বিশ্বটা যেভাবে পাল্টে যাবে

জনশূন্য নগরী, এক নতুন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব
জনশূন্য নগরী, এক নতুন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব

জার্মানির চ্যান্সেলর অাঙ্গেলা ম্যার্কেল ১৮ মার্চ দেশবাসীর উদ্দেশে এক ভাষণে করোনা সংক্রমণকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সবচেয়ে বড় সংকট বলেছেন। হয়তো নিজের দেশকে মাথায় রেখেই তিনি এই মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এটা সত্যি, ২০১৯–এর ডিসেম্বরের পরের পৃথিবী আগের মতো আর থাকছে না। পরিবর্তনটা হবে অস্বাভাবিকভাবে ভিন্ন এবং মৌলিক। নতুন অনেক কিছুর জন্য প্রস্তুত হতে হবে মানব প্রজাতিকে। কিছু কিছু পরিবর্তন স্থায়ী হয়ে উঠবে।

১৯৪৫ সালের মে মাসের আগের ও পরের বিশ্ব আলাদা হয়ে গিয়েছিল। করোনাভাইরাস মহাযুদ্ধের চেয়েও বেশি মাত্রায় চেনাজানা বিশ্বকে পাল্টে দিতে পারে। এই অর্থে করোনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে বড় ‘রাজনৈতিক ঘটনা’।

মুরব্বি দেশগুলো বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ

বিশ্বের বর্তমান জীবিত প্রজন্ম এ রকম সর্বগ্রাসী বৈশ্বিক দুর্যোগ আর দেখেনি। প্রতিদিনই কোভিড-১৯ ক্ষয়ক্ষতির চমক দেখাচ্ছে। এর শেষ কোথায়, আমরা কেউই জানি না। প্রাথমিকভাবে মনে হয়নি চীন এত দ্রুত ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এ–ও মনে হয়নি, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় বিপর্যয় এত ব্যাপক হবে। তুলনামূলকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ছিল ওই সব অঞ্চল। অথচ সেখানেই অস্তিত্বের সংকট তীব্র রূপ নিয়েছে। ইরানে সংক্রমণের ব্যাপকতারও কোনো উত্তর মেলেনি আজও। এটুকুই কেবল বোঝা গেল, যেসব দেশ ও সরকার আগে আগে সততার সঙ্গে সমস্যার রূঢ়তা চিহ্নিত করে সর্বোচ্চ মাত্রায় সক্রিয় হয়েছে, তারা ভাইরাসের আগ্রাসন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে এনেছে। অন্যত্র ঘটেছে উল্টো।

করোনার ক্ষয়ক্ষতি হলো চলতি দুর্যোগের মাত্র প্রথম পাঠ। ধাপে ধাপে এর পরের অধ্যায়গুলোও হাজির হতে থাকবে। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী এই শিক্ষা হয়েছে, মানবজাতির একাংশকে বিশুদ্ধ পানি ও ন্যূনতম স্যানিটেশন সুবিধাবঞ্চিত রেখে অন্যত্র সুস্বাস্থ্যের স্বর্গ বানানো যায় না। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ বিশ্বের মুরব্বি দেশগুলোর নেতারা করোনাকালে বিশ্বকে মোটেই নেতৃত্ব দিতে পারেননি। তাঁদের তরফ থেকে এমন একটি বাক্যও পাওয়া যায়নি, যা বিশ্ববাসীকে আশ্বস্ত করতে পারে। এটা বৈশ্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের পালাবদলের তাগিদ দিচ্ছে ভবিষ্যৎকে। অতীত মহামারির ইতিহাসেও এমন দৃষ্টান্ত আছে—অভিভাবকসুলভ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়ে বহু রাজত্ব নুয়ে পড়েছিল। তবে সব মহামারির শিক্ষা এক রকম নয়। এটাও অতীতেরই শিক্ষা।

আপাতত যা দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্র সময়মতো নিজের অনেক নাগরিকের ‘ভাইরাস টেস্ট’ করাতে পারেনি, পাশাপাশি নিজেও বৈশ্বিক ‘গভর্ন্যান্স-টেস্টে’ এত দিনকার অবস্থান হারিয়েছে।

