ইউরোপ সীমান্তে আবার শরণার্থীদের ভিড়

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

গ্রিস–তুরস্ক সীমান্তে প্রায় ১৩ হাজার শরণার্থী মানবেতর জীবন যাপন করছে। প্রায় ৯ বছর আগে শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং নতুন করে বিবদমান দেশগুলোর মধ্যে গৃহযুদ্ধের উত্তাপ বাড়ার পর আবার সিরিয়ার মানুষ ঘর ছাড়ছে। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সর্বশেষ ঘাঁটি ইদলিবে প্রেসিডেন্ট আসাদের মিত্রপক্ষ রুশ বিমান আক্রমণে তুরস্কের বেশ কিছু সেনা নিহত হলে তুরস্কের সেনাবাহিনী বেশ আক্রমণাত্মক হয়ে পড়ে। ফলে সেখান থেকে শরণার্থীরা আবারও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে থাকে। 

ইউরোপীয় দেশগুলোতে ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে শরণার্থীদের ঢল নামার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের প্রচেষ্টায় ইউরোপে শরণার্থীদের ঢল ঠেকাতে তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। ২০১৬ সালের ১৮ মার্চ ইইউ ও তুরস্কের মধ্যে স্বাক্ষরিত শরণার্থীবিষয়ক এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপ অভিমুখে শরণার্থীদের ঢল ঠেকানো। সে জন্য তুরস্কে অবস্থানকারী শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য ইইউ তুরস্ককে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করবে। সেই চুক্তির সময় তুরস্কে ছিল প্রায় ২০ লাখ শরণার্থী। পরে তাদের একটা বড় অংশ ইউরোপে পাড়ি জমায়। সর্বশেষ তুরস্ক–সিরিয়া সীমান্ত–সংলগ্ন ইদলিবে যুদ্ধ শুরু হলে তুরস্ক চুক্তি থেকে সরে এসে ইউরোপমুখী সীমান্ত শরণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। সেই সুযোগে সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষারত ১৩ হাজার শরণার্থী গ্রিসের সীমান্তে হাজির হয়।

বিগত বছরগুলোতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বারবার এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন। কারণ, ইইউ তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তুরস্কে অবস্থানরত সিরিয়ার শরণার্থীদের বৈধ পথে ইউরোপ যাওয়ার সুযোগ তেমন রাখেনি। পাশাপাশি তুরস্কের নাগরিকদের জন্য ইইউ দেশগুলোতে ভিসা প্রথা তুলে নেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করেনি। দ্বিতীয়ত, উদার শরণার্থী নীতি থেকে সরে আসতে তুরস্কের সরকারের ওপর দেশটির জনগণের চাপ ক্রমে বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া তুরস্কে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে শরণার্থীদের সংঘর্ষ হয়েছে। তৃতীয়ত, ইদলিবে নতুন করে হানাহানি শুরু হওয়াতে সিরিয়া ও তুরস্কের সীমান্তে কয়েক লাখ শরণার্থী আটকা পড়েছে। তুরস্ক আর নতুন করে সিরীয় শরণার্থী নিতে চাইছে না, তাই তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে।

এ মুহূর্তে তুরস্কে প্রায় ৩৬ লাখ সিরিয়ার শরণার্থী অবস্থান করছে। দেশটি তাদের নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের মুখে শরণার্থীরা দেশটির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান জোসেফ ব্যারেল বলেছেন, তুরস্ক সম্প্রতি শরণার্থীদের জন্য ইউরোপমুখী সীমান্ত খুলে দিয়ে ইইউর সঙ্গে করা শরণার্থী চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভারসগুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বর্তমানের এই সংকটে ইইউ জোট ১৭০ মিলিয়ন ইউরো বাড়তি সহযোগিতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। জার্মানির চ্যান্সেলর গ্রিস–তুরস্ক সীমান্তে মানবেতরভাবে অবস্থানকারী শরণার্থী ও তাদের জন্য আন্তর্জাতিক সুরক্ষা অঞ্চল গঠনের বিষয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে কথা বলেছেন।

পাঁচ বছর আগে সিরিয়ার শরণার্থীদের বিষয়ে ইউরোপের অনেক দেশের যে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা গিয়েছিল, সাম্প্রতিক কালের ঘটনায় তা আর দেখা যাচ্ছে না। তবে জার্মানি, ফ্রান্স, লুক্সেমবার্গ ও ফিনল্যান্ড সিরিয়ার অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শরণার্থীদের নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। তুরস্কে অবস্থানরত সিরিয়ার শরণার্থীদের ইউরোপে প্রবেশে বাধা দেওয়ার ব্যাপারে ইউরোপের প্রায় সব দেশই এককাট্টা। তবে তুরস্কে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রয়ের বিষয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো, যেমন নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানি একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে। শুধু জার্মানিই গত বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত তুরস্কের কাছে ১৮০ মিলিয়ন ইউরোর যুদ্ধাস্ত্র বিক্রয় করেছে। ২০১৪ সালে ইউরোপে শরণার্থীদের ঢল শুরু হওয়ার পর থেকে দেশে দেশে দক্ষিণপন্থী কট্টরবাদী দলগুলোর প্রভাব বেড়েছে, কিন্তু তাদের মুখেও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে অস্ত্র বিক্রয়ের বিষয়ে কোনো কথা নেই। ইউরোপের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী সামাজিক কল্যাণবাদী দলগুলোও শরণার্থীদের নেওয়ার বিষয়ে দক্ষিণপন্থীদের হুমকি ও জনপ্রিয়তা হারানোর বিষয়ে তটস্থ হয়ে আছে। দুঃখের বিষয়, ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব বোধে আবদ্ধ ইসলামি দেশ বা সংস্থাগুলোর মুখে এ বিষয়ে কোনো কথা নেই। শরণার্থীদের নিয়ে ইউরোপীয় সীমান্তে যে নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, অচিরেই তার অবসান ঘটানো জরুরি।

সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
[email protected]