করোনা মোকাবিলা: শীর্ষ পর্যায় থেকে ব্রিফিং নয় কেন

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (জামা) ১৬ মার্চ একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। এর শিরোনাম নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা। ‘মিডিয়া অংশীদারত্ব’ বিষয়ে নিবন্ধটিতে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মহামারি নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলায় সরকারের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভূমিকা রাখতে পারে এবং তার তা করাও উচিত। সংবাদমাধ্যম জনগণের কাছে প্রস্তুতি ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ, সহজ ও সুস্পষ্ট বার্তা’ পৌঁছাতে পারে। এটা পরিষ্কার যে বার্তার ধরন ইতিবাচক বা নেতিবাচক যা–ই হোক না কেন, সেসব জনগণকে প্রভাবিত করতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের পক্ষে সংবাদমাধ্যম ও জনগণের সঙ্গে এ পর্যন্ত পদ্ধতিগতভাবে কথা বা বার্তা দিচ্ছেন কে? সহজ উত্তর মীরজাদী সেব্রিনা। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) পরিচালক। তিনি যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা। তিনি প্রায় নিয়মিত সাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন। আমরা নিশ্চয় তার প্রশংসা করব। কারণ, তিনি গুছিয়ে কারিগরি তথ্য দিচ্ছেন। তবে তাঁকে যুক্ত রেখেই ব্রিফিংয়ে একটা পরিবর্তন আনার সুপারিশ করব। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকদের দ্রুত একটু ভিন্ন চিন্তা করতে হবে। একটি উচ্চপর্যায়ের প্ল্যাটফর্ম লাগবে।

আমরা যদি বিশ্বের দিকে নজর দিই, তাহলে এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। সিএনএন বুধবার বলেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পও অবশেষে বদলে গেলেন। করোনায় করণীয় কী? এ বিষয়ে তিনি তাঁর জীবনের সেরা ও সৌম্য ব্রিফিংটি দিয়েছেন গত সোমবার। এর ফলে বহু মার্কিনের জীবন বাঁচানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে বলেও সিএনএন-এর মন্তব্য। ১৬ মার্চ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনা নিয়ে প্রথম প্রেস ব্রিফিংয়ে হাজির হন। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ১৮ মার্চ তিনি পুনরায় ব্রিফিংয়ে হাজির হন। তার সঙ্গে জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরা ছিলেন। এবং অবশ্যই কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন বিশেষজ্ঞরা ছিলেন।

‘আমাদের অবশ্যই একটি যুদ্ধকালীন সরকারের মতো কাজ করতে হবে।’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মুখে ঠিক এই রকম একটি রাজনৈতিক মন্তব্য আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বলা আর কোনো একটি সভা বা ভিন্নতর কোনো অনুষ্ঠানে উচ্চারণ করা এক নয়। দুটির গুরুত্ব দুরকম। এ রকম মন্তব্য ব্রিটেনের মীরজাদী সেব্রিনার পদে থাকা কারও তরফে বেসুরো। বেমানান। আবার নিতান্ত সাধারণ তথ্য সেটাও কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জনসন দিয়েছেন। এর কারণ সোজা। যে কথা একজন কর্মকর্তা বলবেন, যে কথা একজন মন্ত্রী বলবেন, যে কথা একজন প্রধানমন্ত্রী বলবেন, তা এক পাল্লার ওজনে হবে না। এটা সব দেশের জনগণের জন্যই প্রযোজ্য। উন্নত দেশ বা নিম্ন আয়ের
দেশ বলে কথা নয়।

বরিস জনসন সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, যাঁদের বয়স ৭০ বছরের বেশি, গর্ভবতী এবং স্বাস্থ্য ভালো নয়, তাঁরা যেন পারতপক্ষে বাড়ির বাইরে বের না হন। স্বাস্থ্যগতভাবে দুর্বল থাকা প্রবীণ আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে অন্তত ১২ সপ্তাহের জন্য বেড়াতে না যাওয়া। একটি পরিবারে যদি কোনো একজনের লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে গোটা পরিবারের সদস্যদের দুই সপ্তাহ বাড়িতে থাকা, বড় সমাবেশ সরকার সমর্থন করে না। এই যে কথাগুলো, তা প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে আসার ফলে ব্রিটেনের মানুষ কিন্তু সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। ওপরের কথাগুলোর ভিত্তি ইম্পেরিয়াল কলেজের সমীক্ষা। এর ভিত্তিতে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশল না নিলে ব্রিটেনে পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটত। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সংবাদ সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা হাজির ছিলেন। কিন্তু কথাগুলো বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। লেবার পার্টির পরবর্তী সম্ভাব্য নেতা স্যার কির স্ট্যারমার। তিনি বলেছিলেন, জনস্বাস্থ্য বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বজায় রাখতে মন্ত্রীরা ব্যর্থ হচ্ছেন। তিনি প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন দাবি করেছিলেন। গত সোমবার কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোই এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিলেন যে অ-কানাডীয়রা (ব্যতিক্রম বাদে) কানাডায় ঢুকতে পারবেন না।

আমাদের দেশে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর যা অবস্থা, তাতে চাইলেও রাতারাতি বিরাট পরিবর্তন আনা যাবে না। কিন্তু মানুষকে সতর্ক করা সবচেয়ে জরুরি। গত সপ্তাহে ঝালকাঠি জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে গেলাম। বিয়েবাড়ি। লোক গিজ গিজ করছে। একজনের মধ্যেও সচেতনতা দেখলাম না। সবাই কোলাকুলি করছেন। স্কুল ছুটি, তাই অনেকেই চলে গেলেন সমুদ্রবিহারে। তাই বরিস জনসন যেসব করণীয় বলছেন, সেসব জনগণের মানা না–মানার সঙ্গে অনেক কিছুই নির্ভর করছে। ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেলে উন্নত স্বাস্থ্যসেবাও যে খুব কাজে দেয় না, তার উদাহরণ ইতালি।

কেন একজন যুগ্ম সচিবই শুধু নিয়মিত ব্রিফিং করছেন। পরিস্থিতি তো একরকম নেই। দিন দিন অবনতিশীল বলেই প্রতীয়মান হয়। বিশ্বের অনেক দেশ ও ওপরের দৃষ্টান্তগুলো বিবেচনায় নিয়ে আমাদের দেশেও শীর্ষ পর্যায় থেকে ব্রিফিং নয় কেন? হাইকোর্টের সামনে একটি সক্রিয় ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। আগামী ৫ এপ্রিল শুনানি। ৯ মার্চ হাইকোর্ট এক পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘আইইডিসিআরের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি প্রেস ব্রিফিং করেন। তাঁর বক্তব্য অধিকতর ইতিবাচক হওয়া কাম্য, মানুষ যাতে আতঙ্কিত না হয়।’ অবশ্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সদের ‘পলায়ন’ পর্বটি থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে। মানুষ কীভাবে সচেতন হবে এবং কী করা দরকার, সে বিষয়গুলো এবং সরকার কী পদক্ষেপ নিল, সেসব আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো দরকার।

মীরজাদী সেব্রিনার পূর্বসূরি পরিচালক মাহমুদুর রহমানের কাছ থেকেই শুনলাম, ২০০৬ সালে সিদ্ধান্ত (প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত) হয়েছিল, এ রকম অবস্থায় একটি পর্যায়ের পরে শীর্ষ পর্যায় থেকে ব্রিফিং হতে হবে। সংসদের বিগত অধিবেশনে করোনা–সংক্রান্ত একটি মুলতবি প্রস্তাব নাকচ হয়েছিল। আসন্ন বিশেষ অধিবেশনে মৌখিক নয়, লিখিতভাবে পূর্ণাঙ্গ করোনা-চিত্র ও ভবিষ্যৎ জীবাণু দমন যুদ্ধের রূপকল্প পেতে চাই।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]