শেষ নয়, সবকিছুর শুরু মাত্র

বছর দুয়েক আগে একটা খবরে পড়েছিলাম, বলিভিয়ায় একটা মুরগি কিনতে লাগছে ১৪৬টা টাকার বান্ডেল, দাম বলিভীয় মুদ্রায় ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। খবরটা পড়েই হাত-পা হিম হয়ে গিয়েছিল। এই নিয়ে তিনবার, গত ১২ দিনে তিন দিন বাজারে এসেও কোনো সবজি পেলাম না। মাছ-মাংস সবই আছে, সবজি নেই। ছেলের ভাঙা সাইকেলটা টেনে টেনে ফিরি বাড়ির রাস্তায়। রাস্তায় কোনো রিকশা বা গাড়ি নাই। হেলিকপ্টারের মতো ভোঁ ভোঁ করতে করতে কানের পাশ দিয়ে উড়ে চলে যায় একটা বোলতা... ওহ! বোলতা না, একটা মশা। এই ডেঙ্গুর শহরে বোলতার চেয়েও ভয়ংকর। এক লাফে উঠে বসি বিছানায়, ঘুম ভেঙে যায়। কয়েক দিন ধরে দেখছি স্বপ্নটা। একই স্বপ্ন। দেখার সময়ও বুঝতে পারি, এটা স্বপ্ন, তবুও দেখতে থাকি, এরপর কী হয় দেখার জন্য!

২০২০ কি সত্যিই তাহলে বিশে বিষ! মানুষের করোনা-আতঙ্কে ভেনিসের রাজহাঁস আর ডলফিনের ফিরে আসার খবরটা মিথ্যা জেনে মন খারাপ হয়ে যায়। চীনের উহানে যে হাতির দল মদিরা পান করে চা-বাগানের আলে ঘুমিয়ে ছিল বলে পড়েছিলাম, সেটাও নাকি সত্যি না। বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সবাইকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকাসহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় ও প্রবাসীদের সহযোগিতা চেয়েছেন। মুসলমানদের অন্যতম দিশারি দেশ সৌদি আরবের মক্কা-মদিনায় জুমার নামাজ স্থগিত রাখা হয়েছে। অথচ আমার বাড়ির উল্টোদিকের মসজিদে ঘোষণা দিল, ‘সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী মুসল্লিরা বাড়ি থেকে অজু করে আসবেন।’ যেন সমস্যা শুধু পানিতে, পাশাপাশি গায়ে গা লাগিয়ে নামাজ পড়ায় কোনো ঝুঁকি নেই! অথচ তিন দিন আগের খবর, অন্যতম মুসলিমপ্রধান দেশ মালয়েশিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ করোনা রোগী আক্রান্তই হয়েছেন তাবলিগের তাঁবুতে।

সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে একদিন হঠাৎ উল্কাপাত হয়েছিল। আর সেই উল্কাপাতে শেষ হয়েছিল ডাইনোসরদের ১৮ কোটি বছরের রাজত্ব, এই পৃথিবীতে। তারপর পৃথিবীকে একসঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে, একই মারণাস্ত্রে আঘাত করে এ রকম কোনো দুর্যোগ এর আগে ঘটেছিল কি? ২০১৪ সালে হলিউডে বানানো ড্যারেন আরনফস্কির ‘নোয়াহ’ ছবির ডায়ালগ মনে পড়ছে, ‘একদিন বাবা বলেছিলেন, মানুষ যদি তার স্বেচ্ছাচার চালিয়ে যায়, তাহলে ঈশ্বর একদিন এই পৃথিবী ধ্বংস করে দেবেন!’ ঈশ্বরের কাজ আমরা কমিয়ে দিয়েছি, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে হঠকারিতা চলছে অনেক দিন। ‘উহান ভাইরাস’ বা ‘ফরেন ডিজিজ’ বলে করোনাকে নিয়ে যারা কয়েক দিন আগেও ঠেলাঠেলি করছিল, সেই পশ্চিমে এখন প্রতিদিন মারা যাচ্ছে শত শত মানুষ, শহরের পর শহরে ঘোষণা করা হচ্ছে মহাদুর্যোগ বা কারফিউ।

