'সিস্টেম'-এ ছিদ্র ছিল

‘সিস্টেম’ মুদ্রাওয়ালাদের জীবনের আরামটুকুও ঠিকমতো রক্ষা করতে পারছে না। ছবি: রয়টার্স
‘সিস্টেম’ মুদ্রাওয়ালাদের জীবনের আরামটুকুও ঠিকমতো রক্ষা করতে পারছে না। ছবি: রয়টার্স

২০০৯ সালের দিকে বিশ্বে বিলিয়নিয়ার ছিলেন ৮০০ জনের মতো। এক দশক পর, ২০১৯ সালে এই ‘ক্লাব’-এর সদস্য দাঁড়ায় প্রায় ২ হাজার ২০০। ‘মডার্ন সিস্টেম’-এর একটা বড় গৌরবের দিক ছিল এই সংবাদ।

বলা হচ্ছিল ‘মুদ্রাই মানুষকে রক্ষা করবে’। যারা ‘কষ্ট করে’ মুদ্রা আয় করছে, রক্ষা পাওয়ার এখতিয়ার তাদেরই আছে। তারাই বেঁচে থাকার অধিকার রাখে। দূষিত দুনিয়াতেও ‘এয়ার পিউরিফায়ার’, ‘মিনারেল ওয়াটার’ থেকে শুরু করে ‘অরগানিক ফুড’—সবই মুদ্রা নিশ্চিত করতে পারবে।

কিন্তু করোনার কালে এসে দেখা গেল, ‘সিস্টেম’ মুদ্রাওয়ালাদের জীবনের আরামটুকুও ঠিকমতো রক্ষা করতে পারছে না। জগৎখ্যাত আর্ট গ্যালারিগুলো হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল, অর্কেস্ট্রাগুলো অনুষ্ঠান বাতিল করেছে; কমে গেছে ক্যান্ডেল-লাইট-ডিনার-সন্ধ্যার আয়োজন। এলিট জীবনযাপনের নন্দনতাত্ত্বিক সব দিকই হুমকিতে। বিকেল-সন্ধ্যায় চূড়ান্ত এক বেমানান দৃশ্য।

তবে সিস্টেমের মাহাত্ম্য মরে না। এলিটরা করোনা হামলে পড়ার আগে আগে দামি হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারবেন; দীর্ঘ সময় বাড়িতে নিজেকে আটকে রাখতেও পারবেন; তাঁদের তো রুটিরুজির চিন্তা করতে হয় না। উপরন্তু ‘ই-কমার্স’ আছে!

কিন্তু ‘নোংরা’ গরিবদের কী হবে? কাজ বন্ধ করে ঘরে থাকতে গেলে দোকানদার থেকে কৃষিমজুর তাদের সংসার কীভাবে চলবে? দেখা গেল এত দিনের কথিত ‘পারফেক্ট সিস্টেম’টি এদের রক্ষা করতে ব্যর্থ। যে কারণে ভাইরাসের কিছু ‘লক্ষণ’ দেখা গেলেও পেটের দায়ে এরা কাজকর্ম করতে থাকে। যথেষ্ট মুদ্রাওয়ালারা তখন আতঙ্কিত হয়ে ‘সবকিছু বন্ধ’ করতে বলেন। কিন্তু ‘সিস্টেম’টি সংশোধন করার বিষয়টি চেপে যান। এটাও সিস্টেমের অংশও বটে।

মুদ্রাওয়ালাদের কোয়ারেন্টিন অবস্থায় চিকিৎসায় ভালো হওয়ার সুযোগ আছে। গরিবদের জন্য সিস্টেমে সেই সুযোগ রাখা হয়নি। মনে করা হয়েছিল গরিবদের থেকে দূরে থাকা যাবে। ‘মডার্ন’-পলিটিক্যাল-ইকোনমিতে সে রকম ‘আইসোলেশন’-এর দাবি ছিল। কিন্তু প্রকৃতি শেষে দেখিয়ে দিচ্ছে চলতি ‘সিস্টেম’-এ ‘সোশ্যাল আইসোলেশন’-এর সুযোগটি আসলে এক মহাবিভ্রম।