দেশটির ডাকে ইউরোপ যুগের পর যুগ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে শরিক হয়েছে। অথচ ভাইরাস হানা দেওয়ামাত্র ওয়াশিংটন কোনো ধরনের মতবিনিময় ছাড়াই ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। বাকি বিশ্বের জন্যও কোনো দায় বোধ করতে দেখা যায়নি দেশটির প্রেসিডেন্টকে। এ পরিস্থিতি যেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে ‘স্প্যানিশ-ফ্লু’র কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই দুর্যোগে অস্ট্রিয়া আর জার্মানি শক্তিমত্তা হারিয়ে উত্থান ঘটেছিল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের।

তবে মহামারি কেবল রাজনীতিতে নয়, নাটকীয় পরিবর্তন আনে অর্থনীতিতেও। স্প্যানিশ-ফ্লুর পরই বিশ্বজুড়ে ফ্যাক্টরির ক্ষুধা মেটাতে নারীরা কাজে নেমেছিল। কোভিড-১৯ কী কী করবে, আমরা এখনো সামান্যই জানি তার।

অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের অবসান?

ডলার-পাউন্ড পকেটে নিয়ে পণ্য না পাওয়ার অভিজ্ঞতা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক নাগরিকের জন্য জীবনে এই প্রথম। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, সীমান্ত বন্ধ এবং জরুরি অবস্থার মতো ঘটনা। বিশ্বজুড়ে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে। অর্থনৈতিক গোলকায়নের জন্য এ রকম অবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে বিপর্যয়কর। বড় ধরনের মন্দার মুখে পড়েছে সমগ্র বিশ্ব।

সব দেশেই ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রণোদনার জন্য মরিয়া হয়ে প্রচার চালাচ্ছেন। কেউ চাইছেন নগদ সহায়তা, কেউ কর মওকুফ। পরিস্থিতি অভূতপূর্ব। ফলে তা অভূতপূর্ব সমাধান চিন্তাই দাবি করছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রীরা অধিকাংশ দেশেই হতবিহ্বল অবস্থায় আছেন।

রাষ্ট্রগুলো মদদ চাইছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির কাছে। এত দিনকার ‘সিস্টেম’-এর ত্রুটির দিকে কেউই অঙ্গুলি নির্দেশ করতে চাইছে না। কেন কথিত মধ্যম আয়ের একটা দেশ তার প্রধান সরকারি হাসপাতালেও পর্যাপ্ত মাস্ক দিতে পারেনি, সে নিয়ে ইতিমধ্যে গভীর প্রশ্ন উঠছে। এটা একটা কাঠামোগত সংকটই বটে।

বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য, প্রকৃতি ও পরিবেশকে অগ্রাহ্য করে কেবল পুঁজির স্বার্থ দেখার দীর্ঘ ঐতিহ্য এবার কেবল নৈতিকভাবেই নয়, কার্যকারিতার দিক থেকেও চ্যালেঞ্জে পড়েছে। মানুষের শরীর-স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিবেচনাকে বাদ দিয়ে যে কারখানা চালু রাখা যায় না, চীনে সপ্তাহের পর সপ্তাহ বন্ধঘোষিত শত শত কারখানা তার সাক্ষ্য হলো। কোভিড–১৯ থেকে বাঁচতে মাস্কপরা মানুষ উপলব্ধি করছে—তার এত দিনের উন্নয়নচিন্তায় বিশুদ্ধ পানি ও বিশুদ্ধ বাতাসের বিষয়টি বাদ পড়ে গিয়েছিল। যে কারণে, কোনো এক ভাইরাস
মানব প্রজাতিকে আক্রমণ করেছে বলার চেয়ে পুঁজিতন্ত্র মানবজীবনকে বিপদে ফেলেছে কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে।

আয়নায় সমাজের নগ্নতা দেখা গেল

করোনা–দুর্যোগের জনমিতি নিয়ে ইতিমধ্যে ব্যাপক আলাপ হচ্ছে। অনেক দেশে ষাটোর্ধ্বরা এই ভাইরাসে বেশি কাবু হয়েছেন। তবে এসব ছাড়িয়ে সামাজিক স্তরে যে বার্তা সবাই পেল, তা বিষণ্নতায় মোড়ানো। এত দিনকার বিশ্ব সমাজটি যে সংহতি, সহমর্মিতা, দূরদৃষ্টি ও সমবেদনায় মোড়ানো নয়; বরং লোভ, প্রতারণা ও ক্রুদ্ধ প্রতিযোগিতাময় ছিল, সেটাই টের পেল সবাই সুপারশপগুলোর খালি তাকের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ দেশেই এমনটি ঘটেছে। কোভিড–১৯ পুরো সমাজকে তাই আয়নার সামনে নগ্ন করে ফেলেছে।

মানসিক অসহায়ত্বই মানুষকে এমন আচরণ করিয়ে নেয়। অনেক বাড়িই করোনাকালে টিনের খাবার আর টিস্যু পেপারের ছোটখাটো গুদামঘরের রূপ নিয়েছে। শিগগিরই এই প্রবণতা কমবে না। কমার সুযোগ নেই। ‘সিস্টেম’ মানুষকে আশা জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে।

করোনা ধর্মচর্চার ক্ষেত্রেও কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে চলেছে। প্রায় সব ধর্মের প্রধান প্রধান সাম্প্রতিক জমায়েত ইতিমধ্যে স্থগিত বা বাতিল হয়ে গেছে। এসব আবার চালু হলেও বিপুল স্বাস্থ্যসতর্কতা ধর্মচর্চার অতীত রূপে নতুন অনেক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসবে। মুসলমানপ্রধান দেশে আসন্ন রমজানে করোনা থেকে সুরক্ষার ধরন কী করে সঠিকভাবে কার্যকর করা যাবে, সেটাও বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। অনেক দেশে শুক্রবারের জুমার জামাত ইতিমধ্যে স্থগিত হয়েছে।

একই অবস্থা শিক্ষায়। প্রায় ৭৫টি দেশে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে। অনেক দেশেই এ রকম বন্ধ বর্তমান মেয়াদ শেষে আরও বাড়াবে। করোনার পরও উচ্চশিক্ষা ক্রমে অনলাইনভিত্তিক হতে চলেছে।

এর চেয়েও রূঢ় পরিস্থিতির শিকার ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলো। আগামী জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় বিশ্বের সব বড় ক্রীড়ানুষ্ঠান ইতিমধ্যে বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। জুলাই-আগস্টে জাপানে অনুষ্ঠেয় অলিম্পিকের আসরও পিছিয়ে দেওয়া হবে বলে মনে হচ্ছে।

করোনা-জাতীয়তাবাদের কাল শুরু

যখনই বিদায় নিক, করোনা বিশ্বায়ন ধারণাকে নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে যাবে। করোনা দেখিয়েছে, এত দিনকার বিশ্বায়ন টেকসই নয়। এই বিশ্বায়নের কেন্দ্রে ছিল বাণিজ্যিক স্বার্থ, রাজনৈতিক যৌথতা নয়। করোনা বিশ্বায়নের অন্ধকার অংশে আলো ফেলে দিয়েছে।

করোনার সংক্রমণে রাষ্ট্রগুলো যেভাবে নিজ নিজ সীমান্ত নিয়ে সচেতন হয়ে গেল, তাতে স্পষ্ট, রাষ্ট্র উবে যাওয়ার প্রচারণা আর এগোবে না। খোদ ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন’ও এককভাবে এবার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি; বরং ইউনিয়নভুক্তরা একে অপরের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করার চেষ্টায় ছিল কঠোরভাবে। ইতিমধ্যে এই প্রবণতাকে ‘করোনা-জাতীয়তাবাদ’ বলা শুরু হয়েছে। এর আরও গোছানো রূপ দেখতে শুরু করব আমরা শিগগিরই। করোনাকালে আশপাশের দেশ থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার ভুচিস ইউরোপীয় ঐক্যের ধারণাকে একটা ‘রূপকথা’ বলে অভিহিত করে শোরগোল তুলেছেন। ইতালিও এবারের দুর্যোগে ইইউ সদস্যদেশগুলো থেকে প্রত্যাশিত সহায়তা পায়নি। এর একটা প্রতিক্রিয়া অনিবার্য ও আসন্ন। মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্বের কাঠামোগত ওলট–পালট ঘটতে চলেছে। যার ফলে আঞ্চলিক মেরুকরণ বাড়বে। যেসব দেশে ফেডারেল ব্যবস্থা ছিল, সেখানেও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন বাড়ার তাগিদ তৈরি হবে। আন্তর্দেশীয় খোলামেলা সীমান্তগুলো আর আগের মতো থাকবে না।

এসব প্রবণতা বিশ্বায়নের বিরুদ্ধেই যায়। এটা একটা শূন্যতা। ভূরাজনীতিতে এই শূন্যতা কীভাবে পূরণ হবে, আমরা এখনই তার পুরোটা জানি না।

 যুক্তরাষ্ট্র-চীন ঠান্ডাযুদ্ধে সরবরাহ চেইনের বিপদ

যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো সংস্থার আগে চীনের আলিবাবা আফ্রিকার ৫৪টি দেশে বিপুল পরিমাণ মাস্ক আর করোনা–পরীক্ষার সরঞ্জাম পাঠিয়ে আপাতত তার দেশকে বৈশ্বিক নেতৃত্বে এগিয়ে রাখল। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এত দিনকার বাণিজ্যযুদ্ধ করোনার পরে যে রাজনৈতিক যুদ্ধে রূপ নিতে চলেছে, তা ইতিমধ্যে স্পষ্ট। এই দুই দেশের ঠান্ডাযুদ্ধ করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টার গতি কমিয়ে দেবে। এটা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা নৈরাজ্যকর অবস্থাও তৈরি করতে পারে। অথচ এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক একটা স্বাস্থ্য অবকাঠামোর জরুরি চাহিদা দেখা দিয়েছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আপাতত আত্মসমর্পণ বোধ হয় ভবিতব্য। কারণ, দেশটির অ্যান্টিবায়োটিক বাজারে চীনের হিস্যা ৯৫ শতাংশ।

চীন-যুক্তরাষ্ট্রের উদীয়মান দ্বন্দ্ব সাপ্লাই চেইনের শুরুর বিন্দুতে থাকা বড় বড় উৎপাদকের কিছু কিছু কারখানা এমন সব নিরাপদ স্থানে সরাতে বাধ্য করবে, যেখানে ওই দ্বন্দ্বের আঁচ লাগবে না। 

পণ্যমূল্য ও বেকারত্ব—দুটোই বাড়তে পারে

করোনাকালীন অভিজ্ঞতা থেকে দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হওয়ার পুরোনো ধারণায় ফিরে যেতে পারে। বিভিন্ন
দেশ আন্তর্দেশীয় পণ্য চলাচলে স্বাস্থ্য সুরক্ষাজনিত বাধা অনেক বাড়াবে। এমনকি দেশে দেশে যানবাহন থেকে হোটেল পর্যন্ত ব্যবসা করতে
হলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এর ফলে পণ্যের দাম আগের চেয়ে বাড়বে। করোনা–পরবর্তী বেকারত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি যুক্ত হয়ে একটা কঠিন পরিস্থিতির আভাস দেয়।

আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুব খারাপ এক আগামীর প্রস্তুতি নিতে বলেছেন সবাইকে। সঙ্গে ৫০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে কাজে নামছে সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংকও ১২ বিলিয়ন ডলার তহবিল গঠনের কথা বলছে। আইএমএফ জানিয়ে দিয়েছে, বিশ্বের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন পুরোই অনিশ্চিত।

ভাইরাসের সংক্রমণ কবে কোথায় গিয়ে কমে আসবে, সেটা অনুমান করা দুঃসাধ্য হয়ে আছে। উপরন্তু এবারের সংকটে খোদ আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং ডলারকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার অকার্যকারিতাও দেখা গেল। ফলে এসব সংস্থার দেওয়া কিছু ডলার দেশে দেশে ব্যবসায়ী সমাজকে রক্ষায় সাহায্য করলেও দীর্ঘ মেয়াদে জনস্বার্থে সামান্যই কার্যকর হবে। যদি না অর্থনীতিবাদী অন্ধ প্রকৃতিকেন্দ্রিক পরিকল্পনাগুলো বদলানো না হয়।

ভাইরাস–ঝড় থামার পরই পুঁজি তার পুনরুত্থানের জন্য অটোমেশনের ওপর জোর দেবে এবার। কারখানা ও সাপ্লাই চেইন দুটোর অটোমেশন করা গেলে হবু ভাইরাস যুদ্ধগুলোকে এড়ানো সহজ হতে পারে। অটোমেশন যুগের ব্যাপকতা বাংলাদেশের মতো শ্রমজীবীনির্ভর দেশগুলোর জন্য খারাপ খবর। বিশ্বজুড়ে এশিয়া-আফ্রিকার শ্রমিক গ্রহণে স্বাস্থ্য বিবেচনা আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পেতে থাকবে এখন। অপ্রশিক্ষিত শ্রমিক গ্রহণের হারও কমে আসবে।

দোকানদারদের কাছ থেকে ‘বাজার’ চলে যাবে

করোনা শ্রমঘন শিল্পকে আমূল পাল্টে দিতে পারে। এ অবস্থায় উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তিকে কাজের নতুন সংস্কৃতিতে প্রশিক্ষিত করতে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মতো দেশগুলোকে বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে আগামী বছরগুলোতে।

সম্ভাবনার জায়গাটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। উৎপাদন ও বিপণনের ব্যাপকভিত্তিক এক অনলাইন যুগে ঢুকছে পৃথিবী। দোকানদারদের কাছ থেকে ‘বাজার’ চলে যাবে ‘ই-কমার্স’-এর দুনিয়ায়। ‘মল’গুলোর জন্য এটা দুঃসংবাদের মতোই শোনাবে। ঘরে ‘কাজ’ এবং অনলাইনে ‘বিক্রি’ শিখতে চলেছে শিগগিরই বিপুল শ্রমশক্তি। ঘরে থেকে শ্রম বিক্রি যেহেতু যাতায়াতের সময় বাঁচাবে, সে কারণে মানুষ অধিক ঘণ্টা কাজ করবে এবং এতে অনেক কোম্পানিতেই লোকবল কম লাগবে। এমনকি চিরায়ত ধাঁচের বিশাল আকৃতির কাঠামোগত ‘অফিস’ ধারণাটিও হুমকির মুখে পড়তে চলেছে বলেই মনে হয়। কেবল ‘ডিমান্ড সাইড’ যে ‘সাপ্লাই সাইড’কে পাল্টাবে তা নয়, উল্টোও হবে।

কর্মকর্তা পর্যায়েও আগের মতো মুখোমুখি বৃহৎ পরিসরে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চল উঠে যাবে। অনেক বিমান ভ্রমণের জায়গা করে নেবে স্কাইপে, টিমস ও ভিডিও কনফারেন্সিং। ঠিক একই কারণে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পর্যটনশিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি উপখাতকে বহুদিন সংগ্রাম করতে হবে। শিল্পপণ্যের বড় বড় প্রদর্শনী আগামী অনেক দিন অনলাইনেই হবে।

নজরদারি উপকরণের গবেষণা, প্রস্তুতি ও স্থাপনার কাজ অর্থনীতির এক প্রধান ‘শিল্প’-এ পরিণত হওয়া প্রায় নিশ্চিত হতে চলেছে। বলা বাহুল্য, চীনই এ ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকছে। তবে বায়োটেক গবেষণা এবং এ থেকে উৎপাদিত পণ্যের বিপণনে কিউবার মতো দেশগুলোও ‘চেঞ্জ মেকার’ হয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে কিউবার ওপর অবরোধ প্রত্যাহার করে নিজের এত দিনকার অবস্থান সংশোধন করতে পারে। সাধারণভাবে বড় বড় ওষুধ কোম্পানির জন্য আগামী দিনগুলো আশাবাদী হওয়ার মতো। তবে অনলাইনে চিকিৎসকদের মতামত নেওয়ার প্রবণতা বাড়বে। বিজ্ঞানের জগতে বংশগতিবিদ্যা, জীববিদ্যা, সংক্রামক রোগ নিয়ে পড়ালেখার গুরুত্ব বেড়ে যাবে।

নার্সিং ও বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবায় অধিক বিনিয়োগ বাড়ানোও এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। ভোটের হিস্যায় বিশ্বব্যাপী সিনিয়র সিটিজেনরাই বেশি, ফলে এ ক্ষেত্রে সম্পদ স্থানান্তর ঘটবে বলেই মনে হয়।

ভোগ ও জীবনযাপনের ধরন পাল্টাতে চলেছে

এত দিন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাকে যেভাবে দেখা হতো, এ ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আশা করা যায়। প্রতিটি সংকটই কিছু সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দেয়। খাবারে মানুষের শুচিবায়ু বাড়ার সম্ভাবনা আছে এবার। এর ফলে অর্গানিক ফুডের বাজার চাঙা হয়ে উঠবে। বিশেষ করে যেসব খাবার রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, সেগুলোর দিকে মানুষের আগ্রহ বাড়বে। মাস্ক পরার চেয়েও শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি থাকা যে অধিক জরুরি ছিল, সেটা করোনা ভালোভাবেই জানিয়েছে। ফলে ভোগের ধরন পাল্টাবে। জীবনযাপনের ধরনও। ‘লাইফস্টাইল’ জগতে তাই পরিবর্তন হবে ভূমিকম্পতুল্য। চীনে বন্য প্রাণী খাওয়া বন্ধের মধ্য দিয়ে এর সূচনা হয়েছে বলা যায়।

নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষায় শক্তিশালী অনেক দেশকে এবার মাস্ক ও সাধারণ মেডিকেল যন্ত্রপাতির জন্য অন্য দেশের দিকে হাত বাড়াতে হয়েছে। এ শিক্ষা মনে রেখে গতানুগতিক ধাঁচের প্রতিরক্ষা বাজেটের কিছু অংশ স্বাস্থ্য শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতের সামর্থ্য বাড়াতে ব্যয় করবে অনেক দেশ। দৃশ্যমান শত্রুর বদলে অদৃশ্য শত্রু প্রতিটি দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। সুতরাং বিশ্বজুড়ে শত্রু-মিত্রের পুরোনো ধারণাও পাল্টাতে বাধ্য। নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধনের মতোই অনলাইনের স্বাস্থ্যতথ্য সংরক্ষণ ভবিষ্যতে বাধ্যতামূলক হয়ে উঠবে অনেক অঞ্চলে।

একটা মিসাইল সংগ্রহের চেয়ে একজন ডাক্তার তৈরি যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সে সত্য বয়ে বেড়াচ্ছে করোনা–সাহিত্য। এর মধ্য দিয়ে সামরিক গৌরব অর্জনের চেয়ে কিউবার মতো জনস্বাস্থ্যের গৌরব প্রলুব্ধ করতে পারে নীতিনির্ধারকদের কাউকে কাউকে। তবে করোনার আগে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয় যে প্রয়োজনীয় মনোযোগ পাচ্ছিল এবং তার মোকাবিলা যেভাবে মানবসমাজের অগ্রাধিকার হয়ে উঠেছিল, সেই স্থানটি করে নিতে পারে এখন সরাসরি স্বাস্থ্য প্রশ্ন। এমনকি ব্যবসায়ীরাও সেই অর্থের বড় অংশ নিয়ে নিতে পারে। ইউরোপের দেশগুলো ইতিমধ্যে শিল্প ও ব্যবসা খাতকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহায়তার ঘোষণা দিচ্ছে। এই অবস্থা অ-রাষ্ট্রীয় পথে দরিদ্র দেশগুলোকে দেওয়া ধনী দেশগুলোর সামাজিক সহায়তাও কমতে পারে কিছুকালের জন্য। আবার নতুন সাহায্য চলে যাবে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করার প্রকল্পগুলোতে।

করোনা রাষ্ট্রীয় নজরদারি বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে

করোনাভাইরাস কেবল বিশ্বব্যবস্থার ধরনই নয়, হয়তো অনেক সামাজিক মূল্যবোধই আমূল পাল্টে দিতে পারে। নতুন ‘স্বাভাবিক’-এর পথে ২০১৯-এর ডিসেম্বরের আগের স্বাভাবিক অবস্থা হারিয়ে ফেলব আমরা। মহামারির অতীত ইতিহাস অন্তত আমাদের তেমন ধারণাই দেয়। তবে সামাজিক পরিবর্তনের ভবিষ্যৎটি অনুমান করা এখনো কঠিন। কারণ, ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়নের অতিপ্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বিশ্ব।

করোনামুক্ত থাকতে গোলার্ধজুড়ে মানুষ প্রতিদিনকার জীবনধারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাল্টে প্রমাণ দিল—উন্নত ও নিরাপদ জীবনদর্শনে তাদের প্রণোদিত করা মোটেই দুরূহ নয়। তবে বাস্তব প্রচেষ্টা সব সময় শুভবুদ্ধি দ্বারা চালিত হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। ইতিমধ্যে করোনা রাষ্ট্রীয় নজরদারি বাড়ার ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে। কেবল বর্তমান ধাঁচের বায়োমেট্রিক কলাকৌশলই নয়, মানুষের হাত ধোয়া পর্যন্ত নজরে রাখার দিকে যাবে ‘রাষ্ট্র’। কোনো কোনো দেশে কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্য বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা সব নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক হতে পারে ভবিষ্যতে।

চলাচল ও সমাবেশে স্বাধীনতার ধারণা আগের মতো আর শর্তহীন থাকবে না। মানুষের নিরাপত্তা এবং ‘নিরাপদ সমাজ’ গড়ার কথা বলেই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তাদের শারীরিক সংঘ এড়িয়ে অনলাইনভিত্তিক করার উদ্যোগ চলবে। অনেক দিন ধরে প্রযুক্তির রাজনীতি এ রকম উদ্যোগ চালাচ্ছিল। এবার সেটা প্রাতিষ্ঠানিকতা পাবে খানিকটা।

এতে গোলার্ধের পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্র ‘সমাজ’-এর ভূমিকা হ্রাসের ইঙ্গিত স্পষ্ট। ইতিমধ্যে শক্তিশালী হয়ে থাকা ‘রাষ্ট্র’ আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠবে তাতে। চীনের কর্তৃত্ববাদী শাসন মডেল করোনা প্রতিরোধে কার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ওপর অবশ্যই নতুন করে বিশেষ চাপ তৈরি হলো। উদারনৈতিক ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য সামনের সময়টা হবে কঠিন। তাকে রক্ষণশীল নতুন অনেক আইনের মুখে পড়তে হবে তাড়াতাড়ি। চীনা মডেলের ভক্তরা বলছেন, ভাইরাস–যুদ্ধটা জীববিদ্যার বিষয়—এর মোকাবিলায় রাজনীতিবিদ্যাকে দূরে রাখা উচিত। স্পষ্ট যে আমলাতন্ত্র আবারও অনেক দিন চালকের আসনে থাকবে।

এসব বিতর্কের মধ্যে ইতিবাচক একটা দিক দেখা যাচ্ছে, অনেক ভাষ্যকার করোনা–পরবর্তী বিশ্বে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের দিকে মানুষের বাড়তি মনোযোগেরও ইঙ্গিত করছেন। এটা বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাভাবনার নতুন এক যুগের দিকে নিয়ে যেতে পারে সভ্যতাকে। উপাত্ত-বিশ্লেষণই যখন মানুষকে প্রতিদিনকার করণীয় সম্পর্কে জানাবে।

গোলার্ধজুড়ে স্বাস্থ্যসচেতনতার নতুন তরঙ্গ

কোভিড-১৯–এর আগে ইউরোপ-আমেরিকা তার স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে গর্ব করত। তাদের একাংশ এখন ভাইরাস ছড়ানোর জন্য চীনসহ ‘বাইরের মানুষ’দের দায়ী করছে। এ রকম মনোভাব ভবিষ্যতে সেখানে এশিয়া-আফ্রিকার মানুষদের ‘নোংরা অপর’ জ্ঞান করার প্রবণতা বাড়াতে পারে। আবার নতুন ভ্যাকসিন উদ্ভাবনও শুরু হবে জোর কদমে।

ভাইরাসের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী স্থল, নৌ ও আকাশযানের চলাচল ধারণাতীতভাবে কমায়—প্রকৃতিতে দূষণ কমেছে ব্যাপকভাবে। এটা অন্য রোগ অনেক কমিয়ে আনতে পারে ভবিষ্যতে।

পুরো গোলার্ধে স্বাস্থ্য সচেতনতার একটা নতুন তরঙ্গ তুলেছে করোনা। এটাই সর্বশেষ এই মহামারি থেকে তাৎক্ষণিক সামাজিক লাভ। আর এ–ও তো জানাই, বৃষ্টির পরই রংধনু ওঠে এবং রংধনুতে এক-দুটি নয়, থাকে অনেক রং। কিন্তু এই মৃত্যু–বৃষ্টি কবে থামবে, আমরা এখনো তা জানি না। আবার কবে মানুষ উদ্বেগহীনভাবে আনন্দে অপরকে জড়িয়ে ধরবে, কবে মুখোশ খুলে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেবে সবাই, সে–ও অনুমান করা দুঃসাধ্য। এটা হতে পারে কয়েক মাস; বছরও। তবে নিশ্চিত যে মানুষ আবারও উঠে দাঁড়াবে। নতুন অভিজ্ঞতায়, নতুনভাবে। প্রতিটি বড় বিপর্যয়ের পর এমন হয়েছে।


আলতাফ পারভেজ গবেষক