খালেদা জিয়ার মুক্তিতে কার কত লাভ

মুক্তির পর হাসপাতাল থেকে বাসার পথে খালেদা জিয়া। ছবি: হাসান রাজা
মুক্তির পর হাসপাতাল থেকে বাসার পথে খালেদা জিয়া। ছবি: হাসান রাজা


বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে দলের আন্দোলন ও আইনি লড়াই ব্যর্থ হওয়ার পর সরকার নির্বাহী আদেশে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানিয়ে বলেছেন, খালেদা জিয়ার বয়স, শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে সরকার শর্ত সাপেক্ষে তাঁকে মুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সরকার খালেদা জিয়াকে এমন সময়ে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, যখন সারা দেশ করোনাভাইরাসের কারণে অবরুদ্ধ। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে একজন প্রবীণ রাজনীতিকের, যিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করে এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন, তাঁর মুক্তির সংবাদ নিশ্চয়ই স্বস্তির। আমরা তাঁর মামলার গুণাগুণ বিচার করতে যাচ্ছি না। বিচারিক আদালতে দুটি মামলায় তিনি দণ্ডিত হলেও উচ্চ আদালতে তা বিচারাধীন আছে। এ অবস্থায় যেকোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাওয়ার অধিকার আছে। এর আগে সাবেক সামরিক শাসক এরশাদসহ আরও অনেককে একই ধরনের মামলায় জামিন দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে সবকিছু হয় রাজনীতির হিসাব–নিকাশে। তাই খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি নিয়েও রাজনীতি হওয়া অসম্ভব নয়। ইতিমধ্যে ক্ষমতাসীন দলের যে নেতারা কথায় কথায় আদালতের দোহাই দিতেন, তাঁরাই এখন ভিন্ন সুরে কথা বলছেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, দেশের এই সংকট মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বিএনপি আন্দোলন করে খালেদাকে মুক্ত করতে পারেনি। অতএব খালেদার মুক্তির কৃতিত্ব সরকারকে দিতে হবে।

অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, শর্ত সাপেক্ষে হলেও খালেদার মুক্তি নেতা-কর্মীদের জন্য স্বস্তির। তাঁরা তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগে ছিলেন। আইনমন্ত্রী শর্তের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হলো। এর মধ্যে তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। বাসায় বসে চিকিৎসা করতে হবে। একজন মুক্ত মানুষ কোথায় বসে চিকিৎসা করবেন, সেটি নিশ্চয়ই মন্ত্রী মহোদয় বলে দিতে পারেন না। আর বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা না থাকলেও খালেদা জিয়া এই মুহূর্তে যেতে পারছেন না। সারা দেশ লকডাউন। তিনি কোন দেশে যাবেন? যুক্তরাজ্যের পরিস্থিতি তো বাংলাদেশের চেয়েও নাজুক।

তবে রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি বৈঠকের খবর দেখলাম। এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করার জন্য দেশের কোনো নেতাকে পায়নি দলটি। স্কাইপে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। স্কাইপে এত দিন আমরা আলোচনার কথা শুনে এসেছি, পরামর্শ নেওয়া কিংবা দেওয়ার কথা শুনে এসেছি, এবারে সভাপতিত্ব করার কথা শুনলাম। বিএনপির বর্তমান দুরবস্থার জন্য সরকারের দমনপীড়ন যতটা দায়ী, তার চেয়ে কম দায়ী নয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের হঠকারিতা। এই সত্য বিএনপির নেতারা ব্যক্তিগত আলাপে স্বীকার করলেও প্রকাশ্যে কেউ এ নিয়ে কিছু বলেন না। বললে হয়তো মাহবুবুর রহমান কিংবা শমসের মবিন চৌধুরীর মতো দল ছাড়তে হবে। ‘মাননীয় যা বলেছেন ঠিক’—এই রাজনীতি যে দলে চলে, সেটি আবারও প্রমাণিত হলো।

খালেদা জিয়ার মুক্তিকে ক্ষমতাসীন দলের যে নেতারা এত দিন আইন-আদালতের বিষয়, সরকারের কিছু করণীয় নেই বলতেন, তাঁরা এখন কী বলবেন? অবশ্য আমাদের নেতারা সব কাজের পেছনে একটি যুক্তি দাঁড় করাতে অভ্যস্ত।

আওয়ামী লীগের যে নেতারা এখন খালেদা মুক্তি দেওয়ায় আওয়ামী লীগের লাভ খুঁজছেন। মনে করছেন, এতে সরকার রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে। তাঁরা দেশবাসীকে বলতে পারবেন, বিএনপি আন্দোলন বা আইনি লড়াই করে খালেদাকে মুক্ত করতে পারেনি। সরকার দয়াপরবশ হয়ে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দিয়েছে। হ্যাঁ, সরকার এ থেকে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে পারত, যদি আইন সবার জন্য সমানভাবে চলত। বিচারিক আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত এরশাদ কিংবা নাজমুল হুদা যদি জামিন পেয়ে মুক্ত মানুষ হিসেবে ঘুরে বেড়াতে পারেন (এরশাদ প্রয়াত হয়েছেন গত বছর। তাঁর যে মামলার কথা বলা হয়েছে, তা অনেক আগের), তাহলে খালেদা জিয়া জামিন কেন পাবেন না—এ প্রশ্নটিই করেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। আরও অনেকে। খালেদার বিরুদ্ধে একই ধরনের দুটি মামলা। একটি আদালত তাঁকে জামিন দিয়েছেন। আরেকটিতে দেননি।

তবে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম যে মন্তব্য করেছেন, তা বেশ কঠোর বলেই মনে হয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক করোনা পরিস্থিতির কারণে হাসপাতালে খালেদার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ, এই যুক্তি দেখিয়ে নির্বাহী আদেশে তাঁর মুক্তি চেয়েছিলেন। জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেছেন, এটি বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান। দণ্ডিত আসামি কোনোভাবে মুক্তি পেতে পারেন না।

আইনজীবী তাঁর মক্কেলের পক্ষে কথা বলবেন, এটাই রীতি। কিন্তু মক্কেল সব সময় ঠিক কাজ করছে কি না, সেটিও আইনজীবীর দেখার কথা। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। সেই সময়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানটি কীভাবে চলেছে, কার বিরুদ্ধে মামলা হবে, কার বিরুদ্ধে হবে না—এসব দুদক ঠিক করত না। করত সেনা–সমর্থিত সরকারের নেপথ্যের ক্ষমতাধরেরা। অনেক নামকরা আইনজীবী সে সময় সাগ্রহে দুদকের মামলা করেছিলেন এই ভেবে যে এবার দুর্নীতিবাজেরা ধরা পড়বে। আবার সে সময়ে নেপথ্যের ক্ষমতাধরদের চাপে অনেকে বিবাদীর পক্ষে আইনি লড়াই চালাতেও পারেননি। বর্তমানে দুদকের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানও বাছাই করা। এসব তথ্য ও সত্য নিশ্চয়ই দুদকের আইনজীবীর জানা আছে।

সরকারের সহৃদয়তা হোক আর করোনা সংকটের কারণে হোক, খালেদা জিয়ার মুক্তির সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে এটাও আশা করি যে করোনা সংকটের মতো দেশের রাজনৈতিক সংকটও দ্রুত কেটে যাক।

আপনারা রাজনীতির লাভালাভের হিসেবটা করার অনেক সময় পাবেন। এখন দেশের মানুষকে বাঁচান।


সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক