পাহাড়িরা কেন হামের টিকা থেকে বাদ?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

এবার বান্দরবানের লামায় ম্রো জনগোষ্ঠীর শিশুরা ‘অজানা’ বা ‘অজ্ঞাত’রোগে আক্রান্ত হয়েছে। একজনের মারা যাওয়ার কথা স্বীকার করা হয়েছে। আমাদের মনে আছে সীতাকুণ্ডের কথা। ২০১৭ সালে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ত্রিপুরা গ্রামের ৯ শিশু প্রচলিত অজুহাত হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ‘অজ্ঞাত’ রোগে মারা যায়। নথি অনুযায়ী ৯ জনের সবাই মারা যায় ২০১৭ সালের ৮ থেকে ১২ জুলাইয়ের মধ্যে।

এসব ক্ষেত্রে নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর একটা সোজাসাপটা পথ হচ্ছে ‘অজ্ঞাত’, ‘অজানা’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করে পরিস্থিতিকে একটা আসমানি বালা–মুসিবতে রূপ দেওয়া। সেবার শেষ পর্যন্ত চেপে রাখা যায়নি হামের নামধাম। এরপর যথানিয়মে আয়োজন করা হয় সংবাদ সম্মেলন। দুষ্ট লোকেরা এসব আনুষ্ঠানিক প্রচারকে ক্যারিকেচার করে ‘সার্কাস’ বলে থাকেন। সেই সংবাদ সম্মেলনে (জুলাই, ২০১৭) জানানো হয়েছিল, গত ৮ থেকে ১২ জুলাইয়ের মধ্যে ৯টি শিশুর মৃত্যু হয়। তাদের বয়স ছিল ৩ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। আক্রান্ত ও মৃত শিশুরা হাম রোগের জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়েছিল বলে ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এসব শিশু অপুষ্টিতেও ভুগছিল। ফলে সংক্রমণ একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল। সম্মেলনের মধ্যমণি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছিলেন, ‘এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের সব ওয়ার্ডে টিকাদান পরিকল্পনাগুলো পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যদি কোনো জনপদ এ কর্মসূচি থেকে বাদ পড়ে থাকে, সেটাকে এই পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’ 

মহাপরিচালক নানা পরিভাষা ব্যবহার করে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের বিমোহিত করে জানিয়েছিলেন ‘ওয়ার্ডভিত্তিক “মাইক্রোপ্ল্যান” অনুযায়ী টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হয়। তবে সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের “মাইক্রোপ্ল্যানে” ত্রিপুরাপাড়ার উল্লেখ নেই। এ কারণেই এই পাড়ায় টিকাদান কার্যক্রম ছিল না।’ 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন, বর্ণিত ত্রিপুরাপাড়ায় ৮৫ পরিবারে ৩৮৮ জন বাসিন্দা রয়েছেন। তাঁদের কেউই কোনো দিন হামের টিকা পাননি। আর কোথাও কি এমন থাকতে পারে? উপস্থিত এক সংবাদকর্মীর এমন প্রশ্নের জবাবে ‘মাইক্রোপ্ল্যান রিভিউ’, ‘লার্নিং’, ‘রি-অর্গানাইজ’ ইত্যাদি জারগানের জপমালা শুনিয়ে দেওয়া হয়। সেদিনের সেই অনুষ্ঠানের মূল সুরটি ছিল—একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে গেছে, মাঠকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, এমন ঘটনা আর ঘটবে না। 

সার্বিক পরিস্থিতির চুলচেরা বিশ্লেষণ দিয়ে আগস্ট ২৬, ২০১৭ প্রথম আলোয় শিশির মোড়ল লিখেছিলেন সমস্যা দেশের কোনাকানিতে ঘটতে থাকা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পাশ কাটানো যাবে না। দেশের প্রায় ২০ লাখ শিশু হামের ঝুঁকিতে আছে। এর বড় কারণ, টিকা না পাওয়া। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইপিআই নামে পরিচিত টিকাদান কর্মসূচিটির দুর্বলতা এর বড় কারণ। তিনি দেখিয়েছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) নানা মূল্যায়ন প্রতিবেদনে নানা সময়ে ইপিআইয়ের বেশ কিছু দুর্বলতা তুলে ধরে সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছিল। কেউ তেমন কানে তোলেনি। সাধারণভাবে শতকরা ১০টি শিশু এক বা একাধিক টিকা পায় না। সরকার স্বাস্থ্য খাতের সাফল্য হিসেবে এই কর্মসূচির উদাহরণ দিলেও তত্ত্বতালাশ করে দেখা গেছে, মোট ৪৩ জেলায় ইপিআইয়ের কোনো না কোনো ঘাটতি আছে। ৯টি জেলার পরিস্থিতি ২০১৪ সালের তুলনায় খারাপ হয়েছে। 

মহাপরিচালক তাঁর দেওয়া বচন অনুসরণ করলে ঠিক তার পরের বছর ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সীতাকুণ্ডের পাশের উপজেলা মিরসরাই সদর ইউনিয়নের মধ্যম তালবাড়িয়া গ্রামের আরেক ত্রিপুরাপাড়ার সেই কথিত অজ্ঞাত রোগে শিশুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটত না। সেই বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি জীবন ত্রিপুরা (৮) ও ২১ ফেব্রুয়ারি দুলিরাং ত্রিপুরা (৪) নামের দুই শিশু হামে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে আক্রান্ত অন্য ১৪ শিশুকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে গ্রামের আরও ২৬২ শিশুকে হামের টিকা দেওয়া হয়। 

গত বছর (২০১৯) চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে হাম ছড়িয়ে পড়ার খবর আসে। সেখানেও আক্রান্ত হয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তাপল্লি । ফটিকছড়ির বাগান বাজার ইউনিয়নের পাতাছড়া গ্রামের ত্রিপুরাপল্লির শিশুরা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়। 

এবার খবর এসেছে বান্দরবানের লামা থেকে। খবর এনেছিলেন একজন কাঠ ব্যবসায়ী। তাঁকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো উচিত। বোমাং সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত লামার সদর ইউনিয়নের পোপা মৌজায় পুরোনো লাইল্যাপাড়া। পাড়াটি সদর ইউনিয়নে তাউ পাড়ার ওপরে ডলুঝিরি মুখ দিয়ে একটু এগোলেই সামনে পড়ে। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের এই জনপদে ‘অজ্ঞাত’ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বোমাং সার্কেলের পাড়াপ্রধান (কার্বারি) লুংতু ম্রো সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাঁদের পাড়ার কেউ কখনো কোনো ধরনের টিকা পায়নি। টিকার ব্যাপারেও জানে না তারা। 

বিষয়টি আমলে নিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবনের জন্য ধন্যবাদ বান্দরবানের সিভিল সার্জন ডা. অংসুই প্রু মারমাকেও। তিনি জানিয়েছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে হামের মতো গুটি উঠেছে। (চুপ থাকার সর্বজনীন চর্চাকে পাশ কাটিয়ে এর চেয়ে বেশি তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়); আক্রান্ত শিশুরা মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। পাড়ার আশপাশের এলাকাগুলোতে
যাতে রোগটি ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে জন্য একটি মেডিকেল টিমকে তিনি দায়িত্ব দিয়েছেন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্ত নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ঘটনাস্থলে আরও মেডিকেল টিম পাঠানো হবে। 

ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় আক্রান্ত ৩৭ জনকে লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসা হয়েছে। আক্রান্ত সব শিশুর শরীরে গুটি উঠেছে, প্রচণ্ড জ্বর ও সঙ্গে খুব কাশি আছে। তারা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তিনটি শিশুর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এখানে আনার আগেই মারা গেছে শিশু দুতিয়া মুরুং। পাড়ারপ্রধান লাতুং কার্বারির আদরের নাতি ছিল দুতিয়া। দুতিয়ার বাবা মেনহাত মুরুং এখন বাকরুদ্ধ। 

এত দিন এই জনপদ কেমন করে টিকা কর্মসূচির বাইরে ছিল? এমন প্রশ্নের উত্তর তৈরি আছে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের। তারা জানিয়েছে, লাইল্যাপাড়ায় কোনো টিকাকেন্দ্র নেই। কয়েকটি পরিবারের জন্য টিকা দিতে যাওয়াও সম্ভব নয়। তা ছাড়া ম্রো জনগোষ্ঠী টিকা নিতে আগ্রহীও নয়। ব্যস, আর কে কী বলতে পারে। তাহলে তিন বছর আগে মহাপরিচালক যে মাইক্রোপ্ল্যানিংয়ের কথা বলেছিলেন, তার কী হলো? সেটা কি কেবলই ‘বাত কি বাত’ ছিল? ‘মন কি বাত’ তাহলে কী ছিল? 

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক