ট্রাম্পের হঠকারিতায় কাহিল যুক্তরাষ্ট্র

করোনাভাইরাস মহামারি যে বিশ্বব্যাপী আরও ব্যাপক আকার নিচ্ছে, তা গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা লক্ষ করলেই স্পষ্ট। যেসব দেশ আগে পদক্ষেপ নেয়নি, তারা এখন সবচেয়ে বেশি বিপদের মুখে পড়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে কতটা ভঙ্গুর এবং তা যে এই ধরনের মহামারি মোকাবিলায় অপ্রস্তুত ছিল, এখন তা দিবালোকের মতো সত্য হয়ে উঠেছে। সারা দেশে এখন সম্ভাব্য আক্রান্তদের পরীক্ষা করার মতো অবস্থা পর্যন্ত তৈরি করা যায়নি। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা অভিযোগ করছেন, তাঁদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম-মাস্ক, প্রটেক্টিভ গিয়ার দিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে এবং আগামী দিনে অবস্থার আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

মার্কিন প্রশাসনের এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন এই নিয়ে সব ধরনের পূর্বাভাস অগ্রাহ্য করেছে। এ ধরনের বিশ্বব্যাপী মহামারি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র অপ্রস্তুত, এই কথা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দুটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গোয়েন্দাদের এসব সতর্কবাণী গ্রাহ্য করেননি। উপরন্তু ট্রাম্প নিজে জানুয়ারি মাস থেকে এমন সব মন্তব্য করেছেন, সেগুলো দায়িত্বজ্ঞানহীন বললেও সামান্যই বলা হয়। এই প্রশাসন যে বিজ্ঞান ও তথ্যের চেয়ে নিজেদের বলা কথায় নিজেরা আস্থা রেখেছে, তার পরিণতি হয়েছে যে এখন সময়ের পেছনে পেছনে দৌড়াতে হচ্ছে। কিন্তু তাতে সাফল্য অর্জনের আগেই বড় রকমের মাশুল গুনতে হচ্ছে। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য লকডাউন থেকে শুরু করে বাড়িতে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। সেগুলোর সাফল্যের মাত্রা কতটা, সেটা নির্ধারণ দুরূহ। এই ধরনের ব্যবস্থা না নিলে কী ধরনের অবস্থা হতো, আমরা জানি না। কিন্তু সহজেই অনুমেয়, তা আরও ভয়াবহ রূপ নিত। এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প ছিল না। 

সংক্রমণ রোধে কেন্দ্রীয় সরকারের এখনকার গৃহীত ব্যবস্থা নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রতিদিনই সাংবাদিকদের জানানো হচ্ছে, তাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট উপস্থিত থাকছেন, সঙ্গে থাকছেন এই বিষয়ে টাস্কফোর্সের সদস্যরা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেস কনফারেন্স করতে অনীহ ছিলেন এবং দীর্ঘদিন তিনি প্রেস কনফারেন্স করেননি। অথচ তিনি এখন প্রতিদিন কথা বলছেন। তাঁর এই সব সংবাদ সম্মেলন গোড়াতে অনেককে আশ্বস্ত করলেও গত কয়েক দিনে তিনি স্বমূর্তি ধারণ করেছেন এবং এগুলোতে এমন সব মন্তব্য করছেন, যেগুলো তথ্যগত ভুল ও বিভ্রান্তিকর। তাঁর বক্তব্যে মনে হচ্ছে, করোনাভাইরাস আর গণমাধ্যম হচ্ছে তাঁর শত্রু। 

এর পাশাপাশি দুটি দিক এখন আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এর একটি হচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসন, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখনো স্বল্পমেয়াদি চিন্তাভাবনার মধ্যেই আছেন। দ্বিতীয়ত, এখনকার এই অপ্রস্তুত অবস্থার দায় প্রেসিডেন্টের কি না। 

