করোনার গুজবে আর কত কিছু করব আমরা!

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আতঙ্কে মানুষ বাইরে বের হচ্ছে কম। তাই এখন অনেকেই চাল, ডালসহ মুদিপণ্য কিনতে ভিড় করছেন রাজধানীর পাইকারি দোকানগুলোতে। কারওয়ান বাজারে দুপুর ১২টার চিত্র
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আতঙ্কে মানুষ বাইরে বের হচ্ছে কম। তাই এখন অনেকেই চাল, ডালসহ মুদিপণ্য কিনতে ভিড় করছেন রাজধানীর পাইকারি দোকানগুলোতে। কারওয়ান বাজারে দুপুর ১২টার চিত্র

অন্যদের মতো আমাদের দেশও এখন করোনা–আক্রান্ত। ছড়াচ্ছে গুজব। সেই গুজবে পাগলপারা হয়ে গেছে অনেকে। বাজারে হ্যান্ডওয়াশ ও স্যানিটাইজার কেনার হিড়িকের পর এবার শুরু হয়েছে বিপুল পরিমাণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার পাগলামি। একই সঙ্গে চলছে রাতবিরাতে পাতা খোঁজা ও খাওয়া। কারণ, শোনা গেছে, চিলে কান চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে!

বাসার জন্য সবজি কেনার প্রয়োজন ছিল। গিয়েছিলাম এক পরিচিত দোকানির কাছে। হাসিমুখে জানিয়ে দিলেন, ‘দাম কিন্তু বাড়তি’। শুনেই আমার মানিব্যাগের কথা মনে হলো। ওটার সামর্থ্য যে বাড়েনি।

কিছুদিন আগে এক কেজি আলু ছিল ১৮ টাকা। কয়েক দিনের পার্থক্যে তা ২৫ হয়ে গেছে। দোকানিও হুট করেই হয়ে গেছে ‘এক জবান’-এর লোক, দর-কষাকষির কোনো সুযোগ নেই। সুযোগ থাকবেই–বা কীভাবে? আমার পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো আরেক ক্রেতা যে ওই দামেই ৫-১০ কেজি নিয়ে নিচ্ছেন! আমি এক হালি লেবুর দাম নিয়ে মুলোমুলি করার সময়ই আরেকজন ব্যাগে পুরে ফেললেন দুই ডজন। চাহিদা বেশি। গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরে জানা গেছে, সরবরাহও ভালো। কিন্তু অর্থনীতির সব সূত্র মিথ্যে করে দিয়ে দাম বাড়ছেই। কারণ, গুজব মানে না কোনো বাধা।

আমরা এমনই এক জাতি, যারা রাত-বিরাতে মহৌষধ হিসেবে থানকুনিপাতা খুঁজতে বের হই। থানকুনির কিছু ঔষধি গুণ অবশ্যই আছে। কিন্তু তার করোনাভাইরাসকে ঠেকিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে এখনো জানা যায়নি। তাতে কী? নিশ্চিত না হলেও কেউ কোনো কিছু শুধু কানে তুলে দিলেই আমরা এখন তা করে ফেলছি। চিল দেখতে না পেলেও তার কাছেই যে কান আছে—সে ব্যাপারে আমাদের আস্থা ও বিশ্বাস প্রচণ্ড। মার্ক জাকারবার্গের সৌজন্যে গুজব ও সচেতনতা—দুই-ই ছড়িয়ে দেওয়ার একটি প্ল্যাটফর্ম পাওয়া গেছে। কিন্তু সচেতনতার বদলে গুজব ছড়ানোতেই আমাদের আনন্দ। কারণ, আমরা তো মানিই যে—যুক্তিতে মুক্তি মেলে না!

তাই আমরা যুক্তির ধার ধারছি না। আজ দুই পদের ডাল আধা কেজি করে কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মুদির দোকানে চরম ভিড় দেখে ভয় পেয়ে চলে এসেছি। তবে নিশ্চয়ই আমারই কোনো প্রতিবেশী আগামী কয়েক মাসের ডাল মজুত করে ফেলেছেন। চালও নিশ্চয়ই কিনেছেন বস্তায় বস্তায়। এ কারণে অন্য কেউ পেটেভাতে থাকতে গলদঘর্ম হচ্ছে কি না, তা নিয়ে আমরা ভাবছি না। নিজেদের ‘ছ্যাপাক্রান্ত’ রেখে, শুধু খাবার মজুত করে কি করোনা প্রতিরোধ সম্ভব? নাকি, জোম্বিসম্পর্কিত সিনেমা দেখার পর একাই বেঁচে থাকবেন বলে ঠিক করেছেন?

মানব ইতিহাসের শুরুতে মানুষে মানুষে শিকার ও শিকারির সম্পর্ক ছিল। হাজার হাজার বছর পরও সেই প্রবণতা ধুয়েমুছে যায়নি। মানুষ এখনো মানুষের মাংস খায়, তবে ভিন্ন উপায়ে।

উদাহরণ দিয়ে বলছি। ধরুন, আপনার প্রয়োজন ২ কেজি আলু। কিন্তু করোনা ‘গু-জব’-এ কান ভাসিয়ে আপনি কিনে ফেললেন ২০ কেজি। ওদিকে আপনার বাড়ির গৃহকর্মীর সংসারে হয়তো গোটাকতক হলেই আজকের দিনটা পার হয়ে যেত। দিন আনে দিন খায় মানুষ তো প্রতিদিনের কথাই ভাবে বেশি। ১৮ টাকার আলু যখন ২৫ হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই আপনার গৃহকর্মীকে কিন্তু আপনি বোনাস দিচ্ছেন না। ফলে তার পক্ষে বর্ধিত দামে পেঁয়াজ-আনাজ কেনা কঠিন হয়ে পড়ছে। এভাবেই আপনার মাত্রাতিরিক্ত সাবধানতায় আরেকজনের খেয়ে-পরে বাঁচা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এভাবেই জোম্বি পাওয়া না গেলেও গুজবের তোড়ে পুরো দেশটাকে জোম্বিল্যান্ড বানিয়ে ফেলছি আমরা। দাম বাড়লেই যে গুটিকয়েক মজুতদারের এত দিন গাল দেওয়া হতো, এখন ঘরে ঘরে মিলছে তেমনই মজুতদার। 

লাতিন আমেরিকার বিখ্যাত লেখক বির্শেলিউ পিনিয়েরা গত শতকে একটি গল্প লিখেছিলেন। ইংরেজিতে অনূদিত ওই গল্পের নাম ‘মিট’। সেখানে এক কল্পিত নগরীর গল্প শুনিয়েছিলেন কিউবান পিনিয়েরা। ওই নগরীতে হুট করেই মাংসের আকাল দেখা দিয়েছিল। শেষে মাংসের অভাব পূরণ করতে নগরীর অধিবাসীরা নিজেদের শরীর থেকে মাংস কেটে কেটে খাওয়া শুরু করেছিলেন। এই অভিনব উপায়ে মাংসের অভাব পূরণ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু একসময় নিজেদের শরীরের মাংস খেতে খেতে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে শুরু করে মানুষ। কিন্তু উদরপূর্তির লোভে মানুষ হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কেউ অভিযোগ তোলেনি।

এই জনপদেও এখন সেই দশা। মানুষ শুধু ঘোষণা দিয়ে একে অপরের মাংস খাচ্ছে না, এই যা। তবে একে অন্যকে পেটে-ভাতে মারছে ঠিকই।

নতুন করোনাভাইরাসের নিয়ন্ত্রণও একদিন মানুষের হাতের মুঠোয় আসবে। এই পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া ভূতপূর্ব মহামারির ইতিহাস পড়লে সেটাই অনুভূত হয়। কিন্তু তত দিনে আমরা একে অন্যকে গিলে না ফেললেই হলো!

অর্ণব সান্যাল: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]