করোনার দিনে পাবলিক পরীক্ষা

বিলাতে আমার এক বন্ধুর মেয়ে এবার ‘জেনারেল সার্টিফিকেট অব সেকেন্ডারি এডুকেশন’ বা জিসিএসই পরীক্ষার্থী। মে মাসে পরীক্ষা। কিন্তু এই করোনার দিনে পরীক্ষা কীভাবে হবে? পরীক্ষা স্থগিত হলে আবার কবে হবে, এসব নিয়ে আমার বন্ধু বিশেষ চিন্তিত ছিলেন। তবে দুই দিন আগে বন্ধুবর জানালেন, জিসিএসই ও এ লেভেল পরীক্ষা স্থগিত নয়, ‘বাতিল’ করা হয়েছে! পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হবে স্কুলের ‘মক এক্সাম’-এর নম্বর এবং পরীক্ষায় শিক্ষার্থীটি কোন গ্রেড পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সে বিষয়ে তার শিক্ষকদের মতামতের ভিত্তিতে।

বাংলাদেশে আগামী ১ এপ্রিল থেকে যে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল, তা স্থগিত হয়ে গেল। বেশ কয়েক বছর যাবৎ আমাদের পাবলিক পরীক্ষাগুলো অন্তত সময়মতো হচ্ছিল। করোনাভাইরাসের সমস্যা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে এই পরীক্ষা কবে নেওয়া যাবে, কে জানে। এই পরীক্ষা পেছানোর কারণে ভবিষ্যতে অন্যান্য পরীক্ষাও পেছানোর প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। 

বিলাতে এই পরীক্ষা বাতিলের বিষয়টা যে সবাই খুব পছন্দ করেছে, তা নয়। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও তাঁর বক্তৃতায় স্বীকার করেছেন, এই সিদ্ধান্তে অনেক শিক্ষার্থী-অভিভাবক হতাশ হবেন। কিন্তু বিদ্যমান জরুরি পরিস্থিতিতে এ ছাড়া উপায় নেই। এই সিদ্ধান্তের প্রভাব এ বছর যারা পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, শুধু তাদের ওপর পড়বে। পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়বে না। 

২. 

এখন আমাদের দেশে যুক্তরাজ্যের মতো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাটা সম্পূর্ণ পাবলিক-পরীক্ষানির্ভর। এখানে শিক্ষা ও পাবলিক পরীক্ষা পাস সমার্থক। তা ছাড়া, বিলাতের শিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের শিক্ষকদের ভূমিকা, গুরুত্বে ফারাক বিস্তর। যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য উন্নত দেশে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষার ও শিখন-মূল্যায়নের দায়িত্ব চলমানভাবে শিক্ষকের কাছে ন্যস্ত থাকে। তাই শিক্ষকেরা জানেন কোন ছাত্র কোন ‘অ্যাবিলিটি গ্রুপ’-এর, কে কোন বিষয়ে সবল, কোন বিষয়ে দুর্বল। শিক্ষকেরাই সিদ্ধান্ত দেন পাবলিক পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থী কোনো বিষয়ে ‘ফান্ডামেন্টাল পেপার’-এ পরীক্ষা দেবে না ‘হায়ার পেপার’-এ পরীক্ষা দেবে। আমাদের দেশের মতো স্কুল-কলেজে না এসে ‘কোচিং সেন্টার’-এ পড়ে পরীক্ষা দেওয়া সেখানে সম্ভব নয়। এ কারণে একজন শিক্ষার্থী সম্পর্কে শিক্ষকের মূল্যায়নের ওপর নির্ভর করা যায়। যুক্তরাজ্যের প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য, যুক্তরাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার তুলনা করা নয়। এর উদ্দেশ্য হলো, সেখানে স্কুলের শিক্ষার ও শিক্ষকের গুরুত্ব কতটুকু এবং এ কারণে এই দুর্যোগের সময় যুক্তরাজ্য কী সুবিধা পেল, তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা। 

বিশেষ কারণে আমাদের দেশেও পরীক্ষার বিষয়ে নানা সিদ্ধান্ত নিতে আমরা দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যারা স্কুলে পড়তাম, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবাই ‘অটো প্রমোশন’ পেয়ে বার্ষিক পরীক্ষা না দিয়েই ওপরের ক্লাসে উঠেছিলাম। কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে তেমন করা যায়নি। যুদ্ধের সময় যেসব পাবলিক পরীক্ষা হয়েছিল, স্বাধীনতার সময় সেসব পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়া হয়। আইয়ুব আমলে স্নাতক কোর্স তিন বছর থেকে কমিয়ে দুই বছর করতে তৃতীয় বর্ষ স্নাতক পাঠরতদের পরীক্ষা ছাড়াই ডিগ্রি দেওয়া হয়। কেউ কেউ এদের নাম দিয়েছিলেন মর্নিং গ্র্যাজুয়েট। কারণ, একদিন সকালে উঠে পত্রিকা পড়ে তাঁরা জানতে পারেন যে তাঁরা গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেছেন। 

পাবলিক পরীক্ষাই মূল্যায়নের একমাত্র উপায় বলে আমাদের দেশে সময়মতো একটি পরীক্ষা না হলে তার জন্য পরবর্তী পরীক্ষাগুলোও পেছাতে থাকে। জমতে থাকে সেশনজট। কখনো এই জট কমানোর জন্য তুঘলকি সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। আমরা যাঁরা ১৯৭৬ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করি, তাঁরা সামরিক সরকারের সিদ্ধান্তে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি হতে পারিনি। ভর্তি হই পরের বছর, পরের ব্যাচের অর্থাৎ ১৯৭৭ ব্যাচের সঙ্গে। 

৩. 

আমাদের দেশে কেন্দ্রীয় পাবলিক পরীক্ষার গুরুত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্কুল-কলেজে শিক্ষকের ভূমিকা হ্রাস পাচ্ছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করার পরিবর্তে ‘পাবলিক পরীক্ষা’ নামক বৈতরণি পার হওয়ার জন্য তাদের তৈরি করাকেই তাদের মুখ্য কাজ মনে করেন। শিক্ষা নয়, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলই এখন শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের একমাত্র লক্ষ্য। এ কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজ থেকে কোচিং সেন্টারকে, গাইড বইকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। কোচিং, নোট বই, গাইড বই বন্ধ করার জন্য সরকারি পর্যায়ে নানা প্রচেষ্টা সফল না হওয়ার এটি একটি কারণ। 

পাবলিক পরীক্ষার গুরুত্ব কমিয়ে আমাদের ক্রমান্বয়ে স্কুলে শিখনের ওপর এবং স্কুলভিত্তিক মূল্যায়নের দিকে যেতে হবে। এ কথা শুনে অনেকেই হয়তো আঁতকে উঠবেন। কারণ, ইতিপূর্বে এ রকম উদ্যোগে ফল হয়নি। কয়েক বছর আগে এসবিএ (স্কুলবেসড অ্যাসেসমেন্ট) পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। এতে স্কুলের শিক্ষকের মূল্যায়নের ওপর কিছু নম্বর রাখা হয়েছিল, যা মাধ্যমিক পরীক্ষায় যোগ হতো। আমি শিক্ষকদের কাছেই শুনেছি এই এসবিএ-কে শিক্ষার্থীরা নাকি নাম দিয়েছিল ‘স্যারের বাড়িতে এসো’। অর্থাৎ ভালো নম্বর পেতে হলে স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে হবে। 

নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়? সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতো আমাদের দেশের অনেক শিক্ষকের নৈতিকতায় ধস নেমেছে, এ কথা সত্যি। কিন্তু তবু শিক্ষকের ওপরই আস্থা রাখতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে তাঁদের উপযুক্ত করে তুলবে, উপযুক্ত পরিবেশ তাঁদের নৈতিকতার মান উন্নত হবে। তবে এর জন্য শিক্ষক নিয়োগ সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত করা ছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থাপনার খোলনলচে পাল্টে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষককে এর কেন্দ্রে স্থাপন করার বিকল্প নেই। 

চৌধুরী মুফাদ আহমদ প্রাবন্ধিক ও সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব