রাখাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে

আইসিজের অন্তর্বর্তী রায়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন এবং নাগরিকত্ব হরণের বিষয়ে আলোচনা না হলেও প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের ওপর নৈতিক ও মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়েছে
আইসিজের অন্তর্বর্তী রায়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন এবং নাগরিকত্ব হরণের বিষয়ে আলোচনা না হলেও প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের ওপর নৈতিক ও মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়েছে

৫ মার্চ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পিস সেন্টার (এসআইপিজি) এবং আইন অনুষদের যৌথ উদ্যোগে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। ওই সেমিনারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল, ‘পোস্ট-ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) ভারডিক্ট; জাস্টিস ফর রোহিঙ্গা’। গাম্বিয়ার উত্থাপিত অভিযোগের ভিত্তিতে ২৩ জানুয়ারি আইসিজে অন্তর্বর্তীকালীন যে আদেশ দিয়েছিলেন, তারই প্রেক্ষাপটে এই সেমিনার। এই সেমিনারের মূল বক্তা ছিলেন ম্যাকসিল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং ইন্টারন্যাশনাল আইনজীবী প্রফেসর পায়ান আখাভান। তিনি হেগের আরবিট্রেশন কোর্টেও কাজ করেন এবং বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার আরবিট্রেশনে কাজ করেছেন। এবার তিনি মিয়ানমারের বিরুদ্ধেও আইসিজের তরফ থেকে গাম্বিয়ার মামলার কৌঁসুলিদের মধ্যে একজন ছিলেন। মামলাটি ছিল রোহিঙ্গা গণহত্যা ও দেশ থেকে তাদের বিতাড়িত করার অভিযোগ। 

ওই সেমিনারের মূল বক্তা পায়ান আখাভান ওই মামলার বেশ কয়েকটি দিক তুলে ধরে বলেন, মিয়ানমারের একসময়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নেতা অং সান সু চি নিজে কোর্টে উপস্থিত হওয়ায় বোঝা যায় যে এই মামলা নিয়ে তিনি কতখানি উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি যে জোরালো বক্তব্য সেখানে তুলে ধরেছিলেন তা হচ্ছে রাখাইনে মিয়ানমার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা অভিযান চালিয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে দাঙ্গা হয়েছে। তাতে কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়। এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয়। যার এখতিয়ার এই কোর্টের নয় এবং কোনো গণহত্যা হয়নি বা গণহত্যার অভিপ্রায়ও ছিল না। এই দুটোর কোনোটিই ধোপে টেকেনি। 

আইসিজে বলেছেন, এ মামলা তাঁদের এখতিয়ারের মধ্যে রয়েছে এবং ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার মতো কোনো ঘটনা ঘটানো থেকে বিরত থাকতে হবে। যদিও চূড়ান্ত রায় আসতে কয়েক বছর লাগতে পারে, তথাপি গণহত্যা হয়েছে এমন বিষয়ই কমবেশি নিশ্চিত করা হয়েছে। এই অন্তর্বর্তী রায় অনুযায়ী প্রতি চার মাস অন্তর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতির উন্নয়নে তাদের গৃহীত পদক্ষেপের বিবরণ কোর্টে দাখিল করতে বলা হয়েছে। আইসিজের এই সিদ্ধান্ত মিয়ানমার মানতে বাধ্য। তবে মানে কি না, তা এখন দেখার বিষয়। তবে সেমিনারে প্রফেসর পায়ান বলেছেন, আইসিজের এ সিদ্ধান্ত মিয়ানমার না মানলে জোর করে মানানোর ক্ষমতা তাদের নেই। সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদে যেতে হবে। পায়ান বলেন, এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের একমত হতে হবে আর সেখানেই সমস্যা। কারণ, বঙ্গোপসাগর ও রাখাইন নিয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে নানা ভূকৌশলগত প্রতিযোগিতা ও হিসাব-নিকাশ রয়েছে। 

মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর ৭০ বছরে দেশটিতে বহু গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। বিশেষ করে কাচিন, কারেন, সান ও রাখাইনে জাতিগত দাঙ্গা লাগানো এবং সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার অনেক ঘটনা ঘটেছে। বহু কারেন এবং কাচিন গণহত্যার শিকার হয়েছে, দেশান্তরিত হয়েছে। তবে এই গোষ্ঠীগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় সামরিক বাহিনীকে সশস্ত্র পথে মোকাবিলা করে ওই সব অঞ্চলে থিতু হয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা ১৯৬২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত নিপীড়িত হলেও এমন কোনো পথ ধরতে পারেনি। পাল্টা শক্তি প্রয়োগ করে নিজেদের ন্যূনতম অধিকার রক্ষা করতে পারেনি। ২০১৭ সালের আগে কেউ তাদের নিয়ে এমনভাবে ভাবেনি। যেমনটা তারা আইসিজের মাধ্যমে পেয়েছে। 

বিগত ৭০ বছরে মিয়ানমার তথা বার্মার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনে উত্থাপিত হলেও এবারই প্রথম প্রকৃত অর্থেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। তবে এটাই শেষ নয়। আইসিজের অন্তর্বর্তী রায়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন এবং নাগরিকত্ব হরণের বিষয়ে আলোচনা না হলেও প্রথমবারের মতো নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি ও তাদের দুরবস্থা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উঠেছে। অপরদিকে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের ওপর নৈতিক ও মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়েছে। 

মিয়ানমারের নেতৃত্বদানকারী অং সান সু চির জন্য আইসিজের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। সু চি তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে বিরাট জুয়া খেলেছেন এবং এতে তিনি সফল না হওয়ায় মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনি যে সুবিধা আশা করেছিলেন, তা পাননি। সামরিক বাহিনী তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব শুধু বজায় রাখেনি বরং এনএলডির মিয়ানমারের সংবিধান সংশোধন করে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব কমানোর যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা ভেস্তে যাচ্ছে। 

তবে রাখাইন থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে আইসিজের অন্তর্বর্তীকালীন রায়ের পর অন্তত কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। দক্ষিণ এবং মধ্য রাখাইনে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের (আইডিপি) রোহিঙ্গাদের—কয়েকটি ক্যাম্প থেকে সিতওয়ে অঞ্চলের গ্রামে ফেরত নেওয়া হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থাকে সেখানে প্রবেশাধিকার এবং কিছু ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। তবে মংডু, রথিডং ও বুথিডং এলাকায় রোহিঙ্গাদের রাখার জন্য নির্মিত শিবিরগুলো খালি পড়ে রয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ওই এলাকার রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্ব ও জানমালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত ফিরে না যাওয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। 

রোহিঙ্গাদের বহিরাগত, বাঙালি আখ্যায়িত করে নির্যাতন শুরু হয়। এমনকি সন্তানদের ন্যূনতম লেখাপড়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করা হয়। বহু অবস্থাপন্ন রোহিঙ্গা বিদেশে লেখাপড়ার জন্য পাড়ি জমালেও সাধারণ গরিব আরাকান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ন্যূনতম সুবিধা তো পায়ইনি, ক্রমেই তাদের নিজ গ্রাম এবং বাড়িতে একপ্রকার আবদ্ধ রাখা হয়। অবশেষে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী হিটলারের ফাইনাল সলিউশনের একবিংশ শতাব্দীর সংস্করণ নিয়ে গণহত্যা, দেশ থেকে বিতাড়িত করা এবং নতুন আঙ্গিকে হিটলারের কায়দায় কথিত আইডিপি ক্যাম্পে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল। সে কারণেও আইসিজের অন্তর্বর্তী রায় রোহিঙ্গাদের মনে আশা জাগিয়েছে। যদিও এখনো তাদের প্রত্যাবর্তন অনিশ্চিত এবং মামলার রায় আসতে বেশ কিছু বছর লাগতে পারে। 

অপর দিকে রাখাইনে, বিশেষ করে উত্তর ও মধ্য রাখাইনে প্রতিনিয়তই মিয়ানমার বাহিনী ক্রমবর্ধমান আরাকান আর্মির আক্রমণের মুখে পড়ছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মধ্য রাখাইনে আরাকানের পুরোনো রাজধানী মার্কইউ অঞ্চলে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তুমুল লড়াই হয়। তথ্যমতে, ওই লড়াইয়ে সামরিক বাহিনীকে অ্যাটাক হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে হয়েছে। দুই পক্ষের মাঝখানে পড়ে পাঁচ রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষ সংবাদদাতাদের মতে, উভয় পক্ষ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের সংঘাতে রোহিঙ্গাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এই পরিস্থিতিতে নতুন ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়েছে উত্তর ও মধ্য রাখাইনে ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা। 

বিভিন্ন সূত্রের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ছাড়াও আরাকান আর্মির প্রধান লক্ষ্য এখন ভারতের অর্থায়নে পরিচালিত ‘কালাদান প্রকল্প’। চাঁদাবাজি, অপহরণ আর মাদকের চালানের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ক্রমেই কলেবর বাড়ছে আরাকান আর্মির। রাখাইনের বৌদ্ধ তরুণেরা যোগ দিয়েছে আরাকান আর্মিতে। এই পরিস্থিতিতে রাখাইন বৌদ্ধরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের হাতে। ৩০ থেকে ৪০ হাজার গ্রামবাসীকে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। কাচিনদের পূর্ণ সহযোগিতায় ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করছে আরাকান আর্মি। তবে উত্তর আরাকানে মিজোরাম–সংলগ্ন অঞ্চলে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ভারতের বাহিনী তৎপর রয়েছে। মিয়ানমারের সহযোগিতায় তারা কাজটি করছে। লক্ষণীয় হলো আরাকান আর্মি সিতওয়ে শহরের দক্ষিণে যেখানে চীনের ‘বেল্ট রোড প্রজেক্ট’ এলাকা সেই অঞ্চলে এখন পর্যন্ত কোনো হামলা করেনি, যদিও সিতওয়ে অঞ্চলে প্রচুর সমর্থক রয়েছে বলে আরাকান আর্মির দাবি। 

রাখাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি যে ভালো নয়, তা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জন্য সহায়ক হতে পারে। কারণ, তারা সেখানকার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দোহাই এবং সেখানকার সহিংসতার প্রেক্ষাপটে তাদের তৎপরতাকে জায়েজ করতে সক্ষম হবে। স্মরণযোগ্য যে আইসিজে প্রাথমিক শুনানিতে এমন বক্তব্য দিয়ে গণহত্যাকে গণহত্যা না বলে ‘কো-ল্যাটারাল’ ক্ষতি বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। প্রশ্ন রেখেছিলেন যে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোর্ট কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন কি না? 

যাহোক অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে উত্তর ও মধ্য রাখাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাগমন একরকম লম্বা সময়ের জন্য অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। কবে প্রত্যাগমন হতে পারে বা প্রত্যাগমন হলেও নিরাপত্তার বিষয়টি কী হবে, এটাই এখন বড় প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্য ওই সেমিনারের প্রধান বক্তা যেমন দিতে পারেননি, তেমনি সংশ্লিষ্ট পক্ষও নিশ্চিত নয়। এসব কারণেই মনে হয়, রোহিঙ্গা সমস্যা আগামী কয়েক বছরেও সমাধানের পথে যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। 

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)