শিগগির মুক্তি নেই মহামারি থেকে

ইরানে করোনায় প্রাণহানি ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ছবি: রয়টার্স
ইরানে করোনায় প্রাণহানি ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ছবি: রয়টার্স

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রেকর্ডে গত বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কথা প্রথম জানা গিয়েছিল। সেই হিসাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চীনের সময় লেগেছে দুই মাসের বেশি। সেটাও সম্ভব হয়েছে কর্তৃত্ববাদী শাসনের কঠোর বিধিবিধান এবং তা প্রয়োগের মাধ্যমে। ইউরোপে এর সূত্রপাত গত মাসে এবং সংস্থার প্রধানের ভাষায়, এই সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল এখন ইউরোপ। পুরো ইউরোপেই এটি ছড়িয়ে পড়ছে এবং বিশেষজ্ঞদের কথা ও সরকারগুলোর গৃহীত নানা পদক্ষেপে ইঙ্গিত মিলছে, শিগগিরই এই রোগ থেকে মুক্তি নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, কত দীর্ঘায়িত হবে এই বৈশ্বিক মহামারি।

করোনাভাইরাস বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশে বিপজ্জনক মাত্রায় বিস্তৃত হতে শুরু করার পরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ফেব্রুয়ারি মাসে এই রোগের সংক্রমণকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করেনি। অথচ ফেব্রুয়ারির শেষার্ধে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এ রকম ঘোষণা প্রত্যাশা করেছিলেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সংস্থার তরফ থেকে বলা হয়েছিল, বৈশ্বিক মহামারির সম্ভাব্যতা থাকলেও সংক্রমণ দমন করা যাচ্ছে না, এমনটি মনে হচ্ছে না। তখন এমন কথাও বলা হয়েছিল যে অসতর্কভাবে বৈশ্বিক মহামারি বা প্যান্ডেমিক পরিভাষা ব্যবহার করায় কোনো সুফল নেই, বরং এতে অপ্রয়োজনীয় ভীতি ছড়ানো এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের কলুষিত করার মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থাটাই স্থবির হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়বে। বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ দাবি করেছে যে ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু মাত্র ২৬টি দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করে সমালোচিত হওয়ার কারণে এবার সংক্রমণের মাত্রা ও ভয়াবহতা আরও বেশি হলেও তারা একটু বেশি রক্ষণশীল অবস্থান নিয়েছে।

ফ্রান্সে দ্রুত করোনায় আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। ছবি: রয়টার্স
ফ্রান্সে দ্রুত করোনায় আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। ছবি: রয়টার্স

১১ মার্চ সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রস আধানম গেব্রেয়াসুস বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণার কারণ হিসেবে ‘করোনাভাইরাসের আতঙ্কজনক মাত্রায় বিস্তার, তার প্রাবল্য এবং এটি মোকাবিলায় নিষ্ক্রিয়তার’ কারণে সংস্থার গভীর উদ্বেগের কথা বলেন। এই ঘোষণার সময় বিশ্বে ১১৪টি দেশে করোনায় ১ লাখ ১৮ হাজার মানুষ সংক্রমণের শিকার হয়েছে। তখন তিনি বলেন, যেসব দেশে এই রোগ ছড়িয়েছে, সেসব দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। কিছু কিছু দেশ সামর্থ্যের ঘাটতির কারণে সমস্যায় পড়েছে, কিছু দেশে সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে, আর কিছু দেশের ইচ্ছা বা অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে।

অঙ্গীকারের ঘাটতি বা ইচ্ছাহীনতার নজির নিয়ে পাশ্চাত্যে রাজনৈতিক বিতর্কের শেষ নেই। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুরুর দিকের প্রতিক্রিয়া ও পদক্ষেপগুলো ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। বিজ্ঞানকে উপেক্ষাকারী এবং অতি আত্মবিশ্বাসী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য শেষ পর্যন্ত শুক্রবার রাতে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশেও সরকারের বিরুদ্ধে প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করেছে বিএনপি। সম্ভাব্য বিপদের বিষয়টি এখন মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছেন এবং কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় সবকিছু করা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এবং একধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ক্রমেই প্রকট হচ্ছে।

সম্পদের সীমাবদ্ধতা আমাদের মতো দেশগুলোতে অজানা কিছু নয়। তবে যেখানে মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন জড়িত, সেখানে প্রয়োজনীয় সম্পদের ব্যবস্থা করা যে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত, সে বিষয়ে তেমন কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। করোনার সংক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রীর ব্যবস্থা করা ছাড়াও এই মহামারি জনজীবন ও অর্থনীতিতে যে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তাতে অনেক বড় অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হবে। উন্নত দেশগুলো শুধু চিকিৎসাব্যবস্থার জন্যই কয়েক শ কোটি ডলার বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে। আর অর্থবাজারকে রক্ষা ও অর্থনীতিকে সচল রাখতে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে, তা আলাদাভাবে আলোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশ সরকার করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতের জন্য ইতিমধ্যে যে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা ঘোষণা করেছে, তাতে এই মহামারি মোকাবিলার চ্যালেঞ্জের ব্যাপকতার কোনো আঁচ পাওয়া যায় না।

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে কুয়েত। ছবি: রয়টার্স
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে কুয়েত। ছবি: রয়টার্স

তৃতীয় যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে তা হলো, সক্ষমতা বা সামর্থ্যের ঘাটতি। চীনের অভিজ্ঞতা বিচার-বিশ্লেষণ করে সংক্রমণ বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন যে সংক্রমণ হঠাৎ চরমে পৌঁছালে তা সামাল দেওয়া অসম্ভব এবং তার পরিণতি হচ্ছে উচ্চ হারে মৃত্যু। অধিকাংশ সংক্রমিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে রোগটি বড় ধরনের কোনো সমস্যা তৈরি করছে না। কিন্তু যাদের আগে থেকেই বিভিন্ন রোগ আছে, তারা এই সংক্রমণের শিকার হলে তা গুরুতর রূপ নিচ্ছে। তাদের প্রয়োজন হচ্ছে সংকটকালীন জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসাসেবা, যাকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। এতে ভেন্টিলেটরের মতো যন্ত্রের সহায়তায় কৃত্রিমভাবে শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা প্রয়োজন হয়। একই সঙ্গে রোগীর রক্তচাপ, হৃদ্‌যন্ত্রের গতিবিধি—এসবের ওপর নজর রাখার প্রশ্নও রয়েছে। এই ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ব্যবস্থা কোনো দেশেই বড় আকারে থাকে না। ইতালির যে অঞ্চলে এই প্রকোপ সবচেয়ে বেশি, সেখানে গড়ে প্রতি এক হাজারে ছয়জনের চেয়ে একটু বেশি এই ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু হঠাৎ যে হারে বয়স্ক রোগীর চাপ তৈরি হয়েছে, তা সামাল দেওয়ার সক্ষমতা তাদের নেই। ফলে মৃত্যুর হার চীনের পর ইতালিতে সবচেয়ে বেশি।

যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থার একটা দীর্ঘদিনের সুনাম থাকলেও এই ক্রিটিক্যাল কেয়ারের সামর্থ্য ইতালির চেয়ে কম। ফলে যুক্তরাজ্যে সরকারি কৌশলে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে সংক্রমণের প্রকোপটা কতটা পেছানো বা বিলম্বিত করা যায়। তাদের বিশ্বাস, একটু বেশি সময় ধরে প্রকোপ চললে তাতে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব হবে। যেসব দেশে সংক্রমণের গতি শ্লথ করা গেছে, সেসব দেশে মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে কম বলেই প্রমাণ মিলেছে। এই সংক্রমণ বিলম্বিত করায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সংক্রমিত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তাকে অন্যদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা। যাদের সন্দেহ হবে, তাদেরও আলাদা করা। এই সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণ বা সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং যেহেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, সেহেতু বড় ধরনের সব জমায়েত বন্ধ রাখার প্রশ্ন আসে। এখন ফুটবল, রাগবির মতো বড় বড় আয়োজন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখারও দাবি উঠেছে। তবে বাচ্চাদের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি কম থাকায় এখনই সরকার তা করছে না। ব্রিটিশ সরকারের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা অবশ্য বলেছেন, এই সংকট নিয়ন্ত্রণে ১২ থেকে ১৬ সপ্তাহের মতো সময় লাগতে পারে। এ কারণে মে মাসে অনুষ্ঠেয় লন্ডনের মেয়র নির্বাচন এক বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।

জার্মান সরকারের আশঙ্কা, দেশটির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ নাগরিক এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। ছবি: রয়টার্স
জার্মান সরকারের আশঙ্কা, দেশটির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ নাগরিক এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। ছবি: রয়টার্স

ক্রিটিক্যাল কেয়ারে শুধু যে বিশেষায়িত চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রয়োজন, তা-ই নয়, প্রয়োজন বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসাকর্মী বা নার্স। প্রশ্ন হচ্ছে, উন্নত দেশগুলোতে যে বিশেষায়িত সক্ষমতা বা সামর্থ্যের ঘাটতি আছে, সেই সামর্থ্য কি আমাদের আছে? হাজারের বেশি সংখ্যায় বিদেশ প্রত্যাগতকে স্বেচ্ছা আইসোলেশনে রাখা হলেও নতুন কোনো রোগীর সন্ধান মেলেনি—এই তথ্য আপাতদৃশ্যে স্বস্তিদায়ক। কিন্তু সংক্রমণ চিহ্নিত করার সীমাবদ্ধতা এই সংখ্যা এত কম হওয়ার কারণ কি না, তা স্পষ্ট নয়। এ পর্যন্ত দেশে কতজনের রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে, সেই তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে এই রক্ত পরীক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকার বিষয় ঘিরেই কয়েক সপ্তাহ ধরে তুমুল বিতর্ক হয়েছে। যুক্তরাজ্যে যেদিন চিহ্নিত সংক্রমিতের সংখ্যা ছিল ৪৯৬, সেদিন প্রধানমন্ত্রী জনসন বললেন, প্রকৃত সংক্রমিতের সংখ্যা ১০ হাজারও হতে পারে।

সংক্রমণের ঝুঁকি মোকাবিলায় জেলায় জেলায় আইসোলেশন ইউনিট হচ্ছে বলে খবর বেরিয়েছে। সম্ভাব্য বিপদ মোকাবিলার প্রস্তুতিতে এটা একটা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। তবে সেই আইসোলেশন ইউনিটের চিকিৎসাকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে না বলেও খবর বেরিয়েছে। ক্রিটিক্যাল কেয়ারের প্রস্তুতিতেও এই পিপিই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

সংক্রমণ এখনো উল্লেখ করার মতো মাত্রায় পৌঁছেনি বলে আমরা পার পেয়ে যাব, এমন আত্মবিশ্বাস বাস্তবসম্মত নয়। তারপর এই বৈশ্বিক মহামারির স্থায়িত্ব যতটা দীর্ঘায়িত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তাতে কোনো দেশের পক্ষেই করোনাকে দূরে ঠেলে রাখা সম্ভব নয়। ইতিমধ্যেই যাঁরা হাঁপিয়ে উঠেছেন, তাঁদের জন্য মহামারি দীর্ঘায়িত হওয়ার আভাস দুঃসংবাদই বটে।

যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক শ। ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক শ। ছবি: রয়টার্স