এত দিনকার সিস্টেমে কৃষক খাবার ফলাত। সেই খাবার দুনিয়ার এনার্জি জোগায়। তারপরও পলিটিক্যাল-ইকোনমিতে কৃষক ছিল আইসোলেশনে। শ্রমিকও একই দশায় ‘বাঁচে’। কিন্তু ক্রমাগত ‘উচ্চপ্রবৃদ্ধি’ এবং শেয়ারবাজারের বৈশ্বিক ‘চাঙাভাব’ মিলিয়নিয়ার ও বিলিয়নিয়ারদের জন্য পৃথক কোনো সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয় না। সবচেয়ে বড় ধনী জেফ বেজোস আর বিল গেটসও দেখা হলে হাত মেলাতে পারছেন না।

‘করোনা-ইজম’ শেখাল বর্তমান ‘সিস্টেম’-এর আইসোলেশনের ওই ধারণাটি আর চলবে না। ‘ইনফেকশনের যুগে’ এমন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা লাগবে,Ñযা গরিবদেরও সুস্থতার নিশ্চয়তা দেবে। সুস্বাস্থ্যের প্রশ্নটা গরিব আর এলিটে ভাগ করা যাচ্ছে না। এটা এখন আর বাছাই বা পছন্দ করা-না-করার বিষয় নেই। অনিবার্য অভিজ্ঞতা। মহাচীন থেকে ইউরোপ-আমেরিকা এই অভিজ্ঞতা থেকে শিখছে। সঙ্গে এশিয়াও। একই আকাশের নিচে, একই ঢেউয়ের দোলায় আন্দোলিত সবাই। ইতিমধ্যে স্পষ্ট, এককভাবে শাসক সিস্টেমের কাছে করোনার কোনো উত্তর নেই। তাই মানবজাতির ঐক্যের ডাক এসেছে।

গত দুই মাস করোনার সংখ্যাগণিত প্রচারকালে টিভি উপস্থাপকদের মুখে বারবার ‘গ্লোবাল’ শব্দটা শোনা যাচ্ছে। সাধের ‘গ্লোবালাইজেশন’ এত দিন ছিল ব্যবসায়ের রতিক্রিয়া মাত্র। এবারই কেবল বোঝা গেল, আন্তর্জাতিক সমাজের বৈশ্বিক একটা স্বাস্থ্য অবকাঠামোও লাগবে। করোনাদুর্যোগ সেটাই দেখাল। ভাইরাস ভ্রমণ করতে জানে। ভাইরাস আন্তদেশীয় বাণিজ্য থামাতেও পারঙ্গম। চীনের ভাইরাস ইতালি হয়ে ঢাকায় চলে আসতে জানে।

এই বার্তাটি এত দিনকার ‘সিস্টেম’-এর সঙ্গে যায় না, কিন্তু মাত্র কয়েক সপ্তাহে মানুষ হাতেকলমে শিখছে: ভূগোলে সবাই পরস্পর নির্ভরশীল; আন্তসম্পর্কিত। ‘আধুনিক সিস্টেম’-এ আন্তর্জাতিক সংহতির এই বোধটি বাদ পড়েছিল। এটা এমন এক ‘বায়োলজি’, যা ‘ইকোনমি’ অগ্রাহ্য করে গেছে। ওই ছিদ্র দিয়েই করোনা এসেছে। আগে ‘সার্স’ এসেছিল; তারও আগে ‘ইবোলা’ আর সোয়াইন ফ্লু এসেছে। মুদ্রা ঢেলে ঢেলে প্রকৃতির ওপর ‘প্রবৃদ্ধি’ আর ‘উৎপাদন’-এর আধিপত্য বাড়িয়ে, ক্যাপিটাল মার্কেট চাঙা করে সবাই ভেবেছি ‘সিস্টেম’কে রক্ষা করা গেল। ‘সিস্টেম’-এর মুকুটে নতুন নতুন পালক পরানো হয়েছে মহাশূন্যে রকেট পাঠিয়ে, দূরপাল্লায় মিসাইল ছুড়ে। হাসপাতালে বেড বাড়ানোর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের হাতে।

পত্রিকা লিখেছে, ১৭ কোটি মানুষের দেশে সনদধারী চিকিৎসক এক লাখেরও কম। করোনা পরীক্ষার ‘কিট’ ছিল ২০০০টি মাত্র! আইসিইউ আছে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এক হাজারের কম। সেই আইসিইউতে এক দিন থাকতে বেসরকারি হাসপাতালকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়। এই (সীমিত+ব্যয়বহুল) স্বাস্থ্যব্যবস্থা কি গ্রহণযোগ্য? এমনকি করোনার আক্রমণ বাড়লে ধনীদের চাহিদা মেটাতে সক্ষম কি এই ব্যবস্থা?

যে ভাইরাসটি বিদেশি, তাকে না হয় বন্দরে বন্দরে থামানো গেল; কিন্তু যদি কখনো অন্দরে ভাইরাস বের হয়? তখন? কতটা প্রস্তুত ‘সমাজ’ ও ‘সিস্টেম’? গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা মেডিকেল ও মেডিসিন ব্যবস্থা কি দেশে-দেশে মহামারি রুখতে সক্ষম? বিশেষ করে যখন অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর করা সুপারবাগের কাল চলে এসেছে। প্রোটিনের চাষাবাদে অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহারে কোটি কোটি মানবদেহ ইতিমধ্যে ড্রাগ-রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য খাতকে ভবিষ্যতে এই অবস্থাও সামাল দিতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্টজনিত সংকট থেকে কিন্তু ধনীদেরও রেহাই নেই। হ্যাঁ, ‘ওষুধশিল্পের প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধি’র সূত্রেই এই অর্জন। এ রকম ‘ক্রেইজি প্রবৃদ্ধি’ কিন্তু ১০ টাকার মাস্ক ১০০ টাকা করে ফেলে। মহামারির সময়ে ‘করপোরেট ইথিকস’ কেন যেন কাজ করে না!

সে জন্যই হয়তো হঠাৎ সবাই ব্যক্তিগত সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিস্তর উপদেশ দিচ্ছেন। হায়, কত দিন মানবসভ্যতার ‘ইমুয়েন-সিস্টেম’ শক্তিশালী করার কাজটা নিয়ে যৌথ কথাবার্তা হয় না কোথাও। হয়তো ভাবা হয়েছিল, এশিয়ার বস্তি কিংবা আফ্রিকার গ্রামগুলো উজাড় হলেও প্যারিসের মিউজিয়াম কিংবা স্পেনের লা গায় আঁচড় পড়বে না। চীনের গোয়াংডং আক্রান্ত হলেও ওয়াশিংটন হয়তো সুরক্ষিত। সবই ভুল প্রমাণিত হলো।

তবে করোনা-কাণ্ডে কেবল ‘ইফেক্ট’ দেখলে চলবে না; ‘কজ’ও দেখা জরুরি। করোনা নিজে থেকে কোনো ‘কজ’ বা কারণ নয়। এটা একটা ‘মেসেজ’-এর নাম। একে একটা আইডিওলজিও বলা যায়। ‘করোনাইজম’। যার সারকথা: ‘তোমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থায় সমস্যা আছে; বার্তাটি নাও, না হলে শেষ হয়ে যাও! তোমাদের সিস্টেমে ছিদ্র আছে, একে নতুন করে গড়তে হবে; মানুষের মতো করে; সবার জন্য; প্রকৃতির সবাইকে নিয়ে।’

সুতরাং মানুষ বাঁচাতে নতুন সমাজের নতুন এক নকশা লাগবে। নিষ্ঠুর প্রবৃদ্ধির কবল থেকে মানবজাতির ভবিষ্যৎকে সামাজিক মালিকানায় নিতে হবে যে এবার। হুমকি যখন সবার জন্য একই রকম, রাজনৈতিক পছন্দও অনিবার্যভাবে একই রকম হতে বাধ্য।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক