করোনাই শেষ নয়

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের মতো রোগের প্রাদুর্ভাব যে হবে, সেটা প্রত্যাশিতই ছিল। করোনাভাইরাস একটা সূচনামাত্র। আর এই সূচনা সামলাতে পুরো মানবজাতি হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু এমন আরও বহু রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব অপেক্ষায় আছে। আর তার ব্যবস্থা মানুষ নিজেই করে রেখেছে।

আমরা যত বে​শি পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থান ধ্বংস করে চলেছি, ততই বিভিন্ন ভাইরাসকে ​বাধ্য ক​রছি তাদের প্রাকৃতিক হোস্ট থেকে বের হয়ে পড়তে। তখন এসব ভাইরাসের নতুন হোস্ট দরকার হয়ে পড়ে। আর আমরাই একসময় তাদের হোস্ট হয়ে পড়ি।

বাস্তুসংস্থান ধ্বংসের কারণে বিভিন্ন ভাইরাসের এমন ছড়িয়ে পড়ার কথাগুলো বলেছেন ভ্রমণকাহিনিবিষয়ক লেখক এবং ‘স্পিলওভার: অ্যানিমেল ইনফেকশন অ্যান্ড দ্য নেক্সট প্যানডেমিক’ গ্রন্থের লেখক ডেভিড কোয়ামেন। তিনি বলছেন যে আমরা ট্রপিক্যাল ফরেস্ট বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন এবং অন্যান্য বন্য প্রাণীর আবাস ধ্বংস করছি। সেখানে রয়েছে অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদের বাস। আর এসব প্রাণী​র মধ্যে রয়েছে অসংখ্য অজানা ভাইরাস।

গাছ কাটা, প্রাণী হত্যা করা, প্রাণীদের খাঁচায় ভরে বাজারে বিক্রি করার মতো কাজগুলো আমাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই জায়েজ হয়ে আসছে। তবে নতুন নতুন ভাইরাসের আক্রমণের পেছনে মানুষের এই উন্নয়ন যে দায়ী, তা স্বীকার করতেই হবে।

এসব ভাইরাস প্রকৃতিতে আগে থেকেই ছিল। কয়েক দশক আগের সঙ্গে এখনকার পার্থক্য হলো বন্য প্রাণীর ব্যবসা এখন আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। বাসাবাড়িতে প্রাণী পোষা এবং বন্য প্রাণীর মাংসের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্য প্রাণীর বাজারও বড় হয়েছে।

পৃথিবীর বহু প্রাণীর মধ্যে বহু কিসিমের জীবাণু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। যাদের মধ্যে এদের বাস, তারা একে বহন করে, কিন্তু আক্রান্ত হয় না। যেমন: এক ধরনের বানর এইডসের জীবাণু বহন করলেও সে আক্রান্ত হয় না, আক্রান্ত হয় মানুষ। তেমনি করোনার মতো বহু ভাইরাস বিভিন্ন প্রাণিদেহে বসবাস করে। এসব প্রাণী যখন মানুষের সংস্পর্শে আসে, তখন সেগুলো মানুষের মধ্যে রোগবালাই ছড়ায়। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও তেমনটিই ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে প্রাণীবাহী ও অন্যান্য ছোঁয়াচে জীবাণুর প্রকোপ বেড়ে চলেছে। ইবোলা, সার্স, বার্ড ফ্লু, জিকা বা কোভিড-১৯ রোগ থেকে এসব গবেষণার সত্যতাও মিলছে। যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী নতুন আবির্ভাব হওয়া রো​গবালাইয়ের চার ভাগের তিন ভাগই আসছে বিভিন্ন প্রাণী থেকে।

যুক্তরাষ্ট্রের এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক টমাস গিলেস্পি গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎ​কারে বলেছেন যে তিনি করোনাভাইরাসের এমন ছড়িয়ে পড়ায় মোটেও আশ্চর্য হননি। তাঁর মতে, এখনো বেশির ভাগ জীবাণু আবিষ্কার করা হয়নি। বন্য প্রাণীর আবাস ধ্বংস এবং সেখানে বড় পরিবর্তন ঘটায় মানুষের আবাসস্থলে প্রাণীদের বিচরণ বেড়ে গেছে। তাই মানুষের সংস্পর্শেও তারা আসছে এখন ঘনঘন।

গিলেস্পির কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে করোনার মতো ঘটনা আসলে মহামারির একটা সূচনা। বুদ্ধিমান মানবজাতি প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে, নিজেকে অতি বুদ্ধিমান ভেবে সব প্রাণীকে তার অধস্তন করতে চেয়েছে। এখন নিজের ঘাড়ে নিয়ে এসেছে সব শোধের দায়।

বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে বলে যতই আমরা বিদ্যালয়ে শিক্ষা দিই না কেন, সেই শিশুরাই বড় হয়ে বন্য প্রাণীকে আর বনে থাকতে দিতে চায় না। নিজের ঘরে রাখতে চায়। আপাত এই নিষ্পাপ ভালোবাসার মধ্যেও যে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে, মানুষ হিসেবে বন্য প্রাণীকে নিয়ন্ত্রণ করার এবং অধস্তন করার ক্ষমতার স্বাদ আছে, মানবশিশু সেটা বোঝে না।

শিল্পায়ন আর প্রবৃদ্ধিপাগল উন্নয়নে পরিবেশ ধ্বংসের মাত্রা বেড়ে গেছে। মানুষ এখন ​বাস্তুসংস্থানের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষ ও বাস্তুসংস্থানের স্বাস্থ্যের মধ্যে যে সম্পর্ক, সেটা নিয়ে নতুন বিজ্ঞান শাখা রচিত হচ্ছে। তার নাম দেওয়া ​হয়েছে প্লানেটারি বাউন্ডারি।

এদিকে ​জীবাশ্মজ্বালানিনির্ভর উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে জমাট বরফ গলে যাচ্ছে। ফলে হাজার লক্ষ বছর আগে যেসব ভাইরাস ও রোগজীবাণু বরফের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল, ​সেগুলোর বের হয়ে আসার সুযোগ​ তৈরি হয়েছে। এত বছর আগের এসব ভাইরাস সম্পর্কে আধুনিক চিকিৎ​সাবিজ্ঞানের কোনো ধারণা নেই। ২০১৯ সালেই জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) বলেছে যে ১৯৭৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতি দশকে ১২ শতাংশ হারে বরফ হারিয়ে গেছে। সমুদ্রে বরফের এই পরিবর্তন গত এক হাজার বছরে দেখা যায়নি। সমুদ্রের বরফ গলে ভয়ংকর সব ভাইরাস সামুদ্রিক প্রাণীকে আক্রমণ করছে। আর এসব সামুদ্রিক প্রাণী ​থেকে মানবদেহে ভাইরাস আসাটা কঠিন কোনো বিষয় নয়।

রোগবালাই আর মহামারি প্রাচীনকাল থেকেই ইতিহাসের গতিপথ ব​দলে দিয়েছে। রাজনীতি, সমাজনীতি, সাম্রাজ্য—সবকিছুই বদলে দিয়েছে মহামারি। জনমানুষের ঘনত্ব যত বেড়েছে, এসব মহামারির ছড়িয়ে পড়াও তত সহজ হয়েছে। এসব ভাইরাস আক্রমণ করে মানুষের ফুসফুসে। দুঃখের বিষয় হলো আমাদের মতো দেশগুলোয় ক্রমাগত বায়ু দূষণের কারণে জন-ফুসফুস অনেকটা বিকল হয়েই আছে। আমাদের কাবু করতে করোনার বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা নয়; বরং করোনাকে কাবু করা আমাদের পক্ষে যে কতটা কঠিন, তার প্রমাণ আমরা হাড়ে হাড়েই টের পাচ্ছি। তাই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ চাই নাকি সহাবস্থান। কারণ করোনাই শেষ নয়। সামনে এমন আরও অনেক করোনা অপেক্ষমাণ।

খলিলউল্লাহ্‌: প্রতিচিন্তার সহ​কারী সম্পাদক।
[email protected]