সাংবাদিক নির্যাতন: দায়মুক্তির সংস্কৃতি বজায় থাকলে এসব ঘটবেই

বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে কুড়িগ্রামে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে তাঁর বাড়ি থেকে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে ডিসি অফিসে নির্যাতন এবং কারাগারে পাঠানোর ঘটনার পর আদালত তাঁকে জামিন দিয়েছেন। এই খবর আমাদের মধ্যে সম্ভবত এই স্বস্তি দেয় যে তাঁর সৌভাগ্য, তিনি বেঁচে আছেন; অপরাধী বলে চিহ্নিত হয়ে, নির্যাতিত হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এই খবর দেখে বিচারপতি দস্তগীর হোসেনের ভাষায় অন্যদের এবং নিজেকে বলতে ইচ্ছে হয়েছে, ‘আরে রাখেন, ভাগ্য ভালো যে উনাকে গুম করেনি।’ বিচারপতি দস্তগীর এই কথা আরিফুলের বিষয়ে বলেননি, বলেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রগ্রাহক শহিদুল আলমের রিমান্ডের আবেদনবিষয়ক শুনানিতে, ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট।

‘সারা হোসেন শুনানিতে শহিদুলের রিমান্ড স্থগিতের জন্য যুক্তি দেখানোর সময় বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন বলেন, “আরে রাখেন, ভাগ্য ভালো যে উনাকে গুম করেনি”’ (বিডিনিউজ ২৪, ৭ আগস্ট ২০১৮)। যখন উচ্চ আদালতের বিচারপতিও কারও গুম হওয়া না-হওয়ার বিষয় কেবল ভাগ্যের ওপরে নির্ভর করছে বলে মন্তব্য করেন, তখন সার্বিক অবস্থাটা কী, সেটা বোঝা যায়। এটা আমাদের হাতের তথ্যও প্রমাণ করে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মোট ১৩২ জন গুম হয়ে গেছেন। এখন আরেকজন সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল ক্ষমতাসীন দলের একজন সাংসদের করা মামলার আসামি হওয়ার ১৫ ঘণ্টার মধ্যেই ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেছেন।

কুড়িগ্রামের আরিফুলের ব্যাপারে ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে বেঁচে থাকা। তিনি তাঁর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, ‘ঘরে ঢুকেই আরডিসি নাজিম উদ্দীন আমার মাথায় কিল-ঘুষি মারতে শুরু করেন। মারতে মারতে আমাকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলে চোখ-হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। এরপর আমাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে এনকাউন্টার দিতে চান। আমাকে বারবার বলেন, “আজ তোর জীবন শেষ। তুই কলেমা পড়ে ফেল, তোকে এনকাউন্টার দেওয়া হবে।”’ ডিসি অফিসে নির্যাতন চালানোর সময় তাঁকে বিবস্ত্র করা হয়েছে, ভিডিও করা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত চারটি কাগজে জোর করে সই নেওয়া হয়েছে। এনকাউন্টার, ক্রসফায়ারের গল্পগুলো যে নেহাতই গল্পগাথা, সেটা সবার জানা; জাতীয় সংসদে একজন সাংসদ ধর্ষকদের এনকাউন্টারে দেওয়ার দাবি তুলে তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন।

গত দুই বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৮৫৭ জন; গত ১০ বছরে দেশে এর শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১ হাজার ৯২১ জন। এসব হত্যাকাণ্ডের খবর মেলে ‘আইনশৃঙ্খলা’ বাহিনীর বরাতে। তুলে নিয়ে গিয়ে এনকাউন্টারে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের কথা শোনা গেছে। কিন্তু এই ঘটনা প্রমাণ করছে যে এনকাউন্টারে দেওয়া না-দেওয়া এখন সরকারের প্রশাসনের ব্যক্তিদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যে কেউ চাইলেই ‘ক্রসফায়ারে দিতে’ পারে। আর যাঁদের হাতে এই ক্ষমতা অলিখিতভাবে দীর্ঘদিন ধরেই দেওয়া আছে, তাঁরা কী করতে পারেন আর না-পারেন, তা তো প্রতিদিনই দেখি। এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে কে শিবির করেন, কার বিরুদ্ধে মামলা আছে, কে কোন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত আছেন, এই সব অজুহাত খাঁড়া করে। এসব বিষয় সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকারবিষয়ক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে; রুটিনমাফিক সরকারের তথ্যমন্ত্রী তা ‘প্রত্যাখ্যান’ করেছেন। কিন্তু আইনের শাসনের বৈশ্বিক সূচকে গত বছর বাংলাদেশের অবস্থানের যে অবনতি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের ১২৮টি দেশের মধ্যে ১১৫তম, সেই সত্য অস্বীকার করার উপায় কোথায়?

আরিফুলকে আটকের ঘটনা যে আইনের সুস্পষ্ট বরখেলাপ, তা বাংলাদেশের আইন বিষয়ে যাঁরা যৎকিঞ্চিৎ জানেন, তাঁরাই বুঝতে পারছেন। একটি নয়, একাধিক আইনের বরখেলাপের ঘটনাই ঘটেছে বলে প্রতীয়মান। ২০০৯ সালের ভ্রাম্যমাণ আদালতবিষয়ক আইন এবং ২০১৩ সালের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের বরখেলাপ স্পষ্ট। ইতিমধ্যে আদালত জানতে চেয়েছেন যে মধ্যরাতে কারও বাড়িতে যাওয়ায় যেসব বিধিনিষেধ আছে, পুলিশি অভিযানের জন্য যেতে হলে যেসব আইনি পদক্ষেপ নিতে হয়, তা মানা হয়েছে কি না। এই অভিযান কে চালিয়েছিল, সেটাও এখন স্পষ্ট নয়—ভ্রাম্যমাণ আদালত, না টাস্কফোর্স? এসবের উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু সেগুলো এই ঘটনার আদ্যোপান্ত তুলে ধরবে মনে করার কারণ নেই।

ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) সুলতানা পারভীনের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন আরিফুল ইসলাম, সেটা বিভিন্নভাবেই দেখা যায়। অন্যথায় আটকের পর নির্যাতনের সময় কেন নির্যাতনকারীরা ডিসির কাছ থেকেই জানতে চাইছিলেন, কী করা হবে? সুলতানা পারভীনকে কুড়িগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে; তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। কিন্তু এই সব বিভাগীয় মামলার পরিণতি কী হয়, সে বিষয় আমাদের জানা আছে। বড়জোর ওএসডি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্যত্র বদলি। এর বেশি ব্যবস্থা নেওয়ার পথ নির্বাহী বিভাগের পক্ষ থেকে লিখে-পড়েই বন্ধ করা আছে। সরকারি চাকরির বিধান এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে এ ধরনের অপকর্মের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেওয়া যায়। সরকারি চাকুরে বিলে এমনকি দুর্নীতি থেকে সরকারি কর্মচারীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে।

সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অত্যাচার-নিপীড়নের অভিযোগ উঠলেও তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার ফল কী হয়, তার উদাহরণ এ ঘটনায়ই আছে। আরিফুলের ওপর সেই রাতে ডিসি অফিসে যাঁরা নির্যাতন চালিয়েছেন, তাঁদের একজন, আরিফের বক্তব্য অনুযায়ী কুড়িগ্রামের বর্তমান রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দীন। তাঁর বিরুদ্ধে এই প্রথম এ ধরনের অভিযোগ উঠল, তা নয়। অতীতে একাধিকবার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, কিন্তু এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বদলির ‘শাস্তি’ ছাড়া কিছুই হয়নি (‘নাজিম যেখানেই যান, পেটান’; প্রথম আলো, ১৫ মার্চ ২০২০)। নাজিম উদ্দীনের খবর না হয় আমরা এখন জানলাম, অন্যদের খবর আর কোন ঘটনায় জানা যাবে, বা আদৌ জানা যাবে কি না, তা নিশ্চিত নয়।

