বাংলাদেশ ব্যাংকের জাগরণ-সংগীত

বাঙালি হিন্দুরা শরতের দুর্গোৎসবের শুরুতে দেবীর অকালবোধন করে থাকেন—তাঁকে জাগরিত করেন পূজার জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংক তথা বিবির জন্য এ রকম অকালবোধন শুরু হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় দেখছি। শুনলাম বিবি জাগছে আস্তে আস্তে। এদিকে কয়েকজন অর্থনীতিবিদ অনেকটা নৈতিক তাড়না থেকে বেশ কিছু সুপারিশ তৈরি করেছেন, যেগুলোর মূল সুর একটাই—'যেভাবে পারো, ব্যাংকিং খাতে তারল্য ঢোকাও।' এই অনুভূতির সঙ্গে আর দশটা উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর বর্তমান কাজের মিল আছে। যদিও তারল্যের ওষুধ সেখানে আর কাজ করছে না।

আমাদের অনেক অর্থনীতিবিদ তাত্ত্বিকভাবে সঠিক—অন্তত মিলটন ফ্রিডম্যানের মুদ্রাতাত্ত্বিক অনুসারীরা তা-ই বলবেন। কিন্তু আমাদের সমস্যা অন্যখানে—প্রাতিষ্ঠানিক। এদিকটা ঠিক না করে কুম্ভকর্ণকে অকালে জাগিয়ে যুদ্ধে পাঠালে বিপর্যয় অনিবার্য। কারণ, চরিত্রগত খেলাপিদের কাছে সংবাদ এসে গেছে—তারল্য, অর্থাৎ নগদ টাকার বন্যা আসছে—এই সুযোগে লুটপাট করা যাবে। এযাবৎকালের অখেলাপিরাও লুণ্ঠন ক্লাবে নাম লেখাবে। অজুহাত তো প্রস্তুত—না চাহিলে যারে পাওয়া যায়—করোনাচালিত ব্যবসায়িক বিপর্যয় এবং মন্দাক্রান্ত বাজার।

এদিকে করোনা যেতে না যেতেই আরেক ভাইরাসের মতো তোপখানার সচিবালয় ঘিরে ধরবে রাঘববোয়াল ঋণগ্রহীতার দল। ঠিক ২০১৫-এর আদলে বিবিকে বানিয়ে দিতে হবে আরেকটি 'ঋণপূর্ণ কাঠামো নীতিমালা'। বড় খেলাপির বড় ছাড়। পাল্টে যাবে মন্দ ঋণের সংজ্ঞা। ঠিক যেমন আজকাল অর্থ খাতের অনেক সংজ্ঞাই পাল্টানো হচ্ছে। যেমন গ্রাসকৃত ঋণের ২ শতাংশ ফেরত দিয়েই 'নিয়মিত বা ভদ্র' পদবি পাওয়া কিংবা নয়-ছয়ের উদ্ভট সুদহারকে 'মডেল' ঘোষণা করা। তোপখানার তোপের সামনে বিবি তো সাক্ষীগোপাল। সমস্যা প্রাতিষ্ঠানিক—নেতৃত্ব দুর্বল। কখনো দুর্বল করে রাখা হয় ইচ্ছা করেই তীব্র আনুগত্য পাওয়ার লোভে। বিতাড়িত হয় একাডেমিক, পেশাদক্ষ মানুষ কিংবা গবেষক। এরই প্রতিফলন স্পষ্ট হয়ে ওঠে জ্ঞান অর্থনীতি বা উদ্ভাবন সূচকে আমাদের তলানিজাত অবস্থানে—যা করোনার চেয়েও করুণ।

মেধা ও আনুগত্যের মধ্যে একটা প্রাকৃতিক অদলবদল বা 'ন্যাচারাল ট্রেডঅফ' আছে। একটি বাড়লে আরেকটি কমে। এটা মেনে নিয়েই উন্নত বিশ্বের অর্থ খাতের সব প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে যোগ্য মানুষ বসানো হয়। যুক্তরাজ্যের মতো দেশও প্রয়োজনে কানাডা থেকে গভর্নর 'হায়ার' করে আনে। মার্ক কার্নি অর্থ খাতের একজন জ্ঞানী ও দক্ষ পেশাদার। একবার শুনেছিলাম, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজনকেও ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের নেতৃত্বে বসাবে।

আমাদের মতো একটি সম্ভাবনাময় উন্নয়নশীল দেশে অর্থ প্রতিষ্ঠানে মেধা ও জ্ঞানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত না করলে অর্থ খাত যৌক্তিক সুস্থতার পরিচয় দেবে না। তার প্রমাণ একটি স্থিতিশীল সরকার থাকার পরও এবং হরতাল-সংস্কৃতির অকালপ্রয়াণান্তে প্রবৃদ্ধির স্বর্ণযুগেও পুঁজিবাজারের নিত্য ধস ও খেলাপি ঋণের করোনাতুল্য বিস্তার। নিছক ম্যাক্রো অর্থশাস্ত্র থেকে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সমস্যা মাইক্রো অর্থশাস্ত্রীয়—মোরাল হ্যাজার্ড। প্রাতিষ্ঠানিক দৌর্বল্যে যা বাড়বে বৈ কমবে না।

করোনার কুরুক্ষেত্রে মন্দার সায়াহ্ন সর্বত্র। নর-দূরত্বায়ন ও আত্মবন্দিত্বের এই অভূতপূর্ব কলিকালে ভোগ চাহিদার দ্রুত পতন অনিবার্য। সেখানে বিনিয়োগ চাহিদার তেজ বর্ধনে তারল্যের শ্রাবণধারা কতটা যুক্তিযুক্ত? ভোগজাতীয় আয়ের ৭০ ভাগ আর বিনিয়োগ দখল করে ৩০ ভাগ। ভোগের তেজি ঘোড়া না টানলে বিনিয়োগের রথ চলে না। সে রকম একটা ভোগ দুর্বলতার অনিবার্য সময় সামনে রেখে বিনিয়োগ বাড়ার স্বপ্নে সুদের হার কমালে বা তারল্য বাড়িয়ে আমরা একটি তারল্য-ফাঁদের দিকে পা বাড়াচ্ছি কি না, তা ভাবা উচিত। এই ফাঁদে একবার পড়ে গেলে কি বিবি কি মুদ্রানীতি—সবই হয়ে যাবে নখদন্তহীন ব্যাঘ্র। জাপান এ রকম ফাঁদে পড়েই ২০ বছর গন্ডারের মতো কসরত করেও উঠতে পারেনি।

এ জন্য জন মেনার্ডকিনস মন্দাকালে 'লিকুইডিটি ট্র্যাপ'-এর ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। উপদেশ দিয়েছেন ওই সময়ে সরকারকে তত্পর হয়ে রাজস্ব নীতির অস্ত্রগুলো ব্যবহার করতে। সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা, এককালীন অনুদান, মধ্যবিত্তকে করের অত্যাচার থেকে মুক্তি দেওয়া বা সিলিং বাড়ানো, প্রত্যক্ষ নিয়োগ বৃদ্ধির প্রকল্প হাতে নেওয়া, অবকাঠামো নির্মাণ—ইত্যাকার কর্মকাণ্ডই এখন প্রশস্ত। এতেও তারল্য বাড়ে—কিন্তু তা সরকারের হাত দিয়ে যায়। সরকারকে বন্ড ইস্যু করে তারল্য কিনে নিতে হয় অথবা অনেক সময় অতেজস্বী মূল্যস্ফীতির সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত নোট ছাপাতে হয়। আর্থিক মুদ্রায়নের স্বার্থেও কিছু মুদ্রা অতিরিক্ত ছাপাতে হয়। রাজস্ব নীতির 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন' দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও পরিস্থিতিগত বেকারদের যেভাবে সাহায্য করতে পারে, মুদ্রানীতি তা পারে না। আমাদের দেশে আরও পারে না। কারণ, এখানে ব্যাংকিং এখনো তেলা মাথায় তেল দেওয়ার সংস্কৃতি ব্যাপক অর্থেই।

যদিও বিবির এই সাম্প্রতিক নিদ্রা প্রাতিষ্ঠানিক দৌর্বল্যের প্রতিভাস, অর্থাৎ তোপখানার তোপ এখনো এসে পড়েনি—তারপরও বলা যায়, আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ঝিমানো একেবারে অর্থহীন নয়। খামাখা দিগ্বিদিকশূন্য তারল্য বাড়িয়ে লাভ কী?

এর সুবিধা কারা নেবে? মূলত ওই অভ্যাসগত খেলাপিরা। কিছু উদীয়মান খেলাপিও ওই লুণ্ঠন ক্লাবে যোগ দেবে। করোনা পর্বের অবসানে ব্যবসায়ীরা হোটেলে বসে ফিরিস্তি দেবেন বিবির কী কী করা দরকার। ২০১৫-এর আদলে ঋণ পুনঃকাঠামো আসবে—বড়লোকের বড় ছাড়। নতুন সংজ্ঞা আসবে 'কালো'কে 'সাদা' বলার। এই লুণ্ঠন চক্র বাণিজ্যচক্রের চেয়েও সত্য। গভীর রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংস্কার প্রয়োজন। ছাপ্পান্ন সালের উপদেশ বা অভিজ্ঞতা আধুনিক ব্যাংকিং কাজে লাগে না।

অর্থনীতিবিদ গর্ডন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বের জন্য 'রেপুটেশন' বা 'সুখ্যাতি' মডেলের সুপারিশ করেছেন। এর জ্ঞানিক সাহসী নেতৃত্ব থেকে মানুষ যদি বুঝতে পারে এই কর্তাব্যক্তি কোন কোন প্রশ্নে ছাড় দেবেন না, তাহলে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরাও সেভাবে তাঁদের কর্ম ও প্রত্যাশা সাজিয়ে নেন। তবে এর পূর্বশর্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ার জেরোমি পাওয়েলকে কংগ্রেসে জবাবদিহির সময় জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, 'যদি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আপনাকে সরে যেতে বলেন, আপনি কি যাবেন?' তিনি সাফ 'না' জবাব দিয়েছেন। কারণ, প্রথমত তাঁর মেরুদণ্ড সোজা, দ্বিতীয়ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনি বল। কংগ্রেস না চাইলে খোদ রাষ্ট্রপতিও তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ব্যাংকিং খাতের প্রধানকে সরাতে পারেন না। সেই রাগে ট্রাম্প পরোক্ষ ভাষায় পাওয়েলকে কিঞ্চিৎ গর্দভ বা 'বোনহেড' বলতেও ছাড়লেন না। কখনো বললেন চীনের চেয়েও 'বড় শত্রু'। কিন্তু সরাতে পারলেন না। এ রকম প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিটি বড় পদে নিয়োগের আগে কংগ্রেসে ভালো রকম যাচাই করে নেওয়া হয়—কার জ্ঞান গভীর ও মেরুদণ্ড শক্ত।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে 'বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার' বানিয়ে দিয়ে গেছেন। তখন পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন ছিল—একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা বিনির্মাণের আকুতি। হালে অনেক বদল হয়েছে। বাজার অর্থনীতিকে চাঙা করতে হলে বাহাত্তরের বিধি অর্ডারের খোলস ছাড়তে হবে। বিবির অনেক কর্তা ও উপদেশকও এটা বুঝতে পারেন না। ২০০৩-এ এসে যে সংশোধনী আনা হয়েছে, সেটা অনেকে পড়লেও মানতে কাঁচুমাচু করেন। ভয় পান। কারণ, সেখানে অর্থমন্ত্রকের নিত্য খবরদারি অনেকটাই অপ্রয়োজনীয় করা হয়েছে। খাঁচার পাখিকে মুক্ত করলেও উড়তে চায় না। অন্যদিকে আমাদের দেশে অর্থমন্ত্রীরা যুগে যুগে ব্যাংক নিয়েই বেশি কথা বলেন। রাজস্ব দুর্বলতা চাপা পড়ে থাকে। রাজস্ব নীতির কর্তারাই সুদহার নিয়ে বেশি কথা বলেন—করহারের চেয়েও। অথচ সুদহার হচ্ছে বিবির খোকা। খামাখা ওকে নিয়ে টানাটানি করে আর সরকারি সঞ্চয়ে উচ্চ সুদ দিয়ে একটা বিনিয়োগ-বিতৃষ্ণ অলস সঞ্চয়ী সমাজ তৈরি করা হচ্ছে।

এর প্রমাণ পাওয়া যাবে করোনা-পূর্ব পরিস্থিতিতে। গত ডিসেম্বরে এক লাখ কোটি টাকার উদ্বৃত্ত তারল্যে ব্যাংকিং খাতে সাঁতার দিচ্ছিল। ঝিমিয়ে পড়েছিল ব্যক্তি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি। এখন করোনার ধাক্কায় ব্যক্তিঋণের নামে আরও তারল্য বাড়ালে তা বলবান করবে খেলাপি ঋণ ও মানি লন্ডারিং। তারল্য অবশ্যই বাড়ানো দরকার, সেটি ক্ষুদ্র ও নিম্ন মাঝারি খাতের ধমনিতে নিয়োগ বৃদ্ধিতে ও কৃষিতে। অর্থাৎ 'সিলেক্টিভ ইজিং'।

এ ক্ষেত্রে বিবিকে আরও শক্ত ও সচেতন হতে হবে। পূর্বগবেষণার ফলগুলো নিতে হবে। দুর্ভাগ্য, বিবিতে সবচেয়ে অবহেলিত বিভাগের নাম 'গবেষণা'। ও যেন সৎমায়ের বোবা ছেলে। করোনার পর সরকারকে ভাবতে হবে বিবিকে কীভাবে নতুন জ্ঞানিক আঙ্গিকে সাজানো যায়। কমিশনের ঠিকা দিয়ে কাজ হবে না। একে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা দিতে হবে—বিযুক্ত করতে হবে তোপখানার গ্রন্থি। বিবি দায়বদ্ধ থাকবে সংসদীয় কমিটির কাছে—ব্যাংকগুলোর কাছে। ভোক্তার কাছে ক্রেতার ও ব্যবসাবান্ধব সমাজের কাছে। নিয়োগের পরিসংখ্যানের কাছে মূল্যস্ফীতি ও সুদহারের কাছে। বাজারমুখী প্রতিযোগিতা ও প্রবৃদ্ধির স্বার্থে এটি আবশ্যক। তা না হলে মিডিয়া বা হাইকোর্টকে বারবার গাইতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য 'জাগরণ-সংগীত'। এটি কি শুভ লক্ষণ?

লেখক স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক। গ্রন্থ: এমপাওয়ারিং ইকোনমিক গ্রোথ ফর বাংলাদেশ। ই-মেইল:[email protected]