১৯৯৬ সালে হলিউডে বানানো হয়েছিল ‘এক্সিকিউটিভ ডিসিশন’ ছবিটি। সাধারণ যাত্রীবাহী প্লেন নিয়ে ছুটে আসছে সন্ত্রাসীরা, লক্ষ্য আমেরিকার শহরতলি। ২০০১ সালে মার্কিনরা সত্যি হতে দেখল সেই ঘটনা। ২০১১ সালে স্টিভেন সোডারবার্গের ছবি ‘কন্ট্যাজিওন’ যার বাংলা ভাষান্তর ছোঁয়াচে—যেন আজকের করোনা-আক্রান্ত কোনো পশ্চিমা শহরতলি। অথচ ঢাকার মতো জনবহুল শহরে এমন একটা সময় চলছে নির্বাচন। নির্বিকার কমিশন! এক দিন আগেও খবরের স্ক্রলে দেখেছি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এ অবস্থায় নির্বাচন ঝুঁকিপূর্ণ! আর নির্বাচনের দিন কমিশন বলছে, ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়!

১৮ কোটি লোকের এই দেশে প্রতিদিন নাকি রোগী দেখেন ৯০ হাজার চিকিৎসক, আর তাঁদের জন্য আগামী ৩ মাসে দরকার ৫০ লাখেরও বেশি নিরাপত্তা গিয়ার! বাঙালি একসময় ‘একঘরে’ থাকাটা যতটা বুঝত, আজকে এই গ্লোবালাইজড পৃথিবীতে ততটা বোঝে না লকডাউন, আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টিন। ২ কোটি মানুষের শহরে ২৫টা হাত ধোয়ার বেসিন বসিয়েই মেয়র খালাস, যেটি আবার উদ্বোধনেই ভেঙে পড়ে। উন্মত্ত কেনাকাটা নিয়ে ট্রল করা শিক্ষিত ফেসবুক-শ্রেণি বোঝে না, বাঁধা মাসের খরুচে—তা সে মধ্যবিত্ত কি নিম্নবিত্ত যা-ই হোক না কেন—পেঁয়াজের ঝাঁজেই জেনে গিয়েছে যে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে তাকে বাঁচানোর কেউ নাই।

ফার্মেসিতে পাওয়া যাওয়ার কথা যে স্যানিটাইজার, সেটা বানাচ্ছেন নবীন শিক্ষার্থীরা। ‘নবাবজাদা’দের ওপর নাখোশ মন্ত্রীরা দেখছেন না কেরালায়, পশ্চিম বাংলায় রেশন দিচ্ছে সরকার। অন্তর্জালের বদৌলতে আজকের বিশ্বায়িত নাগরিকেরা শুনছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। জানছেন, তাদের নাগরিকদের বাড়ি ভাড়ার দায়িত্ব নিয়েছে কানাডা সরকার! আর এ দেশের মানুষেরা বুঝে নিচ্ছেন এই নতুন বিশ্বে তাঁদের নিজ নিজ অবস্থান। খুলনায় প্রবাসীর মৃত্যুর খবর চলছে টেলিভিশন স্ক্রলে। পরীক্ষার অভাবে জানা যায়নি তাঁর করোনা ছিল কি না।

মানিকগঞ্জ থেকে এক শুভাকাঙ্ক্ষী সংস্কৃতিকর্মী ফোন করে জানতে চাইলেন, আমরা সবাই চুপ করে আছি কেন? আমরা চুপ করে থাকব কত দিন? আমার কানে ভেসে আসে ‘নোয়াহ’ ছবির সংলাপ। নোয়াহর পুত্রবধূ চরিত্রে অভিনয়কারী এমা ওয়াটসন জানতে চাইছেন, ‘এটাই কি সবকিছুর শেষ?’ নোয়াহ চরিত্রে রাসেল ক্রো উত্তর দিচ্ছেন, ‘এটা সবকিছুর শুরু, সবকিছুর শুরু মাত্র!’

কামার আহমাদ সাইমন: স্থপতি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা