেশের মানুষেরই কৌতূহল ছিল। ফলাফল প্রমাণ করে শুধু রাজনৈতিক পরিচয় জয় এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তাও থাকতে হয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থক সাদা প্যানেল থেকে এ এম আমিন উদ্দিন পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। অন্য দিকে সম্পাদক হয়েছেন বিএনপি-সমর্থক নীল প্যানেলের রুহুল কুদ্দুস। ১৪টি পদের মধ্যে সভাপতিসহ ৬টি পদে সরকার-সমর্থক এবং ৮টি পদে বিএনপি-সমর্থকেরা পেয়েছেন।

এর আগে গত নির্বাচনে (২০১৮-১৯) সভাপতি, সম্পাদক পদসহ ১০টি পদে নীল প্যানেল–সমর্থিত প্রার্থী এবং সহসম্পাদকের ১টি পদসহ ৪টি পদে জয়ী হয়েছিলেন সাদা প্যানেলের প্রার্থীরা। এর আগের বারের নির্বাচনে (২০১৭-১৮) সভাপতি, সম্পাদকসহ ৮টি পদে নীল প্যানেলের প্রার্থী এবং সহসভাপতি, সহসম্পাদক, কোষাধ্যক্ষসহ ৬টি পদে জয়ী হয়েছিলেন সাদা প্যানেল–সমর্থিত প্রার্থীরা। তার আগের (২০১৬-১৭) নির্বাচনে সভাপতিসহ ৮টি পদে জয়ী হন সাদা প্যানেলের প্রার্থীরা এবং সম্পাদকসহ ৬টি পদে জয় পান নীল প্যানেলের প্রার্থীরা। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির গত চার নির্বাচনে কোনো পক্ষ একতরফা জয় পায়নি। দুই পক্ষের মধ্যে পদ ভাগাভাগি হয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি পেশাগত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করে আসছে। তাদের কোনো নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠেনি। প্রশ্ন হলো আইনজীবীরা সুষ্ঠু নির্বাচনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে জাতীয় নির্বাচনে কেন তার প্রতিফলন দেখছি না? পেশাজীবীরা নিজ নিজ সংগঠনের নির্বাচন পরিচালনা করেন। আর জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করে ‘স্বাধীন’ নির্বাচন কমিশন। পেশাজীবীরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারলে নির্বাচন কমিশন কেন পারবে না?

১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের সূচনা হতে যাচ্ছে। নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে মুজিব বর্ষ উদ্‌যাপিত হবে। দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা আশা করতে চাই, মুজিব বর্ষে এবং পরবর্তী সব নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। অতীতের নির্বাচনগুলোর মতো বিতর্ক হবে না। আমাদের নির্বাচন দেখে বিদেশিরাও হাসি–ঠাট্টা করবে না।

যে নেতা বাঙালির অধিকার আদায় এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন লড়াই করেছেন, আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করাই হবে তাঁর প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো।

কে এম নূরুল হুদা কমিশন কী বলবে?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]