করোনার দিনগুলোতে প্রেমই প্রথম সহায়

দেশে মাস্কের দাম বাড়ায় বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রছাত্রীরা মাস্ক বানিয়ে বিনা মূল্যে বিতরণ করেছে
দেশে মাস্কের দাম বাড়ায় বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রছাত্রীরা মাস্ক বানিয়ে বিনা মূল্যে বিতরণ করেছে

নোবেলজয়ী কলম্বিয়ার সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ‘কলেরার দিনগুলোতে প্রেম’ নামের তুমুল এক প্রেমকাহিনি লিখেছিলেন। জীবন নিজেই রূপকথা; মানুষ অনেক কিছুই পারে। করোনা যখন আমাদের একে অপর থেকে দূরে ঠেলছে, তখনো আমরা অন্য অনেকভাবে কাছে থাকতে পারি। দেশে মাস্কের চাহিদা বাড়ায় মাস্কের দাম বেড়ে গেলে বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রছাত্রীরা মাস্ক বানিয়ে বিনা মূল্যে বিতরণ করেছে। ঢাকার এক ফেরিওয়ালা যুবক ন্যায্য দামে একজনকে একটির বেশি মাস্ক বিক্রি না করে মওকা বুঝে দাম বাড়ানোর বিরুদ্ধে নজির তৈরি করেছেন।

ইতালিতে ঘরের মধ্যে আটকে পড়া মানুষেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রতিবেশীর তরে গান গাইছে, প্রতিবেশীর ঘরে ভালোবাসার আওয়াজ পৌঁছে দিচ্ছে। তাতে নিজের ঘরের মানুষও সহজ আনন্দ পেতে পারছে। একটা পাড়ায় কেউ যখন কাউকে ছুঁতে পারছে না, যেতে পারছে না কারও কাছে, তখন এমন অপূর্ব দৃশ্য আশা জাগায়। চীনের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে লাখো স্বেচ্ছাসেবক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উহানে জড়ো হয়ে শহরটাকে বিপদমুক্ত করেছে। যে চিকিৎসক প্রথম মানুষকে হুঁশিয়ারি জানিয়েছিলেন, যে কলাম লেখক লেখার মাধ্যমে সরকারকে সতর্ক করেছিলেন, চীন সরকার তাঁদের শাস্তি দিলেও তাঁরা মানবতার উপকার করেছেন। এ রকম দৃষ্টান্তগুলো ছড়িয়ে পড়া দরকার।

আর সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ এক হয়। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় কিংবা দাবানল-ভূমিকম্পেও মানুষ ছুটে আসে মানুষের সাহায্যে। কিন্তু করোনা সমাজবিরোধী, মেলামেশাবিরোধী। প্রত্যেক মানুষই যখন সম্ভাব্য জীবাণুবাহী; তখন এটাই বাঁচার কৌশল। আপনজন আক্রান্ত হলেও তাকে ভয় হতে পারে। তবু মা সন্তানকে ত্যাগ করবে না। বাঁচতে হলে সবার প্রতি সবার এমন ভালোবাসাই এখন জরুরি। অন্যের সুস্থতা এখন আমার নিজের, পরিবারেরও সুস্থতার শর্ত। অপরকে বাঁচালে নিজে বাঁচি—এটাই হওয়া উচিত আজকের নীতি। দুর্যোগ যেমন আমাদের সবচেয়ে খারাপটাকে বের করে আনে, তেমনি সবচেয়ে ভালোটাকেও জাগানোর এটাই সময়। করোনাকে ভয় পেয়ে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের হুমকি মনে করে তাই কোনো ফায়দা নেই। সেবার নীতি ও মানবতায় আস্থা ছাড়া এত বড় বিপদ মোকাবিলা করা যাবে না।

করোনা বয়স্কদের জন্য বেশি হুমকিজনক। কারণ, তাঁদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম। তেমনি যে রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থা দুর্বল, সেই রাষ্ট্রের মানুষ এ রোগে বেশি আক্রান্ত হবে। এটা এমন অসুখ যে বিদেশে গিয়েও চিকিৎসা করার উপায় নেই। কেউ নেবে না।

নিউইয়র্ক টাইমস-এর কলাম লেখক ডেভিড ব্রুক লিখেছেন, মহামারি সহানুভূতিকেও হত্যা করে। সমাজ চুপসে যায়। ৬০০ বছর আগে ইউরোপে কালাজ্বর বা ব্ল্যাক ডেথের সময় লেখা ইতালীয় মহাকাব্য ডেকামেরন-এ বলা হচ্ছে, কীভাবে নাগরিক নাগরিককে এড়াচ্ছে, গ্রামবাসী গ্রামবাসীকে ভয় পাচ্ছে, মা-বাবা সন্তানদের তাদের ভাগ্যের হাতে ফেলে ত্যাগ করছেন। সাধারণত মহামারির সময় লাখো মানুষের মৃত্যু হলেও পরের যুগে মানুষ এ নিয়ে আর কথা বলে না। আবার জীবন শুরু করে, যেন কিছু হয়নি। গবেষকেরা বলছেন, মানুষ মহামারির দিনগুলোর অমানবিকতার কথা মনে রাখতে চায় না। ভয়ের দশায় মানুষ যে স্বার্থপরভাবে বাঁচতে গিয়ে কত নিষ্ঠুরতা করেছে, কতজনকে একা একা মরতে দিয়েছে, সেসব পরে আর মনে করতে চায় না। কিন্তু সাহিত্যিকেরা সে সময়ের চিত্র রেখে গেছেন।

নোবেলজয়ী সাহিত্যিক হোসে সারামাগোর ব্লাইন্ডনেস বা অন্ধতা উপন্যাসে একে একে সবাই যখন ছোঁয়াচে রোগে দৃষ্টি হারাল, যখন কারও দিকে তাকানো মানেই সেই রোগের শিকার হওয়া, তখন একজন শুধু দেখছে, কীভাবে সভ্যতার ওপরের পাতলা চাদর সরে গিয়ে ভেতরের স্বার্থপর, অসামাজিক চেহারা বেরিয়ে পড়ছে। বাংলা ভাষায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় গত শতকের গোড়ার দিকের মারি ও মন্বন্তরের যে চিত্র দেখা যায়, তা আমাদের আশাবাদী করে না।

এ যেন সবার বিরুদ্ধে সবার যুদ্ধের বিভীষিকা। আমার এটা হতে পারে এবং তুমি হয়তো এই রোগ বহন করে আনছ আমার কাছে। প্রত্যেকে যেন প্রত্যেকের কাছে সন্দেহভাজন জীবাণুবাহক। আপন হাতকেও বিশ্বাস নেই। নিজের হাত নিরাপদ রাখা আর অন্যের হাত থেকে দূরে থাকা ছাড়া যেন উপায় নেই। ভয় নিজের খাদ্য নিজেই জোগায়। ভয়ের মহামারি অযুক্তির মহামারিকে পথ করে দেয়। হাজারো রকম টোটকা, ওষুধ, মিথ্যা আশ্বাস, ধর্মীয় গোঁড়ামিতে মন দেয় আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ।

বর্তমানের দিকে তাকালে কী দেখি? ইতালি থেকে মানুষ আসছে, আরও আরও দেশ থেকেও আসছে এবং আসবে—এসব তো আগাম জানা কথা। কিন্তু যে পরিবেশে তাঁদের রাখা হচ্ছে তা কতটা মানবিক? সন্তানাদি নিয়ে বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হলো কেন তাঁদের? ফেসবুকে অনেকের মধ্যে বিদেশফেরতদের প্রতি বিদ্বেষ দেখা যাচ্ছে। মাত্র কয়েকজন নিয়েই যদি সরকার ও সাধারণের এই প্রতিক্রিয়া হয়, আরও বড় পরিস্থিতিতে কেমন করে সামাল দেওয়া হবে। এদিকে মানুষ মাস্ক বা হাত ধোয়ার জীবাণুনাশক তরল খুঁজে পায় না। ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন। ইউটিউবে প্রচারকেরা ভুয়া কথাবার্তা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এসবের বিরুদ্ধে আমাদের সরকারের পদক্ষেপ কী? কীভাবে তাঁরা আসন্ন দুর্দিন মোকাবিলার চিন্তা করছেন, তা জানার অধিকার জনগণের আছে। কোনো ধরনের রাখঢাক, সত্য জানতে না দেওয়া বা ভিত্তিহীন আশ্বাস এ রকম সময়ে সমস্যাকে সংকটে পরিণত করবে। ইরান ও চীন তার উদাহরণ।

এইডস বা সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মড়ক যেমন আধুনিক জীবনের অংশ, ভাইরাসের মহামারিও আধুনিক জীবনের সঙ্গী হয়ে যাচ্ছে। করোনা গেলে ডেঙ্গু আসবে, ডেঙ্গু গেলে অন্য কিছু। আধুনিক জীবনযাত্রা, অর্থনীতি মানুষের শরীরের ও প্রকৃতির বারোটা যেভাবে বাজিয়েছে, তাতে নিত্যনতুন স্বাস্থ্যঝুঁকি আসবে। সরকার রাষ্ট্রকে যেমন যুদ্ধের জন্য তৈরি রাখে, সার্বক্ষণিক বাহিনী প্রতিপালন করে, তেমনি জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা তৈরি রাখা আজকের যুগের জন্য জরুরি। একসময়ের মহা–আতঙ্ক এইডস যেমন সয়ে এসেছে, এসবও সয়ে আসবে। তার জন্য এইডস কিংবা ডায়াবেটিস মোকাবিলার মতো স্থায়ী কার্যক্রম থাকতে হবে।

বাস্তব পরিস্থিতি জানা থাকলে ভয় কমে গিয়ে বরং দায়িত্ববোধ বাড়ে। যদি দেখি রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বশক্তি নিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলার চেষ্টা করছে, যদি দেখি জিনিসপত্রের দাম বাড়া ঠেকানো হচ্ছে; জরুরি সামগ্রী পাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, অসুস্থদের আলাদা রাখার সময় তাদের জন্য সাধ্যমতো সেবাযত্ন করা হচ্ছে; তাহলে মানুষের আস্থা বাড়ে। দিনের শেষ প্রশ্ন জাগে, এই বিশ্বায়ন, এই ডিজিটাল সভ্যতা, এই উন্নতি আমাদের কী দিল? এই বিশ্বায়ন পুঁজিকে শক্তিশালী করলেও বিশ্ববাসীকে এক করতে পারেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করেছে। কিন্তু সব রাষ্ট্রের জন্য অবশ্যমান্য বিধিবিধান তৈরি এবং তা সরকারগুলো যাতে মেনে চলতে বাধ্য হয়, সেটা নিশ্চিত করবে কে? বৈশ্বিক অর্থনীতিও পতনমুখী। এর প্রভাব আমরা সামাল দেব কীভাবে? পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে সমাজের নিচের তলার লোকজনের খাদ্য, শিশুদের পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যনিরাপত্তার কতটুকু প্রস্তুতি আমাদের আছে? সবকিছু যেমন চলেছে, তেমনই চলবে আর করোনা পোষ মানবে তা হয় না।

প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে নিজেরটাও পুড়তে পারে। তেমনি লোকালয়, সমাজ ও প্রতিবেশীর সুস্থতাই আজ আমার-তোমার সুস্থতার শর্ত। করোনার দিনগুলোতে সবার প্রতি সবার প্রেম তাই নীরোগ থাকার প্রাথমিক শর্ত। প্রাচীন বাংলা কবিতায় হাজার বছর আগের একটা আকুতি শোনা যায়। আজকের ভাষায় তা এ রকম, ‘বউ শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখিস, আবার বৃষ্টি হবে’। করোনা একসময় হার মানবে, আবার জীবন স্বাভাবিক হবে। কোয়ারেন্টিনের মধ্যেও তাই মানুষের সমাজ ও মানবিকতা বাঁচিয়ে রাখা দরকার।

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]