'করোনা তো কী, মনে কইছে তুমি আইবা'

‘আজ আইতাম না, তুমি আসবা মনে কইরা আইছি। ভাই খাইতে গেছে, আমারে কইল তুই গিয়া ব। আমি তো মাছ কাটি না, বুঝছ, তোমার জন্যই আইছি। মনে কইছে, তুমি আজ আইবা।’ মাছ কাটতে কাটতে বলে ছেলেটা। ছবি: লেখক
‘আজ আইতাম না, তুমি আসবা মনে কইরা আইছি। ভাই খাইতে গেছে, আমারে কইল তুই গিয়া ব। আমি তো মাছ কাটি না, বুঝছ, তোমার জন্যই আইছি। মনে কইছে, তুমি আজ আইবা।’ মাছ কাটতে কাটতে বলে ছেলেটা। ছবি: লেখক

গতকালও যাদের দেখেছি আজ তাদের অনেকেই নেই। বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটা। মিডিয়াপাড়া আর কাঁচামালের আড়ত, বিধায় কারওয়ান বাজারে কিছু মানুষ তবু দেখা যেত। আজ তারাও যেন নেই। মেট্রোরেলে যারা কাজ করত, উন্নয়ন থমকে দিয়ে তারা উধাও। একজন নারী বাচ্চা নিয়ে বসে থাকত প্রগতি ভবনের পাশে, তাদের আর দেখি না। ওয়াসার সামনে হাঁটাচলা করা নির্ভীক পাগলটা শুধু শুদ্ধ ভাষায় কাকে যেন গালি দিচ্ছে। পরিচিত একটা ছেলে রেললাইনের বস্তিতে থাকে, একটা জিনিস খুঁজছিলাম, 'এনে দিচ্ছি' বলে টাকা নিয়ে চলে গেল। আর এল না। মানবজমিন কেমন খটখটে হয়ে উঠেছে।

'মনে কইছে, তুমি আজ আইবা'
মহাকালের বিকেল, কোথাও কেউ যেন নেই। সাইকেল ঘুরিয়ে মাছের বাজারের দিকে যাই। অল্প কয়েকটা দোকান খোলা। মাছকাটুয়া ছেলেটার সামনে মাছ নিয়ে অপেক্ষায় আছি। ২০ থেকে ২২ বছর বয়স। খুব শুকনা। তার সামনে দাঁড়ানো ১৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী একটা মেয়ে। মাস্ক থাকায় শুধু শান্ত চোখজোড়া দেখা যায়। মা কিংবা খালাজাতীয় কারও সঙ্গে বাজারে এসেছে। দুটি কাতলা কাটতে দিয়ে অন্য মাছ দেখতে গেছেন মহিলা। মেয়েটা কাটুয়ার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ইয়া বড় বটিতে মাছ কাটতে কাটতে ছেলেটা তাকে বলছিল, 'আজ আইতাম না, তুমি আসবা মনে কইরা আইছি। ভাই খাইতে গেছে, আমারে কইল তুই গিয়া ব। আমি তো মাছ কাটি না, বুঝছ, তোমার জন্যই আইছি। মনে কইছে, তুমি আজ আইবা।'

বলে আর ডান পাশে মুখ ঘুরিয়ে সরাসরি তাকায় মেয়েটার মুখের দিকে। মেয়েটা একবার পাপড়িজোড়া তুললে ছেলেটার দিকে, তারপর ফিরিয়ে নিয়ে তাকায় পাশের বরফ দেওয়া ইলিশের খাঁচির দিকে। ছেলেটার কথাগুলো পছন্দ করে কি না, বোঝা যায় না। বেচারির কাতল মাছটা অনেক বড়। ছেলেটা রয়েসয়ে আঁশ ছড়ায়, সময় নিয়ে ধীরে ধীরে কাটে আর বলে, 'মনে কইছে তুমি আইবা। বাজার তো আর বইত না, আইজ না আইলে কী যে হইতো!'

ঘুরে-ফিরে এই একটা কথাই বলে যায়, 'মনে কইছে তুমি আইবা, বুঝছ, তাই আইছি। ভাবছিলাম আইবা না, তাও তো আইলা। আবার কবে আহ না আহ কেমনে কমু। তাই আইছি। তোমাগো মাছটা ভালো পড়ছে বুঝছ, এর পরে আইলে আমারে দেখায়া নিবা, বুঝছ। তুমি আইছ বালা হইছে, না আইলে কী যে হইতো, বুঝছ।'

মেয়েটা কী বোঝে কে জানে। মলিন হলুদ সালোয়ার-কামিজ পরা তার লাজুক, আঁটোসাঁটো দাঁড়িয়ে থাকায় করোনার ভয় নেই, কৈশোর পেরোনো ব্রীড়া আছে, লজ্জা আছে, ঔৎসুক্য আছে।

মুখের দিকে দেখি
কিন্তু মুখ দেখা যায় না। কোনো এক ভাষায় ওরা আই লাভ ইউ বলে না, বলে 'আই সি ইউ'। আমি তোমাকে দেখি মানেই সেখানে আমি তোমাকে ভালোবাসি। করোনা আমাদের মুখ ঢেকে ফেলেছে ভয়ে, আমরা কমই দেখতে পাচ্ছি মানুষের মুখ। কেবলই অনিশ্চয়তা ভরা চোখ দেখি মানুষের। নির্দয় মুখ দেখি কর্তাব্যক্তিদের। নির্বিকার ভাষণ শুনি।

মুখ দেখেই তো মানুষ বিশ্বাস করতে চায়। শহীদুল জহিরের অসাধারণ উপন্যাস 'মুখের দিকে দেখি'তে মুখ মানে মায়ার ফাঁদ। সেই ফাঁদে আমৃত্যু আটকে থাকে মানুষ, এই ফাঁদ তারা ভালোবাসে। ফরাসি দার্শনিক ইম্মানুয়েল লেভিনাস মনে করেন, কেউ কাছে এলে মানুষ মুখের দিকেই প্রথমে তাকায়। মুখ—যা নগ্ন, অরক্ষিত ও নাজুক, যাকে বিশ্বাস করতে মন চায়। মানুষ প্রথমেই ভাবে, অপরের মুখকে কি বিশ্বাস করা যায়? অথচ প্রতিটি আনমনা মুখই কত নির্বিরোধী, কত সহজ। চরম খারাপ লোকের ঘুমন্ত মুখকেও সহজ লাগে। শিশুর মুখে স্বপ্ন দোলে বেহেশত দোলে। এই অনুভূতি থেকে তখন আমরা আবার মুখের দিকে দেখি, মায়া জাগে।

বলা হয় দৃষ্টি দুই প্রকারের, নাপিতের আর চর্মকারের। চর্মকার তাকায় পায়ের দিকে, নাপিত তাকায় মাথার দিকে। শ্রেণিবাদীরা মানুষের পায়ের দিকে তাকায়, জুতার মান দেখে শ্রেণি বুঝে নিয়ে আচরণ করে। মালিকদের তারা আরও ঋণ দেয়, অনুদান দেয়, কিন্তু ময়লা পা শ্রমিকদের ক্ষুধা-মহামারির মুখে আরও বেশি করে কাজ করতে বলে। মুখের দিকে তাকিয়ে মনের খবরটা তারা নেয় না। তাদের সেই চোখটা নষ্ট হয়ে গেছে।

'আল্লায় মাসটা কেমনে জানি চালায়'
ভাবতে ভাবতে সোনারগাঁও হোটেলের সামনে চলে এসেছি। একটা পিকআপ চলছে মাত্র। ফাঁকা রাস্তা ভিডিও করছে দুজন টেলিভিশন সাংবাদিক। তাদেরও ছুটি নেই। করোনার কালে যখন গাড়ি উধাও তখন আমার এই ঘোড়া টাইপ সাইকেলটা বের করে কাজ চালাচ্ছি। চালাতেও এখন বেশ আরাম। ফাঁকা রাস্তা।

বাংলামোটর মোড়ে তিনটা রিকশা নিয়ে বেকার তিনটা লোক বসে আছে। তাদের পার হতে হতে শুনলাম, 'আল্লায় মাসটা কেমনে জানি চালায়।'

একজন যুবক, একজন মধ্যবয়সী, আরেকজন প্রায় বৃদ্ধ। তাদের মুখের ছবি মনটাকে খোঁচাতে লাগল। পুলিশ রাস্তায় নামলেই পেটাচ্ছে। দরকার-অদরকার বিচার করছে না। এই শ্রমজীবী লোকগুলো এখন কী খাবে? তাদের মুখের দিকে কে তাকাবে?

ভার্চ্যুয়াল প্রেম
বাংলামোটর পেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়ে মগবাজারের রাস্তা। একটা পুলিশ যাচ্ছে আমার আগে আগে। তারও সাইকেল। পেছনের ক্যারিয়ারে লাঠি বাঁধা। এ রকম লাঠি-সাইকেলশোভিত পুলিশ অনেক দিন দেখিনি। প্যাডল চালাতে চালাতে ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটা কী যেন দেখছে। প্যাডল ঠেলতে ঠেলতে আমিও তাকাই। মুখে মাস্ক পরা এক তরুণী। একটু পৃথুলা, গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট আর টি–শার্ট পরা। অ্যাপার্টমেন্টের বাইরের গেটে দাঁড়িয়ে কাকে যেন বলছে, 'দ্যাখো, রাস্তা এক্কেবারে ফাঁকা।' বলে রাস্তার দিকে মোবাইল মেলে ধরায় দেখতে পেলাম, স্ক্রিনে দাড়িঅলা সুদর্শন এক ছেলের মুখ। করোনা প্রেমকেও মুঠোফোনবন্দী করে ফেলেছে, আহারে! কেবল মুখ দেখার তৃষ্ণায় কাতর এই জুটি আর কী করবে?

কালো গাড়ি থেকে দুজনকে দিয়ে গেল দুই পোটলা ত্রাণ।
কালো গাড়ি থেকে দুজনকে দিয়ে গেল দুই পোটলা ত্রাণ।

কালো গাড়ির দেবদূত
জনকণ্ঠ ভবনের উল্টা দিকে একটা কালো কার দেখি সন্দেহজনকভাবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। কালো কাচ তোলা। একটা রিকশা পাশ দিয়ে যেতেই কাচ নেমে গেল। ভেতরে মুখোশ পরা কয়েকটি ছেলে। রিকশাচালকও ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গেল। সন্দেহ নিয়ে তাকাই। রিকশাঅলাকে আবারও ডাকে তারা। কাছে এলে ভেতর থেকে একটা পলিথিনের ব্যাগ দেয়। এভাবে আরও একজনকে দিয়েই তারা ভোঁ করে চলে গেল কালো গাড়ির দেবদূতেরা।

এগিয়ে গিয়ে দেখি, পোটলায় প্রায় দু-তিন কেজি চাল, চিড়া, ডাল আর কী কী যেন। দুজন রিকশাঅলা পেলেন। একজনের বাড়ি ময়মনসিংহ, আরেকজনের ভোলায়। একজন যুবক, আরেকজন বৃদ্ধ। গাড়িঘোড়া না চলায় তাঁরা আটকা পড়েছেন, 'বাড়ি গিয়ে খাব কী?'
বললাম, কারও কাছে কিছু আশা করেন?
বৃদ্ধজন বললেন, 'কার কাছে আশা করতাম বাপ, সরকার কখনো দিলে না আশা করতাম।'
নীরব থেকে পেরিয়ে গেলাম অনিবার্য কিছু পাল্টা প্রশ্ন, যার উত্তর আমার কাছে নেই। রাস্তায় ব্লিচিং পাউডার ছিটানো পানির গন্ধ।
মনে হয় তারা হেঁটে হেঁটে অনেক দূর যাবে
সাত-আটজন নারী মগবাজার চক্করের রোড ডিভাইডারে বিকেলের রোদে মজমা বসিয়েছে। রোদ পোহাচ্ছে আর হল্লা করছে। রমনা উদ্যান আর মন্ত্রীপাড়ার হিমেল হাওয়া থানা পেরিয়ে এ পর্যন্ত আসে। শীতের আমেজ তাই যেন ফিরে এসেছে। ঝকঝকে আকাশের তলে বিকেলের রোদে নারীদের ফুলছাপা শাড়ি দেখে বিভ্রম হয়, যেন ছোটবেলার কোনো গ্রামীণ মেলা, খালাতো-মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি।

কবে আবার মানুষ হাসবে, মেলা বসবে, স্বাভাবিকভাবে মুখের দিকে তাকাবে, মৃদু মানুষেরা সুখ–দুঃখের ঘটনা নিয়ে জীবন কাটাবে।

মৌচাকের দিক থেকেও আসছে আরেক দল দিনমজুর নারী। মধ্যবয়সী, পান খাওয়া মুখ। ফাঁকা রাস্তায় যেন তারা বিহ্বল হয়ে হাঁটছে। জানলাম, এঁরা ইমারতের কাজে খোয়া ভাঙতেন। এখন বেকার। একজনের হাতে লম্বা একটা তক্তা। হয়তো কুড়িয়ে পেয়েছে। মনে হয় এটা নিয়েই তারা হেঁটে হেঁটে অনেক দূর যাবে।

মনে পড়ছে, অদ্ভুত সুরে গান গাইতে গাইতে দুজন অন্ধ ভিখারি বাড়ির সামনে দিয়ে যেত শুক্রবার সকালবেলা। কিশোর কুমারের মতো উদাত্ত গলার সুর শুনে মনে হতো, কে যেন খুব বিবাগী, তাই চলে যাচ্ছে। নিচে নেমে দেখতাম, একজন অন্ধকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আরেক অন্ধ। সেই থেকে লেখা:

অন্ধকারে আসি এক অন্ধকার ঢেউ
অন্ধের আঙুল ধরো আরও অন্ধ কেউ।
দৃষ্টিহীনেরা যদি একে অন্যের সহায় হতে পারে, তাহলে আমাদের যাদের অন্তত চোখ আছে দেখার, মুখ আছে বলার, হাত আছে করার; এই দুঃসময়ে আমরা কী করছি। ছোঁয়া বারণ, কিন্তু মানবতা তো নিষিদ্ধ নয় এখনো।

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]