'নবাবজাদা' আসলে কে?

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। ফাইল ছবি
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। ফাইল ছবি

একজনের গল্প দিয়েই শুরু করি। কয়েক বছর আগের ঘটনা। ভদ্রলোক একজন বাংলাদেশি। ইউরোপের এক শহরে থাকেন। সেই শহরে কোনো এক গ্রীষ্মের বিকেলে আমার সঙ্গে তাঁর দেখা ও পরিচয়। আমি সাইকেল চালাচ্ছিলাম। পরিচিত হওয়ার পর আমাদের কথা এগোতে থাকে। নানা প্রসঙ্গে আলাপের পর কী করেন জিজ্ঞাসা করতেই দেখি একটু কাঁচুমাচু করছেন। আমি খুব বেশি চাপাচাপি করলাম না। আমরা দেশ নিয়ে কথা বলি। পরিবার নিয়ে আলাপ করি। ভদ্রলোক আগে মধ্যপ্রাচ্যে থাকতেন। সেখান থেকে দালাল ধরে ইউরোপে ঢুকেছেন। সৌদি আরবের আয় দিয়ে পরিবারের ব্যয় সংস্থান করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল। তাই জল-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে ইউরোপ গমন। দেশে স্ত্রী, দুই সন্তান ও মা-বাবার ভরণপোষণের খরচ তাঁকেই জোগাতে হয়। ছয় সদস্যের পরিবারের জোয়াল বইতে না পেরে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন ২২ বছর আগে। সেই থেকে বিদেশেই আছেন।

জীবন-যৌবনের বড় একটা সময় বিদেশ-বিভুঁইয়ে কাটিয়ে অর্জন কী? তিনি খুব বেশি শিক্ষিত না। শহুরে ভাষায় কথা বলতে পারেন না। তবে অর্জনের কথা বলতেই ঝিলিক দিয়ে ওঠে তাঁর চোখ। বলেন, ‘বাড়িতে দুইতলা দালান তুলছি। আমার সন্তান দুটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। খরচ অনেক বেশি হইলেও সন্তানদের আমি শিক্ষিত করতে চাই।’

আলাপের শেষ দিকে তিনি কী কাজ করেন বলেছিলেন। প্রচণ্ড কষ্টসাধ্য এক কাজ। প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার হাঁটতে হয়। কোনো কোনো দিন ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটারও হাঁটেন। শীত, গ্রীষ্মে কোনো বিরাম নেই। সাপ্তাহিক কোনো ছুটিও নেই। বয়স ৫০-এর কাছাকাছি। প্রতিদিন এতটা পথ হাঁটতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠেন। অবশ্য চাইলেই তিনি জিরিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু বসলেই যে আয় কমে যাবে। যত হাঁটবেন তত আয়। তাই খুব বেশি জিরিয়ে নেওয়ার ফুরসতও নেই।

এই ভদ্রলোক লাখো বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকের একজন। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় দেশে ফিরে যারা ‘নবাবজাদা’ হয়ে যান। এ রকম ভাষা ব্যবহার করা আপত্তিকর। এ রকম হাজারো নবাবজাদার ঘাম, শ্রমের বিনিময়ে পাঠানো রেমিট্যান্স নিয়েই আমাদের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা বাবুগিরি করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি মনে করে এমন মন্তব্য করলেন, বোঝা যাচ্ছে না। তিনি একজন সৎ ও সজ্জন মন্ত্রী বলেই পরিচিত। উচ্চশিক্ষিত। আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশের কোনো মন্ত্রী এ ধরনের মন্তব্য করে ফেললেও তা প্রত্যাহার করে নিতেন। হয়তো এতক্ষণে ক্ষমা প্রার্থনাও করতেন। আমরা আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ আশা করি। তবে আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে এমন নজির মেলে না।

আলোচনার শুরু করোনাভাইরাসের কারণে ইতালি থেকে দেশে যাওয়া কয়েকজন প্রবাসীকে নিয়ে। ইতালিপ্রবাসীরা কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। ঢাকার গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও দেখে যতটুকু বুঝলাম, প্রবাসীদের প্রতিবাদের ভাষা-আচরণ খুব শোভনীয় ছিল না। আমাদের রীতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে এসব আচরণ যায় না। কিন্তু এরপর যা দেখলাম, তা আরও ভয়াবহ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতালি থেকে দেশে ফেরত আসা ব্যক্তিদের মুণ্ডুপাত শুরু হয়েছে। কেউ বলছেন, তাঁদের ইতালি ফেরত পাঠানো হোক। কারও কারও অভিমত, এঁদের জন্য কি হোটেল সোনারগাঁও-শেরাটনে ব্যবস্থা করা হবে? আরও নানা কথা। অশ্রাব্য কথাও বলা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, তাঁদের হাতে-পায়ে ধরে বিদেশে পাঠানো হয়নি। কেন বিদেশ গেলেন? তাঁরা রাজসম্মান আশা করছেন নাকি।

তাঁদের কেউই হোটেল সোনারগাঁও বা শেরাটনে থাকতে চাননি। বা বিদেশে যে সেবা পান, তাও আশা করছেন না। যাঁরা বিদেশে থাকেন, তাঁরা বোঝেন ইউরোপের মতো সেবা দেওয়ার সাধ্য আমাদের দেশের নেই। তবে ন্যূনতম সহযোগিতা আশা করা খুব বেশি কিছু না। যতটুকু জানতে পেরেছি তাদের যেখানে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল তা একেবারেই মানসম্মত ছিল না। তাঁদের সঙ্গে শিশুরা ছিল। আরও অনেক অসুবিধা নিশ্চয়ই হচ্ছিল। এত মানুষকে একসঙ্গে যেভাবে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তাতে কোয়ারেন্টিন করা সম্ভব না; বরং আরও ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা থাকে। তাঁদের নিয়মিত পর্যটনের খাবার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আয়োজনের কোথাও নিশ্চয়ই ঘাটতি ছিল। বোঝাই যাচ্ছে সরকার চেষ্টা করছে, কিন্তু যাঁরা দেখভাল করবেন, তাঁরা হয়তো আরও সজাগ ও সহানুভূতিশীল হতে পারতেন।

আরেকটা জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে, করোনা মহামারিতে উদ্ভূত দুর্যোগে অভ্যস্ত হতে আরও সহনশীল হতে হবে আমাদের সবাইকে। সেবাদাতা ও সেবাগ্রহীতা উভয় পক্ষকেই। ইতালিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও গত কয়েক দিন একধরনের আতঙ্ক ও ভয়ের মধ্যে ছিলেন। তাঁদের মানসিক অবস্থাও বিবেচনায় নিতে হবে। আবার বাংলাদেশে এসে এখানকার বাস্তবতা মানিয়ে নেওয়ার মনটাও তৈরি রাখতে হবে।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

এই মুহূর্তে যাঁরা দেশে ফিরে আসবেন, তাঁদের সঙ্গে সতর্ক আচরণ করতে হবে। সবাই মিলে প্রবাসীদের বিরুদ্ধে খেপে উঠলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করবে। তবে প্রবাসী বিশেষ করে যাঁরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, তাঁদের নিয়ে বিভিন্ন সময় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। দেশে-বিদেশে সর্বত্রই। তাঁদের কামলা, টারজান পার্টি নানাভাবে অভিহিত করা হয়। এই শ্রমিকদের বড় অংশই এতটা উচ্চশিক্ষিত না। বিমানে বসে ফরম পূরণ করতে পারেন না। বিমানের চাকা ঢাকায় স্পর্শ করলেই জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেশের মাটিকে দেখার চেষ্টা করেন। হাততালি দিয়ে ওঠেন। তাঁরা নাগরিক শিক্ষিত না। দাঁত লুকিয়ে হাসতে পারেন না। শব্দ করে হাসেন। উচ্চ স্বরে কথা বলেন। একবারে মাটির ভাষায়। সাতচল্লিশের আগে বাঙাল, চাষা বলে তাঁদের সঙ্গে ঠাট্টা মশকরা হতো। এখন শ্রমিক, কামলা বলা হয়।

সেই বাঙাল, চাষা কৃষকের ছেলেরা প্রবাসে যাচ্ছেন শ্রমিক হিসেবে। তাঁদের শ্রমে-ঘামের পয়সায় জ্ঞানী-গুণীরা বিমানে চেপে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ান। সভা-সেমিনারে যান। আরও আধুনিক হওয়ার চেষ্টা করেন। ঠাট্টা-তামাশার সুযোগ পান। গেঁয়ো মনে করেন। ঠাট্টার অনেক উপাদান খুঁজে পান। লাখো শ্রমিকের ঘামের গন্ধ এই আধুনিকদের নাকে যায় না। বিমানে তাঁদের হুড়োহুড়ি দেখতে পান। কিন্তু পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছেন, তা টের পান না। এই শ্রমিকেরা কোটি কোটি মানুষকে আলোর জোগান দিচ্ছেন, তা অনেকে বুঝতে পারেন না।

দেশের অভিজাত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা ক্রমে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের নাগরিক আচরণে সেই আলামত লক্ষণীয় হয়ে উঠছে। এঁদের অনেককেই জনগণের বিপদে পাশে পাওয়া যায় না। আশার কথা হচ্ছে, এদের চ্যালেঞ্জ করে চাষা কৃষকের সন্তানেরা উঠে আসছেন। স্কুলের বাচ্চারা রাজপথ কাঁপাচ্ছে। প্রবাসী শ্রমিক, পোশাকশ্রমিকেরা দেশের অর্থনীতির ভিত গড়ে দিচ্ছেন। তাই আমরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের গল্প করতে পারি।

এই নবাবজাদারা ফি বছর দেশে হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স হিসেবে পাঠান। তাঁরা দেশে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেন না। তাঁরা বিদেশে না, দেশের ভেতরেই বেগমপাড়া তৈরি করেন। তাঁরা ব্যাংক লুট করে না। শেয়ারবাজার থেকে অর্থ লুটে নেন না। তাঁদের যাবতীয় আয় দেশে গিয়ে জমা হয়। এঁদের স্বজনেরাই বাংলাদেশ। জনগণের সেবকের চাকরি করে, পদের আরাম উপভোগ করে যাঁরা নবাবের মতো চলেন, সাধারণ প্রবাসীদের ‘নবাবজাদা’ বলা তাঁদের মুখে শোভা পায় না।

মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক