সবুজ ঘাসের জন্য

জীবনানন্দ দাশের ‘ঘাস’ কবিতার কথা মনে পড়ে? ‘কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়/ পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;/ কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস—তেমনি সুঘ্রাণ—/ হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে!/ আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের এই ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো/ গেলাসে গেলাসে পান করি,/ এই ঘাসের শরীর ছানি—চোখে ঘষি,/ ঘাসের পাখনায় আমার পালক,/ ঘাসের ভিতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার/ শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।’ রূপসী বাংলার কবি আমাদের সময়ে বেঁচে থাকলে কি এ ধরনের কবিতা লিখতে পারতেন?

কংক্রিটের পার্ক

অনেক দিন পর সেদিন সদ্য সংস্কারকৃত গুলশানের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন পার্কে হাঁটতে গিয়েছিলাম। পার্কজুড়ে কংক্রিটের অনেক স্থাপনা। বৃক্ষ নিধন হয়েছে বেশ। আগের চেয়ে অনেক কম সবুজ। অথচ বিলেতে পার্কের অন্য নাম গ্রিন। আগে যেসব খোলা জায়গায় সবুজ ঘাস ছিল, সেখানে এখন পেভমেন্ট টাইলস বসেছে। কই, চারপাশে সুউচ্চ ইমারতবেষ্টিত নিউইয়র্কের বিশাল সেন্ট্রাল পার্কে তো চোখে পড়ার মতো কংক্রিটের কোনো স্থাপনা নেই। অথচ এই পার্ক কোনো প্রাকৃতিক উদ্যান নয়। আগে এখানে বসতি ছিল। স্থপতি, প্রকৌশলী ও পার্ক বিশেষজ্ঞরা মিলে পার্কটি নির্মাণ করেছেন। পার্কজুড়ে সব বয়সীদের জন্য নাগরিক সুবিধা, সবুজ ঘাস আর বনানী।

কেবল পার্কেই নয়, গুলশান ডিআইটি ২ নম্বর মার্কেটের সামনে একসময় একচিলতে সবুজ ঘাস ছিল, পাশে গাড়ি পার্কিং। এখন সেখানে কংক্রিটের খাড়া খাড়া কী যেন বসেছে। আমার অজ্ঞানতা দেখে একজন জানালেন, এগুলো সার্ফিং বোর্ড। সার্ফিং বোর্ডগুলোর ওপর এখন নির্বাচনী ও নানাবিধ পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। রীতিমতো চক্ষুশূল!

আচ্ছা, ইট, রড, সিমেন্ট ছাড়া আর কি কোনো নির্মাণসামগ্রী নেই? সবকিছু কংক্রিটের হতে হবে কেন?

সবুজ ঘাস উধাও

কেবল ঢাকা শহরেই নয়, সর্বত্রই একই অবস্থা। আগে মফস্বল শহরে, গ্রামে দেখতাম বাড়ির সামনে ফুলবাগান, পাশে সবুজ ঘাস। খেলার মাঠে সবুজ ঘাস থাকত। মানুষ বেড়েছে, বাড়িঘর দোকানপাট বাড়ছে, দেদার। ফাঁকা জায়গা নেই। ঘাস জন্মাবেই–বা কোথায়? সবুজ ঘাসের চাষ হতো গরুকে খাওয়ানোর জন্য। এখন আমরা গরুর খাদ্যাভ্যাস পাল্টেছি। ফলে সবুজ ঘাস এখন বিলুপ্তপ্রায় তৃণ।

তবে কি সবুজ ঘাস আমাদের চোখের শত্রু! এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সবুজ ঘাস দেখাতে গলফ ক্লাবে নিয়ে যেতে হবে। অথবা মিউজিয়ামে ঘাসের চাষ করতে হবে!

কত কিছুর জন্যই তো আইনি বাধ্যবাধকতা এবং আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়ে থাকে। একচিলতে সবুজ ঘাসের জন্য পার্ক, মাঠগুলোর কর্তৃপক্ষ, বাড়ির মালিকদের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা ও আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যায় না?

উপেক্ষিত শিশু ও মা

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন পার্কে নানাবিধ সুবিধা থাকলেও শিশুদের জন্য সংরক্ষিত এলাকা, দোলনা, স্লাইড—কিছুই নেই। অথচ বাইরে পার্ক মানেই স্ট্রলারে শিশু ও পেছনে ঠেলতে থাকা মা, বাবা, দাদা, দাদি, নানা, নানি বা অন্য কেউ। দিলরুবা ও আমি কতবার নাতিদের স্ট্রলারে ঠেলে পার্কে নিয়ে তাদের দোলনায় চড়িয়েছি, পার্কের অন্যান্য খেলায় মেতেছি এবং পার্কের সবুজ ঘাসে নাতিদের ও অন্য ছোট বাচ্চাদের গড়াগড়ি করতে দেখেছি। তাতেই ওদের কী আনন্দ!

এখানেও গাছের গোড়ার দিকটায় সাদা ও লাল রং করার দৃষ্টিকটু সংস্কৃতির চর্চা দেখলাম। আপনারা কি কখনো গাছকে জিজ্ঞেস করেছেন, সে সাদা চুনকাম ও লাল রঙে সাজতে চায় কি না? আমাকে, আপনাকে কি গাছ কখনো বলেছে আমরা কী পোশাক পরব বা কোন প্রসাধনী ব্যবহার করব? দয়া করে গাছকে তার নিজের সৌন্দর্যে থাকতে দিন।

কেবল আধুনিক দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার কথা না ভেবে আমাদের নগর-পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিরা যদি বিষয়, পরিবেশ এবং সব শ্রেণি ও বয়সের নাগরিকের সুবিধার কথা ভাবতেন, তাহলে এমনটি হতো না!

বুড়োদের দৌরাত্ম্য

গুলশান-বনানী-বারিধারা ত্রিবেণির পার্কগুলো সাজানো হয়েছে বুড়োদের কথা মাথায় রেখে—এমন অভিযোগ করেছেন প্রীতিভাজন ব্যারিস্টার কারিশমা জাহান। পার্কের যাবতীয় সুবিধা কেবল বুড়োদের জন্য। তাঁদের হাঁটার, জগিং করার জন্য সুপ্রশস্ত ও সুনির্মিত রাস্তা, আড্ডা জমানোর জন্য বসার জায়গা আছে, চায়ের দোকান আছে, অথচ বাচ্চাদের সাইকেল, স্কুটি চালানোর কোনো পথ নেই। এমনকি যে গানগুলো বাজানো হয়, তা–ও তাঁদের রুচিমতো। পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকের জনপ্রিয় গান। হেমন্ত, গুলাম আলী, কণিকা, সন্ধ্যার গাওয়া গান। বুড়োরা সিদ্ধান্ত নেবেন ঠিক আছে। কিন্তু তাঁরা পরবর্তী প্রজন্মের কথা, তাঁদের পছন্দ ও চাহিদার কথা কি ভাববেন না? তাঁদের স্বার্থপর বলে অভিযোগ করলে তা কি অন্যায় হবে? অভিযোগগুলো কিন্তু আমার নিজের বিরুদ্ধেও। কেননা, আমিও তো তাঁদেরই দলে!

পার্কেও বিচ্ছিন্নতা

পার্কে জায়গায় জায়গায় গোল করে চেয়ার পাতা রয়েছে গল্পগুজবের জন্য। লক্ষ করেছি, একই লোকজন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসে আলাপ করেন। সেদিন জানলাম, গ্রুপের বাইরের কেউ সেখানে স্বাগত নয়। ব্যায়ামের কয়েকটি জায়গার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তবে কি ফুটপাতের মতো পার্কও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে? এমনিতেই জেন্ট্রিফিকেশনের প্রভাবে ‘অভিজাত’ এলাকার পার্কগুলোতে সাধারণ মানুষের দেখা পাওয়া ভার। কামনা করি, পার্ক সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হোক।

কবরস্থানে পাঁচিল

বন্ধু শামিম অভিযোগ করেছে, বনানী কবরস্থানের দক্ষিণ পাশে গড়ে উঠেছে বুকসমান পাঁচিল। এর দরকার কী? দলীয় কর্মী ঠিকাদারদের টাকা দেওয়া? সব জায়গায় দেখেছি কবরস্থান থাকে খোলা উন্মুক্ত সবুজ ঘাসে ঢাকা এবং বনানীতে ঘেরা, যা দেখে ক্ষমতাদর্পী ও বিত্তশালী মানুষ সাময়িক হলেও নিজেদের অনিবার্য পরিণতির কথা ভেবে নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারে, শুধরে নিতে পারে। কবরে যাওয়ার কথা ভাবে না বলেই কি সবাই এমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে?

এয়ারপোর্ট রোডের সৌন্দর্যবর্ধন

যাত্রীমাত্রই লক্ষ করে থাকবেন, এয়ারপোর্ট রোডের ডিভাইডারে ভাঙাগড়া আর সৌন্দর্যবর্ধন চলছেই। এটা কি কেইনসিয়ান ইকোনমিকসের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী খাদে পড়া অর্থনীতিকে চাঙা করার জন্য? কেইনস বলেছিলেন, অর্থনীতি খাদে পড়লে প্রয়োজনবোধে অকারণে মাটি খুঁড়ে আবার তা ভরে ফেলতে হবে। এর ফলে চাহিদা বাড়বে, জোগান বাড়বে এবং এর ফলে অর্থনীতি চাঙা হয়ে উঠবে! তা না হলে ঢাকার এয়ারপোর্ট রোডের ডিভাইডার এতবার কেন ভাঙাগড়া হবে? আর যদি এসব করতেই হয়, গ্রামবাংলা কী দোষ করল? সেখানে এসব করা যায় না? গ্রামের মানুষের অন্তত কর্মসংস্থান হতো। গরিব মানুষ হাতে দুটো পয়সা যেত। শুনেছি পল্লি পূর্ত কার্যক্রম এখন বন্ধ হওয়ার পথে।

শুরু করেছিলাম রূপসী বাংলার কবিকে দিয়ে, শেষ করি রবীন্দ্রনাথের সভ্যতার প্রতি কবিতার প্রথম দুই লাইন দিয়ে, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,/ লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর।’ তা হয়তো আর কখনোই করা যাবে না। কিন্তু তাই বলে উন্নয়নের যূপকাষ্ঠে প্রকৃতিকে উৎসর্গ করা তো আর মেনে নেওয়া যায় না। কারণ, মনে রাখতে হবে, প্রকৃতির প্রতিশোধ বড় নির্মম! এক করোনাভাইরাসেই সারা দুনিয়া কুপোকাত!

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব ও প্রতিষ্ঠাতা সিইও ইডকল
[email protected]