করোনাভাইরাস: পরীক্ষার অভাবে বাড়বে বিপদ

করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের শনাক্ত করতে অনেক দেশই যথেষ্ট পরীক্ষা করছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সর্বশেষ উদ্বেগ হচ্ছে এটাই। সংস্থাটির মহাপরিচালক গতকাল সোমবার সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলেছেন, ‘সব দেশের প্রতি আমাদের বলার বিষয় হচ্ছে “পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা”।’ মানে করোনা আক্রান্ত হিসেবে কাউকে সন্দেহ হলে প্রথম কাজ হলো পরীক্ষা করানো। ডব্লিউএইচও কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেনি। কিন্তু এই বার্তা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের জনঘনত্ব ও এখানকার মানুষের জীবনযাপনের ধরন বিবেচনায় নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই বাংলাদেশকে উচ্চ ঝুঁকির দেশ হিসেবে বিবেচনা করছেন।

এ অবস্থায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরীক্ষায় আমাদের কার্যক্রম কি সন্তোষজনক?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনাভাইরাস মোকাবিলার মূল পথ হচ্ছে সংক্রমণ শনাক্ত করা, তাদের বিচ্ছিন্ন করা এবং সংক্রমিতরা কাদের সংস্পর্শে এসেছে, তাদের খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টিনে রাখা। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরীক্ষার একক ও একমাত্র কর্তৃত্ব রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)। আর কাউকে এ পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়নি। ১৭ কোটি লোকের এই দেশে কারও মধ্যে করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা গেলে এই প্রতিষ্ঠানের দেওয়া কিছু ফোন নম্বরে ফোন করতে হবে। তারপর তারা কিছু প্রশ্ন করে সন্তুষ্ট হলে তাকে পরীক্ষা করা হবে। এই প্রক্রিয়ায় গত মঙ্গলবারের প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী ২৬৮ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে।

করোনাভাইরাস পরীক্ষার একক কর্তৃত্ব আইইডিসিআরের হাতে রাখা বা আর কাউকে তা করতে না দেওয়া কতটা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত? কেন এই রক্ষণশীল কৌশল? আইইডিসিআরের হটলাইনে ফোন করলে মূলত দুটি প্রশ্ন করা হয়; সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তি বিদেশ থেকে এসেছেন কি না। দ্বিতীয়ত, বিদেশ থেকে আসা কারও সংস্পর্শে এসেছেন কি না। এর ওপর ভিত্তি করেই পরীক্ষা করা হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শুধু এসব প্রশ্নের ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিতে গেলে নিশ্চিতভাবেই বিপদে পড়তে হবে। এখন যাঁরা সংক্রমিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে প্রবাসীদের সংস্পর্শে আসা স্থানীয় ব্যক্তিরা রয়েছেন। তাঁরা সংক্রমিত হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আগে স্থানীয় আরও কতজনকে সংক্রমিত করে গেছেন, তা কিন্তু অজানা থেকে যাচ্ছে। ফলে সরাসরি প্রবাসী বা বিদেশ থেকে আসা কারও সংস্পর্শে না এসেও অনেকে সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারেন। সেদিন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে সন্দেহভাজন করোনা সংক্রমিত যে ব্যক্তি পালিয়ে গেলেন, তাঁর হদিস পাওয়া গেছে কি না আমরা এখনো জানি না। যদি তিনি সত্যিই করোনা সংক্রমিত হয়ে থাকেন, তাহলে এরই মধ্যে কতজনকে তিনি সংক্রমিত করেছেন, কে জানে!

কারও মধ্যে লক্ষণ দেখা গেলেই তাঁকে পরীক্ষা করতে হবে এবং নিশ্চিত হতে হবে তিনি সংক্রমিত কি না। এটাই এই ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ ঠেকানোর পথ। কারণ, তখনই তাঁকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে, তাঁর সংস্পর্শে আসা লোকজনকে কোয়ারেন্টিন করা যাবে। বাংলাদেশ পরীক্ষার ক্ষেত্রে যে পথটি ধরেছে, তাকে করোনা সংক্রমণ ঠোকানোর মূল নীতির উল্টো বলেই মনে হচ্ছে। শুধু ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা এবং শুধু আইইডিসিআরের ওপর নির্ভরতাই তা বলে দিচ্ছে। সামনে পরিস্থিতি খারাপ হলে এবং সংক্রমণের লক্ষণ মানুষজনের মধ্যে বেড়ে গেলে, এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এখনকার পরিস্থিতির কথাই বলি। ধরুন বরিশালে একজন লোকের মধ্যে এই ভাইরাসের লক্ষণ দেখা গেল, তাঁকে আইইডিসিআর পরীক্ষা করবে কীভাবে? জেলার সিভিল সার্জন তাঁর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠাবে। এতে কত সময় লাগবে? কীভাবেই বা তা পাঠানো হবে? প্রক্রিয়াটি ঠিক বাস্তবসম্মত নয়। ১৭ কোটি লোকের এই দেশে এখন সরকারের হাতে করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট রয়েছে ১ হাজার ৭৩২টি। আরও ভয়ংকর তথ্য হলো নতুন কিট কবে আসবে, তা কেউ জানে না।

ইরান এ ধরনের এককেন্দ্রিক কায়দায় করোনাভাইরাস সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, যার পরিণতি ভালো হয়নি। করোনাভাইরাস এমন একটি নতুন সংকট, যা সামাল দেওয়ার স্বতঃসিদ্ধ কোনো নিয়ম কারও জানা নেই। কিন্তু যে দেশগুলো শুরুতে এই বিপদে পড়েছিল এবং ভুলভ্রান্তিসহ নানা কায়দায় সামাল দেওয়ার চেষ্টা তাদের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। ডব্লিউএইচও, যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি বা জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা সেন্টার প্রতিদিন নতুন নতুন নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

ডব্লিউএইচও এখন পরীক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে। আমাদের আশপাশের দেশগুলোর করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে কী কৌশল নিয়েছে, তা আমাদের জন্য বিবেচনার বিষয় হতে পারে। পাকিস্তানে বিভিন্ন প্রদেশে সরকার ১৩টি হাসপাতাল নির্ধারণ করে দিয়েছে, যেখানে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা যায়। বেসরকারি খাতকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোয় বিনা মূল্যে আর বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় পয়সা খরচ করে এই পরীক্ষা করতে হচ্ছে। আরও পরীক্ষা দরকারি হয়ে পড়ায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নির্দিষ্ট কিছু বেসরকারি ল্যাবে পরীক্ষার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু আমাদের সরকারের মধ্যে এমন চিন্তাভাবনার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

বেসরকারি খাতকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা বা এই খাতে কোনো কিছু করার সুযোগ নেই। শুধু ঢাকা শহরের কথা বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, স্বাস্থ্যসেবায় বেসরকারি খাতের অবদান ৮৬ ভাগ। গত ডেঙ্গু মৌসুমে পরিস্থিতি যখন শোচনীয় হয়ে পড়েছিল, তখন বেসরকারি খাত ছাড়া কি এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেত? এ নিয়ে কেউ যাতে বাণিজ্য করতে না পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মনীতি নির্ধারণ এবং তা মেনে চলতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি যেমন সরকারিভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা অনুসরণ করতে এখন অসুবিধা কোথায়? এটাই তো সরকারের কাজ। তা না করে করোনা পরীক্ষা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনো যৌক্তিক কারণ পাওয়া যাচ্ছে না।

একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সরকার কেন করোনা পরীক্ষার বিষয়টি পুরোপুরি নিজের হাতে রেখে দিতে চাইছে? কেন বেসরকারি খাত বা নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানকে এর সঙ্গে যুক্ত করছে না? তিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি। বলেছেন, ‘একটাই কারণ হতে পারে, সরকার সম্ভবত করোনা সংক্রমণ ও এ–সংক্রান্ত সব তথ্য-উপাত্তের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়। এ ছাড়া তো আর কারণ দেখি না।’

এ কে এম জাকারিয়া: প্রথম আলোর উপসম্পাদক
[email protected]