সংবাদমাধ্যম পলেটিকো-তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, ট্রাম্প এখনো আশু ব্যবস্থা নিয়েই চিন্তিত, যেখানে দরকার হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি ও কম্প্রিহেনসিভ পরিকল্পনা। এত দিন পুরো কাজের সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিল স্বাস্থ্যবিষয়ক মন্ত্রণালয় হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিসের ওপর, গত সপ্তাহে তা ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি বা ফিমার ওপরে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো প্রশাসন বিস্তারিত কৌশল তৈরি করেছে বলে মনে হয় না। যে কারণে এখনো আশু দরকারি সরঞ্জাম নিয়েই চিন্তিত। হাসপাতালের অন্যান্য সাপ্লাইও যে শেষ হয়ে আসছে এবং এই নিয়েও যা ভাবা দরকার, তা এখনো বড়ভাবে বিবেচ্য হচ্ছে না। এই ধরনের স্বল্পমেয়াদি চিন্তার কারণেই তিনি এমন দাবি করেছেন যে করোনাভাইরাসের ওষুধ হিসেবে কিছু বাজার চলতি ওষুধ আছে। বিজ্ঞানীরা তাঁর এই দাবির সঙ্গে মোটেই একমত নন। অনেকের ধারণা, এই ধরনের দাবি বিপদ বাড়াবে। 

ট্রাম্পের বিষয়ে দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি আলোচনায় এসেছে তা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট কেন তাঁকে দেওয়া সতর্কবাণী উপেক্ষা করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট এই বিষয়ে ব্যাখ্যা দেননি যে কেন জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির গোয়েন্দা তথ্য উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন দাবি করেছেন যে একে প্যানডেমিক হিসেবে ঘোষণার আগে থেকেই তিনি জানতেন যে এটি প্যানডেমিক। কিন্তু ২২ জানুয়ারি বলেছিলেন যে এটি ‘সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে’। এরপর থেকে তিনি একে ছোট করে দেখিয়েছেন। এক মাস পাঁচ দিন পরে বলেছেন, ‘একদিন এটি উধাও হয়ে যাবে, একেবারে জাদুর মতো।’ ২৮ ফেব্রুয়ারি সাউথ ক্যারোলাইনাতে এক সমাবেশে তিনি করোনাভাইরাস বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়াকে সঠিক বলে দাবি করে বলেন, ডেমোক্র্যাটরা এই নিয়ে রাজনীতি করছেন এবং এটি হচ্ছে ডেমোক্র্যাটদের ‘ধাপ্পাবাজি’। ৯ মার্চ একে তুলনা করেছিলেন ফ্লুর সঙ্গে। তাঁর এই সব আচরণ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অবহেলা করার পরিণতি কী হয়েছে, তা এখন দেখা যাচ্ছে। 

স্মরণ করা দরকার যে ট্রাম্প প্রশাসন দেশের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের গ্লোবাল হেলথ অফিস তুলে দিয়েছিল। এই অফিসের দায়িত্ব ছিল ব্যাপক আকারে রোগ ছড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থার মোকাবিলার প্রস্তুতি। কেবল অর্থ সাশ্রয়ের নাম করে এই অফিস বন্ধ করে দেওয়া যে কতটা আত্মঘাতী হয়েছে, তা এখন দেখা যাচ্ছে। 

নেতৃত্বের ব্যর্থতা, বিজ্ঞানকে অস্বীকার, ভবিষ্যৎ পথরেখা বা প্রজেকশনকে অবহেলা করা, মহামারিকে ছোট করে দেখানো এবং যথাসময়ে পদক্ষেপ নিতে না পারার পরিণতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক ভয়াবহ বিপদ ডেকে এনেছে। বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এর অবস্থা দেখে মনে করাই দুরূহ যে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হলে তা কী করে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের এই সব আচরণ এখন প্রবলভাবে সমালোচিত হচ্ছে। গণমাধ্যমে পরিস্থিতির কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এই আলোচনাও প্রাধান্য পাচ্ছে যে এত খারাপ অবস্থার দায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিতে হবে। 


আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো