করোনা মোকাবিলা: নাগরিক সুরক্ষা ও মহামারি আইন

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।  ছবি: প্রথম আলো
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ছবি: প্রথম আলো

মহামারি মোকাবিলার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালের অক্টোবরে তড়িঘড়ি করে ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮’ নামে একটি আইন পাস করে। আইনটি যে বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় ও অকার্যকর, তা মাত্র ১৭ মাসের মাথায় প্রমাণিত হচ্ছে। এই আইনে মহামারি নিয়ন্ত্রণের সব দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। আইনটির ৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীন দায়িত্ব পালন এবং কার্য-সম্পাদনের জন্য মহাপরিচালক দায়ী থাকিবেন।’ ৬ ধারায় একটি উপদেষ্টা কমিটির বিধান রাখা হয়েছে, যার প্রধান হবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী। উপদেষ্টা কমিটিতেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আছেন, তবে তাঁর অবস্থান দশ নম্বরে। মহামারির ব্যাপকতা, জনস্বাস্থ্যের প্রতি সৃষ্ট হুমকির মাত্রা এবং তা মোকাবিলায় পুরো দেশের অর্থনীতি ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বন্ধ করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত কি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সত্যিই নিতে সক্ষম? মহাপরিচালকের মাথার ওপর আছেন অতিরিক্ত সচিব, সচিব ও মন্ত্রী।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার সপ্তাহখানেক পর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজনগুলো কাটছাঁট হওয়ায় প্রথম বোঝা গেল, সমস্যাটির গুরুত্ব সরকার কিছুটা হলেও উপলব্ধি করছে। কিন্তু তখনো বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরগুলোতে শুধু তাপমাত্রা মাপা ছাড়া আর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের আদেশে বিমানবন্দর বা অন্যান্য গণপরিবহনে কতটা কড়াকড়ি আরোপ করা সম্ভব, সে প্রশ্ন নিশ্চয়ই অবান্তর নয়।

গণছুটি ঘোষণা করে লোকজনকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উপদেশ দেওয়া শুরু হলো, কিন্তু এই ছুটিকে বিপুলসংখ্যক মানুষ গণছুটিই ভেবেছেন। এ সময়ে ঢাকা ছেড়েছেন এক কোটি দশ লাখ মোবাইল গ্রাহক। ফলে যে রোগের লক্ষণ সহজে দেখা যায় না, সেই সুপ্ত ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর বদলে তার বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। সরকারি নির্দেশনায় অনেক অস্পষ্টতার মধ্যেই দেখা গেল প্রশাসন আর পুলিশের বলপ্রয়োগের মতো অযৌক্তিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে বেআইনি কার্যক্রম।

ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) না পাওয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উদ্বিগ্ন চিকিৎসকেরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আকুতি জানাচ্ছেন—এমন সময়, ২৫ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব এক স্মারকপত্র জারি করেন; কোনো হাসপাতাল বা সেবাকেন্দ্র সাধারণ রোগীকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তা সেনাবাহিনীর টহলপোস্টে দায়িত্বরত কর্মকর্তা অথবা নিকটস্থ থানায় জানাতে বলা হয়। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গভীর রাতে তা প্রত্যাহার করে আরেকটি স্মারকপত্র জারি করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন পরিচালক। পরের দিন স্বাস্থ্যসচিব প্রথম চিঠি জারির বিষয়টিকে কিছু কর্মকর্তার মূর্খতা বলে অভিহিত করেন। মহামারিবিরোধী লড়াইয়ের সামনের সারিতে যাঁদের থাকার কথা, তাঁদের সুরক্ষার বিষয় নিয়ে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের এই দুটো চিঠিতে আইনগতভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের অবস্থান কোথায়, তা বুঝতে কষ্ট হয় না।

মহামারির লক্ষণ ছাড়া অন্যান্য রোগ বা অঘটনের জরুরি চিকিৎসায় যে অভাবিত অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তার কারণ কী? সরকারের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা থেকে কোনো নাগরিককে বঞ্চিত করা সংবিধান পরিপন্থী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একের পর এক ছয়টি হাসপাতালে প্রত্যাখ্যাত হয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন। অঘোষিত লকডাউনের কারণে প্রান্তিক ও সহায়–সম্বলহীন মানুষ যে দুর্ভোগে পড়বে, তা লাঘবের ত্রাণ ঘোষণায় পার হয়েছে প্রায় এক সপ্তাহ। ১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতে চার ঘণ্টা সময় দিয়ে লকডাউন ঘোষণা করায় কোটি কোটি খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগের ফলে সমালোচনার মুখে ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছেন যে এর কোনো বিকল্প ছিল না।

মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বমানের প্রস্তুতির দাবি করলেও বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত একমাত্র কার্যকর কৌশল সম্ভাব্য ভাইরাসবাহীকে চিহ্নিত করার ‘টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট’–এর ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা আছে এবং সরকার নিজেদের মতো চলছে। সমকাল পত্রিকার হিসাবে ২৮ মার্চ পর্যন্ত সরকারের হটলাইনে পরীক্ষার জন্য যোগাযোগ করেছেন আট লাখের বেশি মানুষ। বিদেশফেরত বা বিদেশিদের সঙ্গে মেলামেশার কথা না বললে পরীক্ষা না করার পরিণতিতে টোলারবাগের দুজনের মৃত্যু এবং তাঁদের চিকিৎসকদের কোয়ারেন্টিনের কথা আমরা সবাই জানি। করোনা আক্রান্ত সন্দেহে মানুষ অচ্ছুত হচ্ছেন। এমনকি, তাঁদের চিকিৎসা এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। মৃত ব্যক্তিকে কবর দিতেও বাধা পাচ্ছেন। কিন্তু লক্ষণযুক্ত ব্যক্তি সত্যিই করোনা আক্রান্ত, নাকি সাধারণ সর্দি-জ্বরে ভুগছেন, তা বোঝার কোনো পথ নেই। জেলা পর্যায়ে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার, তা নতুন আইনে স্পষ্ট নয়। সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসক দুজনকেই কিছু দায়িত্ব দেওয়া আছে, যা মূলত স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের ডাকবাহকের ভূমিকার অনুরূপ। ফলে জেলা পর্যায়ে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের চেয়ে প্রশাসনের কর্তৃত্বের বিষয়টিই প্রাধান্য পাচ্ছে।

করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার হার কম বলে যাঁরা সমালোচনা করছেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন তাঁরা কি চান সংখ্যাটা বেশি হোক? সমালোচনার জবাব দিতে আক্রমণাত্মক কৌশল রাজনীতিতে বেশ কাজে লাগে। কিন্তু জনস্বাস্থ্য সংকটে তা দায়িত্বশীলতার পরিচয় বহন করে না।

করোনা মহামারি বিশ্বের সব দেশেই স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থার সক্ষমতার এক বিরাট পরীক্ষা। এত বেশি সংখ্যায় রোগীর জীবন বাঁচানোর লড়াই শত বছরের মধ্যে আর করতে হয়নি। সুতরাং, রোগীর সংখ্যা কমানোই সবার অগ্রাধিকার; রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে মানুষে মানুষে মেলামেশা ঠেকাতে সরকারগুলো মরিয়া। সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীরা কাজ করতে না পারার কারণে সরকার তাঁদের বেতনের দায়িত্ব নিয়েছে। বাড়িভাড়া, পানি, বিদ্যুৎ, পৌর কর, আয়কর ইত্যাদি খরচের ক্ষেত্রে হয় রেয়াত দিচ্ছে, নয়তো তা পরিশোধের সময় পিছিয়ে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার প্রায় সব দেশই এ ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কথায়, সরকার যেহেতু কাজ বন্ধ করে ঘরে থাকতে বলেছে, সেহেতু কর্মীদের আয় ও জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব। গৃহহীনদের বড় বড় হোটেলে জায়গা দিতেও সরকারগুলো কসুর করেনি। এসবের উদ্দেশ্য সংক্রমণ বন্ধ করা। অধিকাংশ দেশই বিষয়টিকে যুদ্ধ হিসেবে নিয়েছে।

সার্স এবং মার্সের মতো বৈশ্বিক মহামারির অভিজ্ঞতার পর বাংলাদেশে ২০১৮ সালে আইনটি তৈরি হলেও সেটি পড়লে ধারণা মেলে যে মহামারি এত বড় আকারের হতে পারে, এমন ধারণা আইনপ্রণেতাদের ছিল না। ১২১ বছরের পুরোনো ভারতের এপিডেমিক ডিজিজেস অ্যাক্ট ১৮৯৭–এর বদলে ২০১৮–এর আইনটি করা হলেও নতুন আইনটিও মূলত বিধিনিষেধ ও শাস্তি আরোপের ক্ষমতা চর্চার দলিল। এতে রোগী, নীরোগ কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিক কিংবা চিকিৎসাসেবী কারও অধিকার ও সুরক্ষার বিধান নেই। মহামারির সময়ে চিকিৎসকদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে কোনো বিধিবিধান যুক্ত করার কথা সরকার–সমর্থক চিকিৎসকনেতারা সম্ভবত পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলেন। দশম সংসদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের একজন সাবেক সভাপতিসহ অন্তত তিনজন চিকিৎসক সাংসদের নাম ছিল।

বছরখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন রিলেশন্স কাউন্সিলের এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, উচ্চ প্রবৃদ্ধি মানুষের মৃত্যুঝুঁকি যতটা কমায়, তার চেয়ে অনেক বেশি কমায় গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন (প্রথম আলো, ৮ এপ্রিল ২০১৯)। গত বছরের ১৩ মার্চ চিকিৎসা
সাময়িকী ল্যানসেট–এ প্রকাশিত ১৭০টি দেশের ওই সমীক্ষায় দেখানো হয়েছিল, হৃদ্‌রোগের মতো অসংক্রামক রোগ, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার অপেক্ষাকৃত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যেসব দেশে হয়েছে, সেখানে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন ও গণতন্ত্রহীন উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশ থেকে অনেক কম। ২০১৮ সালের সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ আইনের অনুপযোগিতা ওই গবেষণার উপসংহারকেই কি সমর্থন করে না?

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক