প্রবাসে করোনার বশে: বাংলাদেশিদের দিনরাত

ভেনিস: দেশে নয়, ইতালিতে অন্তত চিকিৎসা পাব
পলাশ রহমান

ইতালির ভেনিসে থাকি অনেক বছর। এ মাটির সঙ্গে একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের পর এখন ইতালিকেই ভালোবাসতে ইচ্ছা করে। ইতালি এক অবারিত শান্তির দেশ। এ দেশের মতো সামাজিক নিরাপত্তা এবং আইনের সাম্য পৃথিবীর কম দেশেই আছে বলে বিশ্বাস করি। কারণ ইতালিতে যারা থাকেনি, এই আবেদন তারা অনুভব করতে পারবে না।

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়। পর্যটকমুখর ভেনিসে তখন বিখ্যাত কার্নিভাল চলছিল। গোটা পৃথিবী যেন ভেঙে পড়েছিল ভেনিসে। ভূমধ্যসাগরের পেট ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভেনিসের সরু খালগুলো আনন্দ আর উৎসবের নহরে পরিণত হয়েছিল। ঠিক এমন একটা সময়ে খবর বেরোল ভেনিসের পাশের শহর পাদোভায় একজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সরকারপ্রধান লুকা যাইয়া কার্নিভাল বন্ধ ঘোষণা করলেন। স্কুল-কলেজে ছুটি ঘোষণা করলেন। পর্যটকেরা ঝাঁক বেঁধে ভেনিস ত্যাগ করতে শুরু করল। কিন্তু তখনো হয়তো এর ভয়াবহতা কেউ আঁচ করতে পারেননি।

করোনা এখন ইতালিতে মহামারি আকার ধারণ করেছে। সোমবারও সাড়ে ৩০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ঘরে ঘরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ইতালীয়রা বাসার জানালায় পতাকা ঝুলিয়ে নিজেদের দৃঢ়তা প্রকাশ করছে। ছাত্রছাত্রীরা ঘরে বসে নানা রঙের ছবি আঁকছে। বড় কাগজে লিখছে, ‘আমরা হেরে যাব না। আমাদের মনোবল অটুট রেখে দুর্যোগ মোকাবিলা করব।’ সেগুলোও ঝুলিয়ে দিচ্ছে জানালায়। রাতের একটা নির্দিষ্ট সময়ে বাসার সব বাতি নিভিয়ে জানালায় সবাই মিলে মুঠোফোনের আলো ফেলে জানান দিচ্ছে, ‘আমরা বেঁচে আছি। আমাদের মনের আলো এখনো নিভে যায়নি।’

অভিবাসী বাংলাদেশিরাও এদিক থেকে পিছিয়ে নেই। সরকারের হোম কোয়ারেন্টিনের নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করছেন। তাঁরাও জানালা দিয়ে পতাকা ওড়াচ্ছেন। মুঠোফোনের আলো ধরছেন।

প্রতিদিনের চেনা চারপাশ কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেছে। পথঘাট, বাজার, মার্কেট, দর্শনীয় স্থানগুলো খাঁ খাঁ করছে। কোথাও কেউ নেই। অভিবাসীরাও অবসরে বাংলাদেশি দোকান, রেস্তোরাঁগুলোতে আড্ডা দেন না। বিশেষ দরকারে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করেন। কমিউনিটি–ভিত্তিক বা রাজনৈতিক কোনো মিটিংয়ে মিলিত হন না। মসজিদ বা নামাজের স্থানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে।

অভিবাসীদের মনে দুই রকমের ভীতি কাজ করছে। এখানে কী হবে, কী হবে না! কোথায় গিয়ে থামবে এই আগ্রাসী করোনা? প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আমরা সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এ ঘর থেকে ও ঘরে পালাচ্ছি। একজন অন্যজনের কাছ থেকে পালাচ্ছি। পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছি।

অন্য ভয় হলো, দেশের মানুষের কী হবে? দেশে সংক্রমণ বাড়লে কীভাবে ভালো থাকবে প্রিয়জন? আমাদের দেশের তো এত সক্ষমতা নেই!

সচেতন প্রবাসীরা কেউই এ সময়ে দেশে যাওয়ার কথা ভাবছেন না। তাঁরা মনে করেন কোনো কিছু হলে এখানে অন্তত শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ চিকিৎসা পাওয়া যাবে, যা বাংলাদেশে আশা করা যায় না।

আমার প্রতিবেশী একজন বাংলাদেশি ভাই আছেন। গেল সপ্তাহে হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন। আতঙ্কে দিশেহারা তাঁর স্ত্রী হাসপাতালে ফোন করার ঠিক সাত মিনিটের মাথায় তাঁদের বাড়ির নিচে অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়ায়। তিনি এখন সুস্থ। করোনায় আক্রান্ত হননি। অন্য কোনো কারণে বুকে ব্যথা হয়েছিল।

ইতালিতে এখন পর্যন্ত আমাদের কমিউনিটি নিরাপদ আছে। দুই-তিনজনের আক্রান্তের খবর সামাজিক মাধ্যমে ছড়াতে দেখা গেলেও তা নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত নয়। তবে গত দুই দিনে কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত আতঙ্ক থেকেও এসব মৃত্যু হতে পারে।

ইতালির সরকারপ্রধান যুজেপ্পে কোঁতে নিশ্চিত করেছেন, করোনা সংকটের কারণে কেউ চাকরিহারা হবে না। চাকরিজীবীরা ঘরে বসে দুর্যোগভাতা পাবেন। ছোট ব্যবসায়ীরাও মাসিক ভাতা পাবেন। ট্যাক্স-বিল মওকুফসহ আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে।

করোনা দুর্যোগ মাথায় নিয়ে যাঁরা দেশে গেছেন, যাচ্ছেন; তাঁদের মধ্যে একটা অংশ বিভিন্ন কারণে বাধ্য হয়ে যাচ্ছেন। অন্যদের মধ্যে আবেগ-আতঙ্ক বেশি কাজ করেছে। আমি মনে করি, যাঁরা বাধ্য না হয়ে ফিরছেন, তাঁদের মধ্যে সচেতনতার অভাব আছে।

পলাশ রহমান: ইতালি প্রবাসী

বনে ঘরবন্দী জীবন কাটছে
মারুফ মল্লিক
ভয়-আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। সবার মধ্যেই কী হয়, কী হয় এমন উৎকণ্ঠা। গত কিছুদিন ধরেই করোনাভাইরাস ধেয়ে আসছিল ইউরোপের দিকে। শুরুতে ইতালিতে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। এখন গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে। লোকজন বলাবলি করছে, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনের পর জার্মানিতে এর প্রকোপ বাড়বে। এ সপ্তাহে জার্মানিতে লাফ দিয়ে দিয়ে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বার, রেস্টুরেন্ট, নাইট ক্লাব, জিম—সব বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাস-ট্রামে উঠতে মানুষ ভয় পাচ্ছে। পথঘাট সব কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে।

বন শহরে থাকি প্রায় এক দশকের কাছাকাছি। এই শহরকে এখন নিজের শহর বলেই মনে হয়। জন্মশহর নারায়ণগঞ্জের বাইরে এই শহরেই এত দীর্ঘ সময় ধরে আছি। এর মাটি, জল, বাতাস অনেকটাই চেনা হয়ে গেছে। এখন কেমন যেন শহরটাকে খাপছাড়া মনে হচ্ছে। কখনো এমন পরিস্থিতি হয়নি। সুপারশপ থেকে সব নিমেষেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। রুটিও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। কাল রাতে বাড়ির কাছের সুপারশপে অনেক ঘোরাঘুরি করে দুটো ছোট রুটি কিনতে পেরেছে আমার ফ্ল্যাটমেট। টয়লেট পেপার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার আগেই উধাও। কয়েক দিন ধরে সুপারশপগুলোতে চালও পাওয়া যাচ্ছে না। যে যেভাবে পারছে, খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে মজুত করছে।

এখানে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। নতুন এক অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য। আমরা যারা বাংলাদেশি আছি, খাবারদাবার নিয়ে এখনো খুব বেশি বিপাকে না পাড়লেও ভয় কাজ করছে সবার মধ্যেই। ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত সবকিছু বন্ধ থাকবে। শুধু ওষুধ ও খাবারের দোকান খোলা থাকবে। এরপরও খাবার পাওয়া যাবে কি না, এই শঙ্কা কাজ করছে। ইতিমধ্যেই জার্মানির সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে খাদ্য আমদানিতে সমস্যা হতে পারে। কারোনা-সংকটের কারণে বিভিন্ন পণ্যের দামও বাড়ছে। বিশেষ করে তুর্কি ও এশীয় শপগুলোতে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে।

করোনার কারণে বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট শ্রমিক ও শিক্ষার্থীরা। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। একজন জানান, লোকজন কমে যাওয়ায় রেস্টুরেন্ট থেকে তাঁকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। তিনি বেতন পাবেন। কিন্তু অন্য কয়েকজন বেশ চিন্তায় আছেন। কাজ না করলে বেতন পাওয়া যাবে না। বেতন না পেলে এখানে মাসকাবারি খরচা ও দেশে অর্থ প্রেরণ নিয়ে ঝামেলা হবে বলে আশঙ্কা করছেন। শিক্ষার্থীদের অনেকেই ঘণ্টা ভিত্তিতে কাজ করেন। করোনার কারণে হোটেল, রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দিলে তাঁরাও বিপাকে পড়তে পারেন। তবে জার্মানিতে কোনো বাংলাদেশির আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়নি।

এখানে যাঁরা পরিবার নিয়ে থাকেন, তাঁরাও খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। ঘরবন্দী সময় কাটছে অনেকের। নিজেদের পাশাপাশি দেশ নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছেন। দেশে যদি করোনার প্রকোপ বেড়ে যায়, তবে দেশের আক্রান্ত ব্যক্তিরা পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাবেন কি না, এ নিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে চিন্তা কাজ করছে। বাড়ির জন্য মন পুড়ছে সবারই।

যা-ই হোক, এই ভয়াবহ দুর্যোগ নিশ্চয় কেটে যাবে। রাইনের তীরের চেরিগাছগুলো আবারও পুষ্পশোভিত হয়ে উঠবে। রোগ-শোক সরে যাবে জীবনের ক্যানভাস থেকে। আমার বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া ৯০-ঊর্ধ্ব যে বৃদ্ধার সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয়, তিনি আবারও রাইনের তীরে চেরিগাছের নিচে গিয়ে বসবেন। আমি তাঁকে গুঠেন ঠাগ (শুভদিন) বলব। নাইজেরিয়ার টনি তাঁর জার্মান বান্ধবী লিসার হাত ধরে শঙ্কাহীনভাবে হেঁটে যাবে। আমরা যারা ইউরোপে থাকি, ভয়াবহ এই দুর্যোগ কাটিয়ে নতুন দিনের সেই ভোরের অপেক্ষায় আছি। রোগমুক্ত একটি নতুন সূর্যের অপেক্ষায় আমরা সবাই। আমাদের জন্য সবাই প্রার্থনা করবেন।

মারুফ মল্লিক: জার্মানপ্রবাসী রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ডিসি মেট্রো এরিয়া: মনোবল কমেনি
মোস্তফা তানিম

১০ থেকে ১২ দিন আগে প্রথম করোনাভাইরাস ধরা পড়ল আমাদের এলাকায়। প্রতিবেশী অঙ্গরাজ্য মেরিল্যান্ডে। তারপর ঠিক আমাদের লোকালয়-নর্দার্ন ভার্জিনিয়ায়, তারপর ওয়াশিংটন ডিসিতে। এই তিন মিলিয়ে এলাকাটার নাম হলো ‘ডিসি মেট্রো এরিয়া’।

অঞ্জন ভাই ঘন ঘন ফোন করেন। কারণ, করোনার প্রাদুর্ভাব কত দূর গেল, সেটা নিয়ে তেমন নয়। কারণ হলো স্টক মার্কেটে ধস নেমেছে। একদিন মার্কেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে ১৫ মিনিটের মাথায় ‘ডাও’ ১ হাজার ৬০০ পয়েন্ট কমে গেল। প্রথম সার্কিট ব্রেকার ট্রিগার করল। তিনি বললেন, মার্কেট বন্ধ হয়ে গেছে, কেউ বেচাকেনা করতে পারবে না। এ আবার কী জিনিস! পরে জানা গেল, নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে সার্কিট ব্রেকার দেওয়া আছে, খুব বেশি কমতে থাকলে ৭ শতাংশ নামার পরে সফটওয়্যার আপনা–আপনি মার্কেট বন্ধ করে দেবে। সেই বন্ধটা থাকল ১৫ মিনিট। তারপর আবার খুলল, সেদিন স্মরণকালের ধস। বলছে, ১৯৮৭ সালের ব্ল্যাক মানডের পরে, এটাই এক দিনে সবচেয়ে বড় ক্ষতি।

তিনি যে স্টকের ব্যবসা করেন, তা নয়। ফোর-ও-ওয়ান-কে (4 O1 K) বলে একটা রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানে এত বছরে বেশ কিছু অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে তাঁর। সেটা রিটায়ার করার পর পাওয়া যাবে। সেই অর্থ অবশ্যই স্টকে বিনিয়োগ আছে। তাই স্টক কমলে সেই ভবিষ্যতের টাকা কমছে। মানুষের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে।

যাঁরা দীর্ঘদিনের চাকুরে, তাঁরা একজন আরেকজনকে বলছেন, কাল কি আরও কমবে? তলানিতে ঠেকল কি? এয়ারলাইনসের শেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই এক-দশমাংশ হয়ে যাবে? তেলের শেয়ার কমছে! সব তো কমছে? যাব কোথায়?

গত সপ্তাহে স্টার্লিংয়ের কস্টকোতে গিয়েছি। পেপার টাওয়েল এবং পানি দরকার ছিল। সেখানে একটা করে জিনিস কেনা যায় না। পেপার টাওয়েল কিনতে হয় ২৪টার এক বিশাল প্যাকেট, কিন্তু দামে অনেক সস্তা। এমনকি বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এখন থেকে কিনে নিয়ে গিয়েই খুচরা বিক্রি করছেন। প্লেন যে ঘরে রাখে, তাকে বলে হ্যাঙ্গার। কস্টকোর ভেতরটা প্লেনের হ্যাঙ্গারের মতো। তার শেষ অংশে পেপার টাওয়েল, টয়লেট পেপার ও পানির বোতল স্তূপ হয়ে থাকে। ২০ বছরে প্রথম দেখলাম, সেই জায়গায় কাঠের তাক ছাড়া কিছু নেই। সবাই এসে শূন্য জায়গাটা দেখছেন, তারপর মনে আশঙ্কা নিয়ে কার্ট ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছেন।

পরদিন সিএনএনসহ অন্যান্য মিডিয়ায় বড় করে এল, করোনার সঙ্গে টয়লেট পেপারের সম্পর্ক কী? সবাই এত কিছু থাকতে টয়লেট পেপার মজুত করছে কেন? এক সপ্তাহ পরে আজ আবার গেলাম। পেপার টাওয়েল এসেছে, পানি এসেছে, টয়লেট পেপার এখনো নেই। পেপার টাওয়েলের দাম দিতে গিয়ে সত্যি অবাক হতে হলো। দাম তো বাড়েইনি, উল্টো করোনার জন্য সাড়ে চার ডলার দাম কম রেখেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী লেখক আশিফ এন্তাজ রবি আমার প্রতিবেশী। তিনি বলছেন, আশ্চর্য ব্যাপার, বেশি টাকা দিলেও জিনিসটা পাওয়া যাচ্ছে না! যেটা নাই তো নাই, কিন্তু এক টাকাও দাম বাড়ছে না! অনেক দিন আমেরিকায় থাকার ফলে ব্যাপারটা আমি নিজে আশ্চর্য হিসেবে ধরতে পারিনি।

প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দুষ্প্রাপ্য হয়েছে। বাঘের চোখ পাওয়া যাবে কিন্তু হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা ফেস মাস্ক পাওয়া যাবে না। হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানানো যায় না? অঞ্জন ভাইকে ফোন দিতেই বললেন, অণু ভাই বানাচ্ছেন। তিনি আমাজন থেকে ‘আইসো প্রোপাইল অ্যালকোহল’ আর গ্লিসারিন অর্ডার করেছেন। ওগুলো এলেই নাকি বাসায় বসে বানানো যাবে।

বাঙালি দোকানে ফোন করলে ধরে বলত, ‘ভাই মাংস কয় পাউন্ড দেব? রেডি করে রাখি, কখন আসবেন?’ এখন ফোন বাজে, কেউ ধরে না। মাংস কেটে তারা কুল পাচ্ছে না। টিঙ্কু দুবার বিভিন্ন কারণে দাওয়াত বাতিল করেছে, এই শনিবারের দাওয়াত সে কিছুতেই বাতিল করবে না। আমি বললাম, শনিবার আসতে আসতে হয়তো ব্যাপারটা আমাদের হাতে থাকবে না। সে তাতেও অনড়। ঠিক শনিবার সকালে ফোন করে সে লজ্জিত গলায় বলল, ‘এই পরিস্থিতিতে দাওয়াত…মানে তানি বলল..।’ আমি ‘এটাই ভালো হয়েছে...’ বলে তাকে সান্ত্বনা দিলাম।

শনি-রোববারের প্রায় সব বড় দাওয়াত বাতিল হলো। তবে শনিবার একজন-দুজন করে কাছে-পিঠের পাঁচ-সাতজন আমার বাসায় চলে এল। বাসায় থেকে সবার হাঁপ ধরে যাচ্ছে। এসেই নিজেরাই আগে সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছে, কেউ না ধুলে তাকে অন্যরা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কেউ হ্যান্ডশেক করছে না। অনেককে কনুই দিয়ে ঠোকাঠুকি করতে দেখলাম। পানির বোতলে নিজেরাই নাম লিখে রাখছে, যেন অপচয় না হয়। আমার নিজের কিছুই বলতে হলো না।

চেনাশোনা সবার বাসায় পর্যাপ্ত খাবার আছে, আর আছে অনেক আশঙ্কা। কেউ কেউ বলছেন, আমাদের সবার করোনা হবে, হয়তো হয়েই গেছে। তবে মনোবল কমেনি কারও। করোনার মোকাবিলার জন্য ডিসি মেট্রো এরিয়ার সবাই প্রস্তুত। গৃহ-অন্তরীণ (লকডাউন) হওয়ার জন্য প্রস্তুত, খাদ্যসংকটের জন্য প্রস্তুত, আর জীবনযাত্রা বদলানোর জন্যও প্রস্তুত। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।

মোস্তফা তানিম: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী লেখক