করোনার ভয়ে দূরে ঠেলার পরিণতি খারাপ

বাংলাদেশের গত কয়েক দিনের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, সাধারণভাবে কেউ জ্বর, ঠান্ডা কিংবা শ্বাসকষ্টের লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে গেলে তাকে করোনা সন্দেহে বেসরকারি ক্লিনিক, এমনকি সরকারি হাসপাতালগুলোতেও ভর্তি করা হচ্ছে না। পত্রিকা কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে বহু কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা ভুক্তভোগী অনেকেই লিখছেন। এ বিষয়ে মিরপুরের টোলারবাগে ডেলটা হাসপাতালে করোনায় মৃত ব্যক্তির সন্তানের হৃদয়বিদারক স্ট্যাটাসের কথা আমাদের জানা। সেখানে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা কীভাবে আইসিইউয়ের জন্য বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দারে দারে ঘুরেছেন, তার কথা আমরা জানি।

দৈনিক প্রথম আলোয় এ-সম্পর্কিত একটি খবর আসছে এই শিরোনামে ‘ঢাকায় এসেও করোনার পরীক্ষা করতে পারছেন না রাজশাহীর নার্স’। জ্বর-ঠান্ডা-কাশি-শ্বাসকষ্ট নিয়ে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার পরিস্থিতির অবনতি হলে প্রথমে রাজশাহী মেডিকেল এবং পরে ঢাকায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে এসেছেন এই ভুক্তভোগী নার্স। কিন্তু কোথাও করোনার পরীক্ষাও হচ্ছে না, এমনকি অন্যান্য ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা ও চিকিৎসাও পাচ্ছে না শুধু করোনা সন্দেহে।

সাধারণভাবে হাসপাতালে কাজ করেন এবং বিশেষভাবে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাকেন্দ্রে কাজ করেন—এমন ডাক্তার-নার্সদের সন্তান, পরিবারের সদস্যদের প্রতিও মানুষের নেতিবাচক মনোভাব আছে। তাঁরা অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হচ্ছেন। উপরিউক্ত দুটি ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখানে রোগী ও তাঁদের পরিবার এবং ডাক্তার-নার্স ও তাঁদের পরিবারবর্গ একই সঙ্গে সামাজিকভাবে স্টিগমাটাইজেশন বা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির শিকার। এ বিষয়ে ১৯৬৩ সালে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী আরভিং গফম্যান একটি বিখ্যাত বই লেখেন ‘স্টিগমা: নোটস অন দি ম্যানেজমেন্ট অব স্পয়েলড আইডেনটিটি’। আরভিং গফম্যানের কাছে ‘স্টিগমা’ হলো এমন একটি ব্যাপার, যেখানে একজন ব্যক্তি অন্যের কাছে মূল্যহীন ও ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়। যেখানে মানুষ সাধারণত নেতিবাচক গড়পড়তা ধারণা দ্বারা প্রভাবিত থাকে এবং এই স্টেরিওটাইপ দৃষ্টিভঙ্গির ফলাফল হিসেবে ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলার মানসিকতা এবং তাঁর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করার প্রবণতা থাকে। এই বৈষম্যমূলক আচরণ শুধু ব্যক্তির ওপর নয়, বরং তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। 


পাশ্চাত্যে গবেষকেরা বিশেষত অপরাধী, জঙ্গি-সন্ত্রাসী, ভবঘুরে, সমকামী, ভিন্নমতাবলম্বী বা নাস্তিকদের স্টিগমা নিয়ে অনেক গবেষণা করেন। যদিও ঐতিহাসিকভাবেই মহামারির কালে সংক্রমণকারী রোগী কিংবা বিশেষ ধরনের রোগের ক্ষেত্রে যেমন পাগল-কুষ্ঠ-এইডস রোগীদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করে তাদের ও পরিবারের সদস্যদের সামাজিকভাবে স্টিগমাটাইজেশন একটি পুরোনো রীতি। এ বিষয়ে ফুকো থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে সমাজবিজ্ঞানীরা অনেক লিখেছেন।

দ্বিতীয়ত, সারা দেশে প্রবাসীরা বিশেষ করে যাঁরা ইতালি, ইউরোপ কিংবা চীন থেকে এসেছেন, তাঁদের প্রতি মানুষের নেতিবাচক মনোবৃত্তি প্রকাশ্যে। বিদেশ থেকে আসা মানুষ ও তাঁদের পরিবারকে সন্দেহের চোখে দেখা সমগ্র বাংলাদেশেই একটি সাধারণ ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তবে যেসব অঞ্চলে ইতালি ও চীনপ্রবাসী বেশি, সেখানে তাঁদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা বেশি। দৈনিক প্রথম আলোয় শরীয়তপুর অঞ্চলের ইতালি ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা প্রবাসীদের মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক সংকট নিয়ে একটি রিপোর্ট হয়েছে, যা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক-বেদনাদায়ক ও সভ্য মানুষের জন্য তা একই সঙ্গে বিব্রতকরও।

রিপোর্টটিতে একজন ইতালিফেরত প্রবাসী জবানবন্দি হলো এমন, ‘...এলাকার মানুষ ভালো আচরণ করেন না, বাঁকা চোখে তাকান, এড়িয়ে চলেন। আমি সংক্রমিত নই—এটা কেউ বুঝতে চান না। এমন পরিস্থিতি হবে বুঝতে পারলে দেশেই ফিরতাম না’ (দৈনিক প্রথম আলো, ২৫ মার্চ ২০২০)। ওই রিপোর্টেই আরেকজন বলেছেন, ‘হোম কোয়ারেন্টিন শেষ হওয়ার পরও কেউ ভালো আচরণ করছে না, কটু কথা বলছেন।’ আমি মনে করি, বিব্রতকর ও বেদনাদায়ক পরিস্থিতির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে সরকারের অজ্ঞতাপ্রসূত কার্যকলাপের কারণে।

বিশেষ করে বিদেশফেরত প্রবাসীদের হাতে দেওয়া সিল ও তাঁদের বাড়ি চিহ্নিত করতে দেওয়া বিজ্ঞাপন বা নির্দেশগুলো তাঁদের সামাজিকভাবে প্রান্তিক অবস্থানে ফেলে দেয়। মধ্যযুগে বিভিন্ন অপরাধীদের চিহ্নিত করার জন্য এই প্রযুক্তি ছিল বলে আমরা জানি, কিন্তু তা আধুনিক কালে একেবারেই প্রশ্নবোধক। অপরাধবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী মাত্রই জানেন যে মানুষকে খারাপ তকমা দিলে তাদের মধ্যে পরে আরও অপরাধপ্রবণতা কিংবা বিচ্যুত আচরণ দেখা যায়। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী হাওয়ার্ড বেকার তাঁর আউটসাইডার (১৯৬৩) বইয়ে এই বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। তিনি দেখান, ‘কোনো ব্যক্তিকে সফলভাবে চিহ্নিত করলে পরে সে আরও বেশি বিচ্যুত আচরণ করেন।’

কোয়ারেন্টিনে থাকা রোগীরা কিন্তু হাসপাতাল, ক্যাম্প কিংবা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন, সে সম্পর্কেও প্রচুর সংবাদ ইতিমধ্যেই আমরা পাচ্ছি। এখানে সরকারে থাকা এমপি-মন্ত্রী-আমলা-রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দায় হলো যে তাঁরা যদি প্রবাসীদের এভাবে চিহ্নিত বা লেবেলিং না করে তাঁদের সঠিক প্রক্রিয়ায় নিরাপদ কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যবস্থা করতেন বা করোনাকে গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক সচেতনতামূলক কাজের উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারতেন, তবে প্রবাসীরাও নিশ্চয়ই তা মানতেন এবং গুরুত্ব দিয়ে বাসায় অবস্থান করতেন।

তৃতীয়ত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, শহরের অনেক এলাকায় নাকি করোনার কারণে বাসার কাজের বুয়া ও চালকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। খবরটি যদি সত্য হয়, তবে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও নিম্ন অর্থনৈতিক আয়ের মানুষের প্রতি তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব। নিম্ন অর্থনৈতিক আয়ের মানুষকে রুটিরুজির সংস্থান বন্ধ কিংবা কাজের সুযোগ সীমাবদ্ধ করার কাজ তাঁদের প্রান্তিকায়নের দিকে ঠেলে দেবে।

অপরাধবিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে আমরা জানি, দরিদ্র কিংবা আর্থিকভাবে সচ্ছল নয়, এমন মানুষের জীবিকার সংস্থানের ওপর আঘাত আসলে তারা ভিন্নতর আচরণ করবে অথবা ভিন্ন উপায়ে আয়-রোজগারের চেষ্টা করবে, যা আমাদের নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দেবে।

তাই আমাদের সরকার, সচেতন নাগরিক মহল ও সাধারণ জনগণকে উপরিউক্ত বিষয় বিবেচনা করে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের কলঙ্কিত ও প্রান্তিকায়ন না করে তাদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। শুধু সন্দেহবশত করোনা বলে চিহ্নিত না করে তাদের সেবার অধিকার নিশ্চিতকরণ, সত্যিকার অর্থে আক্রান্ত রোগীদের পরীক্ষার আওতায় আনা ও যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া এবং এসব রোগী ও তাদের পরিবারের প্রতি মানবিক আচরণের পাশাপাশি ডাক্তার-রোগী এবং নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল মানবিক আচরণ অত্যন্ত জরুরি ও প্রত্যাশিত।

মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সন্তোষ, টাঙ্গাইল।
[email protected]