কেন এই অসম্ভব প্রতিযোগিতা

সম্প্রতি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার একটি এলাকায় হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী এক ব্যক্তিকে দেখতে উৎসুক মানুষ ভিড় জমান। ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার একটি এলাকায় হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী এক ব্যক্তিকে দেখতে উৎসুক মানুষ ভিড় জমান। ছবি: সংগৃহীত

সেরকম বুঝদার মানুষ এ দেশে কম। যথাসময়ে অনেকেরই কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে তাদের ভিড় থেকে আলাদা করা যায়। পড়াশোনা জানলেই যে কেউ বেআক্কেল হয় না—এমন প্রমাণ মেলে কম। না–বোঝার বা কাণ্ডজ্ঞান ভুলে থাকার এক অসম্ভব প্রতিযোগিতায় যেন নেমেছি আমরা!

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার একটি এলাকায় হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এক ব্যক্তিকে দেখতে উৎসুক মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন। গত বৃহস্পতিবার এ ঘটনার শুরু। পরদিন শুক্রবারও কৌতূহল মেটেনি। সেদিনও ওই প্রবাসীর বাড়ির সামনে স্বজন ও এলাকাবাসীর ভিড়। আচ্ছা, গণস্বাস্থ্যের দিক থেকে জরুরি একটি পরিস্থিতির মধ্যে কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া কি সুবোধের পরিচয় দেয়? না, এটা কোনো সুস্থ জ্ঞানের পরিচায়ক?

প্রবাসীকে দেখতে যেমন স্থানীয়রা ভিড় করছেন, তেমনি প্রবাসীরাও কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের সবার সামনে মেলে ধরছেন। এই যেমন, মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় হোম কোয়ারেন্টিন না মানায় সৌদিপ্রবাসী এক ব্যক্তিকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। রোববার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, সদ্য বিদেশ থেকে ফেরার পরও বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন মানছিলেন না তিনি। তিনি নাকি বাইরে ঘোরাফেরা করছিলেন। কি দরকার বাপু? আপদের কালে এভাবে ভ্রমণ না করলে কী হয়? এত প্রচারণাও পরও তিনি কি বুঝতে পারছেন না যে, অন্যদের নিরাপদ রাখার দায় তাঁর কাঁধেই আছে?

এ থেকেই বোঝা যায়, আমাদের বোধ কম। জরুরি কাজে অফিসে আসার পথে এমন দৃশ্য হরেদরে দেখা গেল। একজনকে দেখলাম কয়েক ডজন লেবু কিনে যাচ্ছেন। অনেকেই এখন ফ্লু থেকে বাঁচতে লেবু কিনছেন। বেশি কিনতে কিনতে দাম আকাশে তুলেও দিয়েছেন। যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে আসি। নাম না জানা ওই স্বাস্থ্য সচেতন (!) ব্যক্তি রাস্তায় নাক ঝাড়া শুরু করে দিলেন। যে ফ্লুয়ের তীব্রতা থেকে বাঁচার জন্য নিজে লেবু কিনছেন, সেই ফ্লু সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার মহান কর্তব্য (!) তিনি পালন করে ফেললেন অবলীলায়। ও হ্যাঁ, তাঁর মুখে মাস্কও ছিল। সেটি খুলেই এসব করেছিলেন তিনি!

আমরা মনে হয় একটি বিষয় বুঝতে পারছি না যে, শুধু নিজে বাঁচলেই হবে না। অন্যদেরও বাঁচাতে হবে। ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’—এই বহুল প্রচলিত প্রবাদে নতুন করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি মিলবে না। বরং অন্যরা নিরাপদ থাকলেই আপনি নিরাপদ থাকবেন। অতীতে নানন ঘটনায় আমরা নিজেদের স্বার্থপর চেহারাটা বারবার দেখিয়েছি। এখনো দেখিয়ে চলেছি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুতের প্রবণতায় গা ভাসিয়ে। এরপরও আশা থাকে। সেই আশায় উজ্জীবিত হয়েই ভাবছি, একদিন হয়তো আমরা বুঝব যে, নিজেদের থুতু-কফও অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে নানা রোগে।

তবে কিছু খবর সব আশার আগুনে পানি ঢেলে দিচ্ছে। রাজবাড়ী সদর উপজেলার ভবদিয়া গ্রামে গত শনিবার করোনাভাইরাস নিয়ে কথা-কাটাকাটির জের ধরে ঘটা সংঘর্ষে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। কথা-কাটাকাটির বিষয় ছিল—এক ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন নাকি অন্য কারণে। এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মারামারি করে যে আরেকজনের প্রাণ চলে গেল, তার হিসাব কার নামে উঠবে? হে গুজবপ্রিয় মানুষেরা, আপনারাই এই খুনের জন্য দায়ী। আর এই সংঘর্ষের ঘটনায় উভয় পক্ষের যে ১১ জন আহত হয়েছেন, তাদের প্রতি আহ্বান—মাথা ঠান্ডা করে একবার ভাবুন কি করেছেন। একটিবার ভাবুন। মস্তিষ্কের চর্চা দোষের কিছু না।

জনগণ যেমন হয়, সরকারও তেমনি হয়। এটি ঠিক, নতুন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গত কিছুদিন ধরে সরকার বেশ সচেষ্ট রয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশ—বিদেশফেরত ১৭ হাজার মানুষ কোয়ারেন্টিনে থাকলেও, আরও কয়েক গুণ অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গত জানুয়ারি মাস থেকেই কোভিড-১৯ নিয়ে নানা খবর জোরেশোরে শোনা গেছে। তাহলে তখন থেকেই কেন উপযুক্ত প্রস্তুতি নেওয়া হলো না? এখন কেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিদেশফেরতদের খুঁজতে হচ্ছে? শুধু একটি এলাকার কথা তুলি। প্রথম আলোর সংবাদে জানা যাচ্ছে, বরিশাল বিভাগে শুধু মার্চ মাসেই ১০ হাজারের বেশি লোক বিদেশ থেকে ফিরেছেন। এর মধ্যে শনিবার পর্যন্ত মাত্র ১ হাজার ৫৭ জন প্রবাসীর হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা গেছে। অধিকাংশকেই আলাদা জীবনযাপনের আওতায় আনা যায়নি। তাঁদের শনাক্ত করার জন্য এখনো কাজ চলছে। এঁরা সবাই তো নির্দিষ্ট কিছু গেটওয়ে দিয়েই দেশে ঢুকেছেন। ওই গেটওয়েতে যদি সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হতো, তবে কি এখন এত হুজ্জত পোহাতে হয়? পৃথিবীর যেসব দেশ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কিছুটা সফল হয়েছে, তারা কিন্তু এমন কঠোর পদক্ষেপেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে পারছে।

এত কিছুর মধ্যেও আশার ফুল হয়ে ফুটে থাকেন কিছু মানুষ। ওপরে যেহেতু বরিশালের পরিস্থিতি তুললাম, তাই তা দিয়েই শেষ করি। বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার শিহিপাশা গ্রামে একজন মিলিতা চৌধুরী (৩০) আছেন। এই ঘোর করোনাকালে তিনি নিজে মাস্ক তৈরি করে তা গ্রামের গরিব মানুষের মধ্যে কম দামে বিক্রি করছেন। একই সঙ্গে করোনার বিস্তার মোকাবিলায় সতর্ক থাকার পরামর্শও দিচ্ছেন। ৩০ টাকার মাস্ক অসহায়ের মতো ১০০ টাকায় কেনা এই অধমের কাছে এর চেয়ে মানবিক খবর খুব কমই আছে।

সারা দেশে এমন অনেক মিলিতা চৌধুরীর দেখা মিলুক। আমরা অস্থির না হয়ে, চিত্তচাঞ্চল্য না ঘটিয়ে স্বাভাবিক হই। সহজ কথায় সুবোধ হই। এতে তো আর পয়সা লাগে না।

অর্ণব সান্যাল: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]