আটক অবস্থায় নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের আইন আছে, বিভিন্ন সময়ে আদালতের নির্দেশনা আছে। কিন্তু এগুলোর তোয়াক্কা না করাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। হেফাজতে, রিমান্ডের নামে নিপীড়ন-নির্যাতন অব্যাহত আছে—এ নিয়ে সরকারের কোনো রকম
অস্বস্তি পর্যন্ত নেই। যখন আরিফুলকে আটক এবং তাঁকে দণ্ড দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে, সে সময়েই চুয়াডাঙ্গায় জাহিদ হাসানের পরিবার অভিযোগ করেছে যে পুলিশি হেফাজতে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। জাহিদ হাসান ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। পরিবার অভিযোগ করেছে যে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলায় পুলিশি হেফাজতে জাহিদের মৃত্যু হয়েছে। দামুড়হুদা মডেল থানার পুলিশের একটি দলের গত শনিবার সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার করে থানায় নেওয়ার পথে জাহিদ হাসান মারা যান। পরিবারের সদস্যদের দাবি, কোনো মামলা ছাড়াই পুলিশ জাহিদ হাসানকে আটকের পর নির্যাতন করে হত্যা করেছে।

এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা কত? আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু ২০১৯ সালেই সারা দেশে পুলিশের হেফাজতে ১৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তাঁদের মধ্যে গ্রেপ্তারের আগে নির্যাতনে চারজনের মৃত্যু হয়েছে, গ্রেপ্তারের পর শারীরিক নির্যাতনে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে, দুজন নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এগুলোর বিচার হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, উপরন্তু পুলিশ বাহিনী একাধিকবার আনুষ্ঠানিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি তুলেছে আইনটি বাতিল বা সংশোধনের।

আরিফুলকে আটক এবং নির্যাতনের ঘটনা অনেক বিষয় সামনে এনেছে; গণমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এগুলো যে সবার অজানা ছিল, তা নয়। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এসব আচরণের পেছনের কারণ কী, সেটা না বুঝতে পারলে এবং সে বিষয়ে আলোচনা না করলে এই ঘটনাকে ব্যতিক্রম বলেই মনে হবে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে দায়মুক্তির সংস্কৃতি। প্রশাসন, পুলিশ, ক্ষমতাসীন দল ও তার ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মী, সদস্যরা ভালো করেই জানেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না হচ্ছে ও তাদের নামে
এ ধরনের অত্যাচার-নিপীড়ন চালানো হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা এই দায়মুক্তি ভোগ করবেন এবং তঁাদের কিছুই হবে না।

সম্প্রতি ক্যাসিনো-বিরোধী অভিযানের সময় একাধিক জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতারা ‘টর্চার সেল’ চালান বলে প্রতিবেদন বেরিয়েছিল; তাঁদের বিরুদ্ধে এ বিষয়ে কোনো মামলা হয়েছে বলে জানা যায় না। বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের পর দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের টর্চার সেলের কথা শোনা গিয়েছিল, কিন্তু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে প্রশাসনের দলীয়করণ। গত এক দশকে প্রশাসনের এক বড় অংশেই দলীয় ব্যক্তিদের আসীন করা হয়েছে, যাঁরা আচরণের দিক থেকে রাষ্ট্র, সরকার এবং দলের ভেতরে পার্থক্য করতে একাদিক্রমে অনীহ ও অপারগ। সেটা ক্ষমতাসীন দল চায় না। এ পার্থক্য যে একেবারেই অনুপস্থিত হয়ে গেছে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে ২০১৮ সালের নির্বাচন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের দলীয় ভূমিকা ছাড়া এ ধরনের নির্বাচন করা সম্ভব ছিল না।

তৃতীয় বিষয় হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল এখন কার্যত পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল; সে কারণে প্রশাসনের এক বড় অংশই মনে করে যে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। তদুপরি যদি ওই কর্মকর্তা নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের বলে প্রতিপন্ন করতে পারেন, তবে তো কথাই নেই।

ফলে আরিফুল ইসলামের নির্যাতিত হওয়ার মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটে; আমরা তার কিছু জানতে পাই, অনেকটাই জানতে পাই না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতেও ঘটবে বলেই আমার আশঙ্কা। কেননা, দায়মুক্তির এই সংস্কৃতি এবং প্রশাসন-দল-রাষ্ট্রকে আলাদা করার কোনো আশু লক্ষণ দৃশ্যমান নয়। সে কাজ রাজনৈতিক, কেবল একটি ঘটনার প্রতিবাদ তার জন্য যথেষ্ট নয়।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো