বিশ্ব অর্থনীতি একটা মন্দায় পড়ে যাবে

ড. জাহিদ হোসেন।
ড. জাহিদ হোসেন।
>

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, ব্যাংক খাতের দুরবস্থা ও করোনাভাইরাসের মহামারির সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন কেমন দেখছেন?

জাহিদ হোসেন: অর্থনৈতিক অবস্থা যাচাইয়ের জন্য যে সূচককে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বা চূড়ান্ত হিসেবে ধরা হয়, সেটা হলো উৎপাদন ও ব্যয়ের অবস্থা। মানে প্রবৃদ্ধির অবস্থাটা কী। কিন্তু আমরা বছর চলাকালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে সরাসরি কোনো তথ্য পাই না; যেমন অন্য অনেক দেশে পাওয়া যায়। যেমন ভারতে, শ্রীলঙ্কায় প্রতি প্রান্তিকের হিসাব পাওয়া যায়। আমাদের দেশে সেই ব্যবস্থা নেই; কাজেই আমাদের নির্ভর করতে হয় জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত সূচকগুলোর ওপর সেগুলোর প্রবণতার ওপর। তা-ও খুব বেশি সংখ্যক সূচক যে আছে, তা নয়।

প্রথম আলো: চলতি অর্থবছরে সেই সূচকগুলো কেমন?

জাহিদ হোসেন: বাণিজ্য দিয়ে যদি শুরু করি, এখানে রপ্তানি একটা বড় খাত। সেখানে বছরের শুরু থেকেই একটা নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি কমেছে। তারপর আপনি যদি বিনিয়োগ দেখেন, সেখানেও প্রবণতা নেতিবাচক। যেসব সরাসরি তথ্যের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান ব্যুরো বিনিয়োগের হিসাব করে, সেগুলো হচ্ছে যন্ত্রপাতির অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং বিদেশ থেকে আমদানি। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন খুব বেশি নয়, আমাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির বেশির ভাগই আসে দেশের বাইরে থেকে। এসব যন্ত্রপাতি অর্থাৎ ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানিও আগের অর্থবছরের তুলনায় নেতিবাচক। অর্থাৎ বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও একটা দুর্বল পরিস্থিতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তৃতীয়ত হলো ব্যক্তি খাতের ভোক্তা ব্যয়, এটা আমাদের জিডিপির সবচেয়ে বড় অংশ, প্রায় ৬৫ শতাংশ। এটা সম্পর্কে সরাসরি কোনো তথ্য নেই; তবে ভোক্তা পণ্য বিক্রি করে এমন বড় কোম্পানি, যারা শেয়ারবাজারের তালিকাভুক্ত, তাদের বিক্রি সম্পর্কিত যেসব স্টেটমেন্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে; সেখানেও দেখা যাচ্ছে যে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় তাদের বিক্রি কমে গেছে। এর সঙ্গে যদি ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ধরা হয়, সেখানে দোকানের সংখ্যা, ক্রেতার সংখ্যা, বিক্রির পরিমাণ ইত্যাদি নিয়ে মেলার শেষে যে তথ্যগুলো বেরিয়েছে, সেখানেও দেখা যাচ্ছে যে আগের বছরের তুলনায় ক্রেতার সংখ্যাও কম ছিল, বিক্রির পরিমাণও কমে গেছে। ভোক্তা ব্যয়ের ক্ষেত্রে দুর্বলতার এটাও একটা লক্ষণ।

প্রথম আলো: সব খাতে সূচক এভাবে কমার প্রবণতার কারণ কী?

জাহিদ হোসেন: ভোক্তা ব্যয় বাড়ারও কিছু উপাদান আমরা লক্ষ করেছি। যেমন প্রবাসী আয়। ইদানীংকালে, অর্থাৎ ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি বেশ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে। তারপর একটু কমলেও এখনো ২০ শতাংশের ওপরে আছে।

প্রথম আলো: এটার কারণ কী?

জাহিদ হোসেন: কী কারণে বেড়েছে সে বিশ্লেষণ অন্য বিষয়, কিন্তু এটা ভোক্তা ব্যয়ের, বিশেষ করে গ্রামের অর্থনীতিতে ভোক্তা ব্যয়ের একটা বড় ধরনের ভিত্তি। তাহলে যদিও কিছু কিছু লক্ষণ আছে যে ভোক্তা ব্যয় এখন আগের মতো শক্তিশালী নেই, তবে প্রবাসী আয় বাড়ার কারণে মনে হচ্ছে যে তা হয়তো অতটা দুর্বল নয়। তাহলে, রপ্তানি কমার ফলে এই খাতের লোকজনের আয় কমে যাওয়ার কারণে ভোক্তা ব্যয়ের ওপরে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা, প্রবাসী আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে হয়তো সেটার কিছুটা ক্ষতিপূরণ হচ্ছে। আবার ধরেন, কৃষিতে উৎপাদনে বাম্পার ফলন আবার আগের মতো হচ্ছে; ফলে এই খাতে আয় না বাড়লেও খুব বেশি কমেনি। অর্থাৎ, রপ্তানি ও বিনিয়োগ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্তদের আয় হয়তো কমেছে; কিন্তু প্রবাসী আয় ও কৃষির ওপর যাঁরা নির্ভরশীল, তাঁদের আয় কমার কোনো লক্ষণ নেই। প্রবৃদ্ধির তিনটা উৎসের মধ্যে রপ্তানি ও বিনিয়োগ—এই দুই খাতে আমরা নেতিবাচক লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি; কিন্তু ভোক্তা ব্যয়ের ক্ষেত্রে সঠিক অবস্থাটা কী তা বলা মুশকিল, তবে সম্ভবত অতটা নেতিবাচক নয়। আমাদের প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তির মধ্যে হলো রপ্তানি ও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ; সেদিকে যেহেতু দুর্বলতা আছে, তাই আমাদের প্রবৃদ্ধি যে আগের তুলনায় দুর্বল হয়েছে, এটা অন্যান্য সূচকের ভিত্তিতেও মোটামুটি বলা যায়।

প্রথম আলো: রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণ কী?

জাহিদ হোসেন: চীন ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে যে ট্রেড ডাইভারশন হয়েছে, তার কিছু সুফল আমরা গত বছর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখেছি। তার আগের বছরের তুলনায় রপ্তানি বেশি হয়েছিল। চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে আমেরিকান ক্রেতারা যেসব পণ্য চীন থেকে কিনত, এখন সেগুলো অন্যান্য দেশ থেকে কিনছে, সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। আশা করা হয়েছিল যে এটা চলবে। কিন্তু এ বছর দেখা যাচ্ছে যে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি তো নেই-ই, বরং তা নেতিবাচক। তার মানে, চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে যে ট্রেড ডাইভারশন ঘটেছে, সেটার ভাগ পাওয়া আমরা ধরে রাখতে পারিনি; ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দেশ যেভাবে পেরেছে।

আমাদের রপ্তানি কমার এটা একটা কারণ। আর একটা কারণ হলো, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য দুর্বল হয়েছে; ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অর্থনীতিগুলোতে মন্দার ভাব দেখা গেছে। বিশেষ করে জার্মানি, ফ্রান্সের মতো বড় অর্থনীতির দেশ, যেখানে আমাদের রপ্তানিপণ্যের বড় উপস্থিতি আছে, সেখানে চাহিদার দুর্বলতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

প্রথম আলো: চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল আমরা কেন ধরে রাখতে পারলাম না? ভিয়েতনামসহ অন্যরা কেন পারছে?

জাহিদ হোসেন: একটা কারণ হতে পারে, ট্রেড ডাইভারশনের ফলে বিকল্প রপ্তানিকারক হিসেবে ক্রেতারা আমাদের ঠিক আস্থায় নিতে পারছে না, বা স্বস্তি বোধ করছে না।

প্রথম আলো: কেন?

জাহিদ হোসেন: কারণ, বিদেশি ক্রেতারা সংশয় বোধ করছে, তারা আমাদের পণ্য কিনতে চাইলে আমরা তা সময়মতো তাদের কাছে ঠিক সময়মতো সরবরাহ করতে পারব কি না, এই নিয়ে তারা একটা আস্থার সংকটে ভুগছে। আমার ধারণা, এই আস্থার সংকটের বড় কারণ দুটো। একটা হলো আমাদের বন্দরের দক্ষতার ঘাটতি; রপ্তানিপণ্য যদি আপনি আপনার ক্রেতার কাছে সময়মতো পৌঁছাতে না পারেন, তাহলে কিন্তু তাদেরও সেটা বিক্রি করতে অনেক কষ্ট পেতে হয়। দ্বিতীয় কারণটা, আমরা ক্রেতাদের কাছ থেকে যেমনটা শুনেছি, ধরেন আমি আপনাকে একটা পণ্যের অর্ডার দিলাম, আপনাকে তো সেই পণ্য তৈরির জন্য উপাদানগুলো কিনতে হবে, শ্রমিকদের মজুরি দিতে হবে, বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ খরচ ইত্যাদি দিতে হবে। এসবের জন্য তো আপনার অর্থায়নের প্রয়োজন। সেটা আপনি কীভাবে পাবেন, ঠিকমতো পাবেন কি না—এটা তাদের একটা সংশয়। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অবস্থা ভালো নয়, এই খবর বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে গেছে। এখানে সবাই ঋণ পাচ্ছে না...

প্রথম আলো: এটা বিদেশিরা জানতে পেল কীভাবে?

জাহিদ হোসেন: এ বিষয়ে তো সংবাদমাধ্যমে লেখা হচ্ছে; আমাদের রপ্তানিকারকেরাও তাদের বলছেন। কেউ কেউ ক্রেতাদের কাছে এ প্রসঙ্গটা তুলছে যে আমরা আমাদের ব্যাংক খাত থেকে ঋণ পাচ্ছি না, তোমরা আমাদের অর্থায়ন করো। এমন কথা শুনেই তো তারা বলছে যে আমি যদি তোমাকে অর্থায়ন করতে না পারি, তাহলে তুমি পণ্য সরবরাহ করতে পারবে কি না। এসব কথা তো মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। তারা ভাবছে, বাংলাদেশের ছোট ছোট শিল্পকারখানা যদি ব্যাংক থেকে ঋণ না পায়, তাহলে তারা আমাদের সময়মতো পণ্য পাঠাতে পারবে কি না।

আমাদের রপ্তানি কমার আর একটা কারণ আছে, সেটা হলো মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে আমাদের টাকা অতি-মূল্যায়িত। আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো যেভাবে তাদের মুদ্রা অবমূল্যায়িত করেছে, আমরা সেভাবে পারিনি। তার ফলে আমাদের রপ্তানিকারকেরা পণ্যের দামের প্রতিযোগিতায় অন্যান্য দেশের কাছে মার খেয়েছেন। এই তিনটা বড় কারণে আমরা রপ্তানি খাতে আমাদের আগের অবস্থানটা ধরে রাখতে পারিনি। যেমন আমেরিকার তৈরি পোশাকের বাজারে আমাদের যে দ্বিতীয় অবস্থান ছিল, সেখানে এখন ভিয়েতনাম চলে গেছে। আমরা এখন তৃতীয় অবস্থানে চলে গেছি। যদিও আমাদের দেশে শ্রম তুলনামূলকভাবে সস্তা, তবু আমরা সার্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছি মূলত তিনটা কারণে, যেগুলোর কথা এতক্ষণ বললাম।

প্রথম আলো: আমাদের বিনিয়োগ কমার কারণগুলো কী?

জাহিদ হোসেন: আমাদের ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কয়েক বছর ধরে ২২ থেকে ২৩–এর মধ্যে স্থবির হয়ে আছে। একটু বাড়ে, একটু কমে। জিডিপির অনুপাতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ স্থবির। এর একটা বড় কারণ কাঠামোগত সমস্যা। আপনি যদি ব্যবসায়িক পরিবেশের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দেখেন, তাহলে গত বছর আমাদের আট ধাপ উন্নতি হওয়ার পরও ১৯০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৬৮তে। তার মানে ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৬৭টি দেশই ব্যবসায়িক পরিবেশের দিক থেকে আমাদের ওপরে আছে। বিনিয়োগ মানে হলো আপনি হয় একটা নতুন ব্যবসা শুরু করবেন, অথবা আপনার যে ব্যবসা ইতিমধ্যে আছে, তা সম্প্রসারণ করবেন। আপনি যা-ই করতে যান, আপনাকে একটা রেগুলেটরি প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। একেবারে নতুন কোম্পানি হলে আপনাকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে, ট্যাক্স রেজিস্ট্রেশন নিতে হবে, ইমপোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট লাগবে (বাংলাদেশে এমন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান নেই, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আমদানির ওপর নির্ভরশীল নয়); একটা কারখানা স্থাপন করতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র লাগবে। একটা নতুন ব্যবসা শুরু করতে গেলে বিভিন্ন রেগুলেটরি শর্ত পূরণ করতে আপনাকে প্রায় ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের কাছে যেতে হবে। আর কাজগুলো যে সময়মতো মসৃণভাবে সম্পন্ন হবে তা নয়। আপনাকে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বারবার ধরনা দিতে হবে। আপনার অনেক সময় ব্যয় হবে। ডুয়িং বিজনেস সূচকে যে হিসাব করা হয়, তার একটা হলো প্রক্রিয়াগুলো শেষ করতে কত সময় লাগে, আর কাগজে-কলমে, মানে অফিশিয়ালি কত ব্যয় হয়। আন অফিশিয়াল ব্যয়টা কিন্তু ধরা পড়ে না। কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস হলো অফিশিয়াল কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস। আপনি সরকারকে কত টাকা দিচ্ছেন। আপনার কিন্তু আরও খরচ আছে, সেটা আন অফিশিয়াল; সেটা খুব বড় খরচ এবং বিভিন্ন পর্যায়ের খরচ। তারপরও অফিশিয়াল হিসাবের দিক থেকেও আমরা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে প্রায় সব দেশের চেয়ে পিছিয়ে আছি। আমাদের অবস্থান বদলাবদলি হয় একমাত্র আফগানিস্তানের সঙ্গে। দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তান ছাড়া আর সব দেশ আমাদের ওপরে আছে। আর সারা বিশ্বের মধ্যে তো ১৬৮। কাজেই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রেগুলেশনের জটিলতা ও হয়রানি একটা বড় বাধা। আবার তার মানে এই নয় যে বিনিয়োগ একেবারেই হচ্ছে না। যেসব প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে শিখে ফেলেছে এই ব্যবস্থার মধ্যে কীভাবে কী করতে হবে, তারা বিনিয়োগ করছে। অনেক প্রতিষ্ঠান এই রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ম্যানেজ করার জন্যই আলাদা বিভাগ খুলেছে। কিন্তু নতুন যারা বিনিয়োগ করতে চায়, তারা তো এসব দেখেই নিরুৎসাহিত হয়ে যায়।

প্রথম আলো: আর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা?

জাহিদ হোসেন: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে এসে বিমানবন্দরেই তিন-চার ঘণ্টা ব্যয় করতে হয়। তারপর বিমানবন্দর থেকে হোটেলে পৌঁছাতে যখন আরও লম্বা সময় লেগে যায়, তখনই তাঁরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। তারপর যখন এসব জটিল রেগুলেটরি বিধিবিধানের মধ্যে পড়ে যেতে হয়, তখন তাঁরা আরও নিরুৎসাহিত হন। এভাবে বিদেশি বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হয়। আর একটা বিষয় হলো রেগুলেশন ভালো বা খারাপ যা-ই হোক না কেন, সেটাকে তো প্রেডিক্টেবল হতে হবে; স্থিতিশীল থাকতে হবে। আমি যে ব্যবসাটা করব বা করছি, তার জন্য যে বিধিবিধানগুলো আছে, আগামী পাঁচ বছরে সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এটাকে কীভাবে পরিচালনা করবে সে বিষয়ে যে নিয়মকানুন আছে, সেগুলো কী হবে, এ বিষয়ে যদি অনিশ্চয়তা থেকে যায়, তাহলে তো আমি আমার লাভ-লোকসানের হিসাব-নিকাশ ঠিকমতো করতে পারব না। সেটা করতে না পারলে আমি বিনিয়োগের সিদ্ধান্তটা নেব কীভাবে। আজকে যে নিয়ম আছে কাল সেটা হঠাৎ বদলে গেলে, যেমন আমার যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর যে শুল্কহার আজকে আছে, কালকে যদি তা হঠাৎ করে বদলে যায় তাহলে তো আমার হিসাব-নিকাশ উল্টেপাল্টে যাবে। বা ধরেন, পাঁচ বছর পরে আপনি যদি আমাকে বলেন, আমি তোমাকে এই জমিটা দিয়েছিলাম, এখন সেই জমির অর্ধেকটা আমাকে ফেরত দিতে হবে, তখন আমার কী অবস্থা হবে? আমি তো টাকা খাটিয়ে ফেলেছি। এ দেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যাতে বিনিয়োগকারীদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে এখানকার রেগুলেটরি নিয়মকানুন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। এভাবে বিনিয়োগকারীদের আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়, সেই ঘাটতি দূর করা খুব দুরূহ। কাগজে-কলমে আপনি যতই বলেন যে আমি বিনিয়োগের দুয়ার খুলে রেখেছি, আপনারা আসুন, বিনিয়োগ করুন, আমরা খুবই বিনিয়োগবান্ধব, আপনি টাকাপয়সা আনতে পারেন, ফেরত নিয়ে যেতে পারেন, কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু বিনিয়োগ করতে এসে কেউ যখন দেখতে পাবে যে আপনার কথার সঙ্গে কাজটা মিলছে না, তখন কাজটাকেই বিশ্বাস করবে, কথাকে নয়। এ ধরনের ঘটনা তো আমরা কিছু ক্ষেত্রে দেখেছি; কোরিয়ান ইপিজেডের ক্ষেত্রে দেখেছি, কিছু টেলিফোন কোম্পানির ক্ষেত্রে দেখেছি। এত বছর পরে অডিট করে আপনারা এত বড় অঙ্কের দেনা আপনারা বের করলেন! এত দিন কোথায় ছিলেন? এ ধরনের ঘটনা কিন্তু বড় বিনিয়োগকারীদের মনে একটু খোঁচা দেবে। কাজেই রেগুলেটরি পরিবেশের অনিশ্চয়তা আমাদের দেশে বিনিয়োগের পথে একটা বড় বাধা। আর একটা সমস্যা অবকাঠামোগত। বিশেষত আমাদের দেশে জমির বাজারে কোনো রকম বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।

প্রথম আলো: বিনিয়োগের জন্য অর্থায়নের যে সমস্যার কথা আপনি বলছিলেন, সেটা তো আর্থিক খাতের ওপর নির্ভরশীল। এখন এ বিষয়ে কিছু বলুন।

জাহিদ হোসেন: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অর্থায়নের সমস্যা নেই; তারা আসছে না বা আসবে ওই সব কারণে, যেগুলো বললাম। কিন্তু আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ তো খুব সামান্য। সিংহভাগ বিনিয়োগকারীই এই দেশের মানুষ। তাঁদের অর্থায়ন প্রয়োজন। আমাদের দেশে তাঁদের অর্থায়নের দুটো উৎস। একটা ব্যাংক খাত, অন্যটা শেয়ারবাজার। শেয়ারবাজার থেকে অর্থ তুলতে গেলে প্রচুর সময় লাগে; অনেক জটিলতা। সেখান থেকে বিনিয়োগের অর্থ জোগাড় করার সুযোগ খুব বেশি নেই। তাহলে থাকল আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থা। এই খাত থেকে ঋণ পেতে হলে তো এর স্বাস্থ্য ভালো থাকতে হবে। কিন্তু গত সাত মাসে ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ১০-এর নিচে নেমে গেছে।

প্রথম আলো: কেন?

জাহিদ হোসেন: তাত্ত্বিকভাবে দুটো কারণের কথা বলা যায়। একটা হলো ঋণগ্রহীতার চাহিদা নেই; আর একটা হলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ দেওয়ার সামর্থ্য নেই। চাহিদার কিছু দুর্বলতা থাকতে পারে, কারণ রপ্তানি কমে গেছে। কিন্তু ঋণ দেওয়ার সামর্থ্যের ক্ষেত্রে কী হয়েছে? প্রায় ১০০টি দেশি প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষার ভিত্তিতে আইএফসি সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে; সেখানে তারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ঋণের প্রাপ্তি। সুদের উচ্চ হারের কথাও তারা বলেনি। কোনটা তাদের বড় সমস্যা? ঋণের সুদের উচ্চ হার, না ঋণ পাওয়াটা? তারা বলছে ঋণ পাওয়াই হচ্ছে এক নম্বর সমস্যা। কারণ, ঋণের টাকাটা সময়মতো ও প্রয়োজনমতো পেলে সেটা বিনিয়োগ করে যা আয় আসবে, সেখান থেকে সুদ পরিশোধ করা যাবে। কিন্তু টাকাটা যদি না-ই পাওয়া যায়, তাহলে সুদের হার কত কম সেটা আর প্রাসঙ্গিক থাকে না। কাজেই বিনিয়োগের পথে বাধা হলে বিনিয়োগকারীরা ঋণ পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার সামর্থ্য কমে গেছে।

প্রথম আলো: কমার কারণ কী? ব্যাংকের ব্যবসাই তো ঋণ দেওয়া।

জাহিদ হোসেন: আগে যেসব কারণ ছিল, সেগুলোর মধ্যে প্রধান ছিল ঋণ দিয়ে ফেরত না পাওয়া। ব্যাংকগুলো যে টাকা বাজারে ছাড়ে, তা যদি তারা ফেরত না পায়, তাহলে তাদের সার্কুলেশন চলবে কীভাবে। চলতে পারে, যদি তাদের ডিপোজিট ক্রমাগত বাড়তে থাকে। কিন্তু ইদানীংকালে ব্যাংকগুলোর ডিপোজিট গ্রোথও কমেছে, দুর্বল হয়েছে।

প্রথম আলো: খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে এটা বোঝা গেল, কিন্তু ব্যাংকের ডিপোজিট গ্রোথ কমার কারণ কী? লোকজন কি আর ব্যাংকে টাকা রাখছে না? না রাখলে কোথায় রাখছে?

জাহিদ হোসেন: এত দিন ব্যাংকের ডিপোজিট কমার কারণ ছিল সঞ্চয়পত্রের ওপর সরকারের অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা। তা ছাড়া আমাদের প্রবাসী আয়ও দুর্বল ছিল। ব্যাংকে টাকা রাখার ব্যাপারে মানুষের আস্থাও কমে যাচ্ছিল। ফারমার্স ব্যাংকের মতো ঘটনা যখন ঘটে, তখন ব্যাংকে টাকা রাখার বিষয়ে আস্থায় চিড় ধরতে পারে। লোকজন ভাবতে পারে ব্যাংকে টাকা রাখলে বিপদ হতে পারে, তার চেয়ে বালিশের তলায় বা সিন্দুকে রাখা বেশি নিরাপদ, যদিও সেখানে টাকা উইপোকায় কাটতে পারে বা চুরি হয়ে যেতে পারে। এসব কারণে ব্যাংকের ডিপোজিট গ্রোথ কম ছিল। এই বছর দেখা যাচ্ছে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমানোর পরে ব্যাংক খাতে ডিপোজিট গ্রোথ কিছুটা বেড়েছে। আবার প্রবাসী আয়ও অনেক বেড়েছে। কিন্তু এ বছর একটা নতুন জিনিস যোগ হলো, সেটা হচ্ছে সরকার যে টাকাটা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সংগ্রহ করত, এখন সেটা নিচ্ছে ব্যাংকগুলো থেকে; শুধু তাই নয়, তার থেকে আরও অনেক বেশি টাকা সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে।

প্রথম আলো: কেন নিচ্ছে? সরকার ঋণ নিয়ে কী করছে?

জাহিদ হোসেন: ঋণ নিয়ে তার বাজেট ঘাটতিকে অর্থায়ন করছে। কারণ, সরকারের রাজস্ব আয় কমে গেছে; তার ব্যয় বেড়েছে অনেকে। কিছু চলতি ব্যয় বেড়েছে, কারণ নতুন নতুন ভর্তুকি যোগ করা হয়েছে। রপ্তানিতে ভর্তুকি; এলএনজিতে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, প্রবাসী আয়ে ভর্তুকি। কাজেই সরকারকে ব্যাংক খাত থেকে প্রচুর টাকা ঋণ নিতে হচ্ছে; এক বছরে যে টাকা নেওয়ার কথা ছিল, তা ছয় মাসের মধ্যেই নেওয়া হয়ে গেছে। ফলে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার মতো যা তারল্য আছে, সেটা চলে যাচ্ছে সরকারি খাতে। ব্যক্তি খাতে দেওয়ার জন্য আর তেমন কিছু থাকছে না। ১ এপ্রিল থেকে যখন ব্যাংকঋণের এক অঙ্কের সুদের হার কার্যকর হবে, তারপর থেকে ব্যক্তি খাতে ঋণ দেওয়া আরও কমে যাবে। ফলে বিনিয়োগ আরও কমে যেতে পারে।

প্রথম আলো: এই পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে একটা বৈশ্বিক মহামারির আকারে। আমাদের অর্থনীতিতে প্রভাবগুলো কেমন হতে পারে?

জাহিদ হোসেন: এটা যখন চীনে শুরু হলো, তখন ভাবা হয়েছিল যে আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থায় (সাপ্লাই চেইন) একটা বিঘ্ন ঘটবে। এর ফলে আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদার জন্য উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে, রপ্তানি পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। কারণ, অনেক উপাদান আমাদের চীন থেকে আমদানি করতে হয়। এ রকম সাময়িক বিঘ্ন আশঙ্কা করা হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে চীনে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমে যাচ্ছে, সেখানে কিছু কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে চীন থেকে সরবরাহ চেইনে বিঘ্নটা হয়তো খুব দীর্ঘায়িত হবে না। কিন্তু এখন তো তার চেয়েও বড় সমস্যা দেখা যাচ্ছে যে এটা ইউরোপে এবং আমেরিকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দুটো বড় বাজার ইউরোপ এবং আমেরিকা। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপের সঙ্গে আমেরিকার সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন। আমার মনে হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি একটা মন্দায় পড়ে যাবে। যদিও কিছু পলিসি রেসপন্স করা হয়েছে; ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সুদের হার কমিয়েছে; আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকও সুদের হার কিছুটা কমিয়েছে। অন্যান্য দেশে কিছু আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যেখানে মানুষ আতঙ্কিত, সেখানে আপনি সস্তায় ঋণ দিয়ে লোকজনকে তো দোকানে পাঠাতে পারবেন না। বা তারা রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে না বা প্লেনে উঠবে না। এতে ব্যবসায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের সহায়তা হবে। কিন্তু আতঙ্কের কারণে চাহিদার যে পতন ঘটেছে, সেটা না কাটলে তো অর্থনৈতিক মন্দা এড়ানো যাবে না। তা করোনাভাইরাসের কারণে যেসব ক্ষতিকর পদক্ষেপ (প্যানিক রেসপন্স) নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোও বিশ্বের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে।

প্রথম আলো: তাহলে এখন কী করণীয় বৈশ্বিক এবং আমাদের দেশীয় পরিসরে?

জাহিদ হোসেন: এখন সব দেশেরই সবচেয়ে বড় করণীয় এমন পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে না পড়ে। ইতিমধ্যে যেসব ঝুঁকি দৃশ্যমান হয়েছে, সেগুলো সর্বোচ্চ দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। এখন আমাদের নীতিনির্ধারকদের এটাই এক নম্বর অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। করোনাভাইরাস যেন আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য ডাক্তার, নার্স, ওষুধপথ্য, যন্ত্রপাতি, হাসপাতালের সরঞ্জাম, বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানিং মেশিন ইত্যাদি যা যা প্রয়োজন, সব প্রস্তুত রাখতে হবে। সচল রাখতে হবে। এ রকম জরুরি ও নাজুক পরিস্থিতিতে থার্মাল স্ক্যানিং যন্ত্র বিকল হয়ে যায়—এটা কীভাবে সম্ভব? করোনাভাইরাসের কারণে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি মোকাবিলা ও সুরক্ষাসংক্রান্ত ব্যয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে অদক্ষতা, দায়িত্বে অবহেলা, দুর্নীতি এসবের প্রতি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। দায়িত্বশীলদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর অর্থনৈতিক দিকে, আমরা অতীতে দেখেছি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি কারণে অর্থনীতির ক্ষতি হয়, ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তখন ক্ষতিগ্রস্তদের নীতি-সহায়তার প্রয়োজন হয়; কিন্তু সেটার সঙ্গে সুযোগসন্ধানীরাও যুক্ত হয়ে যায়, যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কাজেই করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে যাঁরা (ভালনারেবল), তাদের চিহ্নিত করে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের মাধ্যমে সুরক্ষা দিতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

জাহিদ হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।