আসুন, কিছুটা মানবিক হই

করোনায় সংক্রমিতদের জন্য নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে একটি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার জরুরি ফিল্ড হাসপাতাল
করোনায় সংক্রমিতদের জন্য নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে একটি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার জরুরি ফিল্ড হাসপাতাল

এক অভাবিত বিপর্যয়ের সম্মুখীন বিশ্ব। অদৃশ্য এক শত্রু, যে ধনী-দরিদ্র মানে না, রাষ্ট্রের সীমারেখা মানে না, আমাদের ক্রমে গ্রাস করে ফেলছে। এমনই এক আঁধারভরা সময় এখন। কিন্তু ধ্বংসস্তূপেও তো এসে লাগে সকালের সূর্য, আঁধারভরা সময়েও শোনা যায় গান। হোক না আঁধারভরা সময়ের গান, তবু সেই রকম কিছু গান শোনা যাক। 

নিউইয়র্কের এক বাঙালি ছাত্রী জয়া আহমদের গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। ফিলাডেলফিয়ার সাবেক ডেপুটি মেয়র নীনা আহমদের মেয়ে, মেডিকেল কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই শহরেই সবচেয়ে বেশি করোনা-আক্রান্ত মানুষ, যাদের অনেকেই অভিবাসী ও অভাবী। করোনা সংকট শুরুর পর জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ, মেডিকেল সাপ্লাই ড্রাইভ, নিউইয়র্ক শহরে একজন সমন্বয়কারীর সন্ধান করছিল। সাগ্রহে এগিয়ে এল জয়া। তার কাজ এই শহরের যেকোনো আগ্রহী ব্যক্তি অথবা সংস্থার কাছ থেকে চিকিৎসা কাজে ব্যবহার্য উপকরণ, যেমন মাস্ক অথবা দস্তানা সংগ্রহ। সে একা নয়, এই কাজে তাকে সঙ্গ দিতে সে খুঁজে নিয়েছে আরও জনা চল্লিশেক স্বেচ্ছাসেবী। গত কয়েক দিনে তারা পাঁচ হাজারের বেশি দস্তানা, ৫০০ মাস্ক ও অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করে বিভিন্ন হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে। 

জয়াকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই কাজের প্রেরণা কোত্থেকে সে পেয়েছে। জয়ার উত্তর, এখন দুঃসময়, এই সময়ে আমার কিছু করার থাকলে কেন হাত গুটিয়ে বসে থাকব? এমন সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষাই আমার মা–বাবা আমাকে দিয়েছে। 

আরেক বাঙালি ছাত্রী, নিউইয়র্কের নিউ স্কুলের স্থাপত্যকলার সদ্য গ্র্যাজুয়েট বহতা সাহা নিজ উদ্যোগে থ্রিডি (বা ত্রিমাত্রিক) প্রিন্টারে ‘প্রটেক্টিভ শিল্ড মাস্ক’ বানাচ্ছে। করোনার মতো সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসক বা নার্সদের সুরক্ষায় কার্যকর এই মাস্ক থ্রিডি প্রিন্টারে প্রতি ঘণ্টায় একটি বানানো সম্ভব। বহতা ইতিমধ্যে ১০০ মাস্ক বানিয়ে নিউইয়র্কের এক হাসপাতালে দিয়ে এসেছে। বহতার বাবা, মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী বিশ্বজিত সাহাও বসে নেই। তঁার ব্যবস্থাপনায় মুক্তধারা প্রবাসী বাঙালিদের জন্য করোনা সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে ‘করোনা হেল্পলাইন’ নামে একটি ওয়েবসাইট নির্মাণ করেছে। 

শুধু জয়া বা বহতার মতো সচেতন ছাত্রছাত্রীই নয়, এই সংকটে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে সব ধরনের, সব বয়সের মানুষ। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা, এদের সামাল দিতে যত ডাক্তার ও নার্স দরকার, নিউইয়র্কের হাসপাতাল ব্যবস্থায় তা নেই। সংকট এড়াতে নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে তালিকাভুক্তির আহ্বান করেছিলেন। তাঁর সে আবেদনের প্রথম ২৪ ঘণ্টাতেই ১০০০-এর বেশি অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার ও সেবাকর্মী তালিকাভুক্ত হয়েছেন। গত ১০ দিনে মোট তালিকাভুক্ত স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অধ্যয়নরত চিকিৎসক-ছাত্ররাও পিছিয়ে নেই। দুই মাস পরে ডাক্তার অথবা নার্স হিসেবে তঁাদের সনদ পাওয়ার কথা। ছাত্রছাত্রীদের অনুরোধে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ তাদের গ্র্যাজুয়েশনের সময়সীমা এগিয়ে এনেছে। এর ফলে শুধু নিউইয়র্কেরই কয়েক শ ছাত্রছাত্রী অবিলম্বে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবায় নিয়োজিত হতে পারবে। 

নামজাদা ফ্যাশন ডিজাইনার, যঁাদের কাজ হলিউডের তারকাদের জন্য চোখধাঁধানো সাজপোশাক তৈরি করা, তাঁরাও এগিয়ে এসেছেন। এঁদের অনেকের কর্মস্থল নিউইয়র্ক। কোনো রকম দ্বিধা ছাড়া, কারও নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে, যার যার নিজের কর্মশালায় করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর এমন মাস্ক ও প্রোটেকটিভ গাউন তৈরি শুরু করেছেন তাঁরা। এঁদের মধ্যে রয়েছেন ক্রিশ্চিয়ান সিরিয়ানোর মতো জগদ্বিখ্যাত ডিজাইনার। বিখ্যাত সাবেক বাস্কেটবল খেলোয়াড় স্টেফান মারবারি উদ্যোগ নিয়েছেন চীন থেকে এক কোটি মাস্ক বানিয়ে আগামী দুই মাসের মতো দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহের। পুরোনো বন্ধুদের সহায়তায় তিনি প্রতি সপ্তাহে ২০-২৫ লাখ মাস্ক আনার ব্যবস্থা করেছেন বলে মারবারি জানিয়েছেন। 

এগিয়ে এসেছে শহরের রেস্তোরাঁসমূহ, তারা বিনা মূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে শহরের বিত্তহীনদের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা করেছে। শরীরচর্চা প্রশিক্ষকেরা, যাঁরা এখন ঘরে আটকা পড়েছেন, ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিনা মূল্যে শরীরচর্চা প্রশিক্ষণের ক্লাস নিচ্ছেন। একই কাজ করছেন নামজাদা সংগীতশিল্পী ও শিক্ষক। করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন পরিণত বয়সের মানুষেরা, যঁারা একা থাকেন। বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই, আর্থিক সংগতি নেই টেলিফোন করে খাদ্যের অর্ডার দেবেন। এমন মানুষের কথা মনে করে প্রায় সব এলাকায় ছোট ছোট স্বেচ্ছাসেবক দল গড়ে উঠেছে। তাঁরা নিজ উদ্যোগে এসে খোঁজ নিচ্ছেন সেসব একাকী মানুষদের কী অবস্থা, কী প্রয়োজন। 

তবে সবাই যে এমন মানবিক, তা নয়। আঁধারভরা সময়ে আমাদের সবচেয়ে লোভী ও ঘৃণ্য দিকগুলোও প্রকাশিত হয়ে পড়ে। টেনেসির দুই ভাই, ম্যাট ও নোয়ার কথাই ধরুন। করোনাভাইরাসের কারণে হাত ধোয়ার সাবান বা স্যানিটাইজার দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়বে, এ কথা টের পেতেই মার্চের শুরুতে তারা দুজনে গাড়ি নিয়ে নেমে পড়ে। চ্যাট্টানুগা শহরে যতগুলো ‘ডলার শপ’ আছে, তার প্রতিটিতে ঘুরে ঘুরে তারা প্রায় ১৭ হাজার বোতল স্যানিটাইজার কিনে ঘর ভরিয়ে ফেলল। তারপর সেসব বিক্রি শুরু করল, মুখ্যত আমাজনের মাধ্যমে, তাদের কেনা দামের দশ-বারো গুণ দরে। খুব বেশি দূর অবশ্য তারা এগোতে পারেনি, এ নিয়ে লেখালেখি শুরু হলে আমাজন তাদের ওয়েবসাইটে সেসবের বিক্রি বন্ধ করে দেয়। সরকারি কর্তৃপক্ষও জানাল তারা আইনগত ব্যবস্থা নেবে। চূড়ান্ত সামাজিক হেনস্তার মুখে পড়ে সে দুই ভাই নাকে খত দিয়ে জানাল, তারা ভুল করেছে। যেসব বোতল তাদের কাছে রয়েছে, সেসব তারা বিনা মূল্যে বিতরণ করে দেবে। 

বিপদের আশঙ্কায় ঘরে প্রয়োজনীয় সামগ্রী মজুত করার প্রবণতা সব দেশেই রয়েছে। মিনেসোটায় এক লোক অতিরিক্ত সাবধানতার কথা ভেবে তার শহরের বিভিন্ন দোকান থেকে কয়েক হাজার বাক্স টয়লেট পেপার কিনে নিজের গ্যারেজে ভরে ফেলে। আগামী তিন বছরেও অত টয়লেট পেপার তার পক্ষে শেষ করা অসম্ভব। আবার দেখুন, এই নিউইয়র্কের উইলিয়ামসবার্গের এক লোক টয়লেট পেপারের অভাব রয়েছে জানতে পেরে সারা শহর ঘুরে ঘুরে নিজের গাড়িভর্তি টয়লেট পেপার এনে নিজ পাড়ায় বিনা মূল্যে বিলি করেছে। একই ঘটনা, অথচ দুই রূপ। 

বাংলাদেশেও কি ঠিক একই ঘটনা ঘটছে না? শুনেছি গুলশানের এক বাজার থেকে এক ভদ্রলোক একাই দেড় শ ব্যাগ চাল কিনে নিয়ে গেছেন। একা খাবেন, সে জন্য নিশ্চয় নয়, সুযোগ পেলে চড়া দামে বিকোবেন, হয়তো সে জন্যই। আবার শুনেছি মালিবাগে (অথবা মগবাজারে) এক লোকে দাঁড়িয়ে থেকে অভাবীদের মধ্যে চাল-ডাল বিতরণ করেছেন। 

সত্যি কথা হলো, সংকটের সময় আমাদের মানবিকতা, আমাদের ভালো দিক মন্দ দিক—দুটোই প্রকাশিত হয়। আমরা কে, মানুষ না শয়তান—আমাদের চোখের সামনেই তা উদ্‌ঘাটিত হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই উভয় দিকেরই প্রকাশ আমরা দেখেছি। একজন মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে; অন্যজন বিপদ জেনেও মুক্তিযোদ্ধাদের নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী রেভারেন্ড ডেসমন্ড টুটুর একটি মন্তব্য আমরা এখানে স্মরণ করতে পারি। তাঁর কথায়, প্রতিটি সংকটই আমাদের জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি করে। আমরা কি কেবল শুধু নিজের জন্যই বাঁচব, না সবাইকে নিয়ে বাঁচব। এই বিপরীতমুখী অবস্থানের যেকোনো একটি আমরা বেছে নিতে পারি। সে সিদ্ধান্ত আমাদের, অন্য কারও নয়। 

বিপদের সময় যারা ভীরু, তারা ঘরে খিল দিয়ে বসে। যারা সাহসী, তারা মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ায়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে যে মহাদুর্যোগের সৃষ্টি হয়েছে, তা যুদ্ধের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এই যুদ্ধে আমাদের অবস্থান কী, সে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখনই সময়। এখনই সময় আমাদের প্রকৃত মানবিকতা প্রকাশের। 

৩০ মার্চ ২০২০, নিউইয়র্ক 


হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক