কোয়ারেন্টিন আর কত দিন

সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণ দীর্ঘ হলে অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়বে
সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণ দীর্ঘ হলে অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়বে

বর্তমান সময়ের মন্ত্র হচ্ছে ‘কোয়ারেন্টিন অবস্থায় (সঙ্গনিরোধে) থাকুন, নিরাপদ থাকুন’। প্রথম পর্যায়ে, সরকারি অফিস-আদালত ২৬ মার্চ থেকে সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়। পরে তা ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। বেসরকারি খাতও কার্যত এ ছুটি অনুসরণ করছে। সীমিত আকারে দুই ঘণ্টার ব্যাংকিং চালানো হচ্ছে। জনগণকে ঘরে থাকতে বাধ্য করতে পুলিশ কোথাও কোথাও কঠোর হচ্ছে। বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ছুটি ও কোয়ারেন্টিন দুটোই আরও বাড়তে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ১৫ দিন পার হওয়ার পর কোয়ারেন্টিন আর কত দিন? 

মোটা দাগে করোনাভাইরাস উদ্ভূত পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ দুটি। প্রথম চ্যালেঞ্জটি হলো মানুষের জীবন বাঁচানো এবং এ ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা। সরকার নিয়োজিত সংস্থা আইইডিসিআর প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে জনসংখ্যার অনুপাতে মৃত্যু ও সংক্রমণের সংখ্যা আপাতত কম হলেও তা জনমনে স্বস্তি সৃষ্টি করতে পারছে না। এর প্রধান কারণ হলো, টেস্টিংয়ের অভাব। টেস্টিংয়ের জন্য মানুষ হন্যে হয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছে। সারা দেশ থেকে চিকিৎসার অভাবে করোনার লক্ষণাক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর সংবাদ আসছে। তা ছাড়া অন্যান্য দেশে করোনাভাইরাসের বিস্তারের কার্যক্রম (সাইকেল) বিশ্লেষণ ও বিদেশিদের দলে দলে স্বদেশে (উচ্চতর আক্রান্ত ও মৃত্যুর দেশে) প্রত্যাবর্তনের ঘটনা, আপৎ মোকাবিলায় বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর বিশাল শয্যাসংখ্যার হাসপাতাল স্থাপনের ঘোষণা সাধারণ মানুষকে আরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। 

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি হলো অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা। দেশে-বিদেশে কোয়ারেন্টিনের কারণে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আইএমএফ ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী মন্দার সূচনা হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প ইতিমধ্যেই সাহায্যের জন্য সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে এবং শ্রমিকদের মজুরি বাবদ পাঁচ হাজার কোটি টাকা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। অন্যরা যেমন পোলট্রি শিল্প, হোটেল, এয়ারলাইনস, সংবাদপত্রসহ বিবিধ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প একইভাবে বিপর্যস্ত হলেও তাদের কোনো সহায়তার আশ্বাস মেলেনি। 

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান অপেক্ষা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ, রিকশাচালক, দিনমজুর, নাপিত, মিস্ত্রি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ আরও অনেকে। এসব জনগোষ্ঠী সাময়িকভাবে সরকারি ও বেসরকারি খাত থেকে আর্থিক ও খাদ্যসহায়তা পেলেও দীর্ঘ মেয়াদে এটা টেকসই হতে পারে না। কোয়ারেন্টিনের সামাজিক ফলাফল বিশেষত শিশু-কিশোরদের ওপর এর প্রতিক্রিয়া জানতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। 

বন্দরে অখালাসকৃত পণ্যের স্তূপ, রপ্তানি হ্রাস, বিদেশে কর্মরতদের দেশে ফিরে আসা—সবই আমাদের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক সংবাদ। এমনিতেই নাজুক আমাদের ব্যাংকিং খাত, এ খাতে অনুসৃত লুটপাট ও সাম্প্রতিক বালখিল্য নীতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিম্নগামিতা এ খাতকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। 

তাই এখন আমাদের এক ঢিলে দুই পাখি মারতে হবে। একই ঢিলে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ ও অর্থনীতির চাকা সচল করতে হবে। আর সে ঢিলটি হলো টেস্টিং আর টেস্টিং। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা টেস্টিংয়ের কথা বারবার বলে আসছে এবং আমাদের আইইডিসিআর তাদের সীমিত ক্ষমতা ও সম্পদ, পেশাদারির অভাব কিংবা কোনো অজ্ঞাত কারণে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। 

আমার পিএইচডি থিসিস সুপারভাইজার বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক লরেন্স কটলিকফ ও কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকুলার ফিজিওলজির অধ্যাপক মাইকেল কটলিকফ ‘কীভাবে দুই সপ্তাহের মধ্যে নিরাপদে মার্কিন অর্থনীতিকে কাজে ফেরানো যায়’ সে বিষয়ে দ্য হিল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরাও টেস্টিংয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁরা করোনাভাইরাসের লক্ষণ, আক্রান্ত ও সুস্থনির্বিশেষে সব নাগরিককে টেস্ট করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁদের মতে, আক্রান্তদের টেস্ট করতে হবে, তাঁদের অন্যদের থেকে আলাদা করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান ও তাঁদের মাধ্যমে এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধের জন্য। 

সুস্থদেরও টেস্ট করার পেছনে দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, আপাত সুস্থদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা সংক্রমিত কিন্তু কোনো লক্ষণ নেই, ফলে তাঁরা করোনাভাইরাস ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁদের শনাক্ত করে একক বা পরিবারের সঙ্গে কোয়ারেন্টিন করা যাবে। তাঁরা আর অন্যদের সংক্রমিত করতে পারবে না। 

দ্বিতীয়ত, যাঁদের টেস্ট নেতিবাচক (নেগেটিভ) হবে, তাঁরা কাজে ফিরে যেতে পারবেন। তাঁরা নিশ্চিত থাকবেন যে তাঁদের সংস্পর্শে আসা কেউই করোনাভাইরাস রোগে আক্রান্ত নন।

কথা হলো ১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে এত অধিকসংখ্যক টেস্ট কীভাবে করা যাবে? এ ক্ষেত্রে তাঁদের পরামর্শ হলো দলগত টেস্ট। তাঁদের পরামর্শ হলো একটি নির্ধারিত সর্বজনীন টেস্টের আওতায় দিনে প্রত্যেক ব্যক্তির নমুনা দুটি সোয়াবে আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হবে। আনুমানিক ১ হাজার ব্যক্তির প্রথম সোয়াব একসঙ্গে করে করোনাভাইরাসের জন্য পরীক্ষা করতে হবে। তাঁদের প্রত্যেককেই শনাক্ত করে তাঁদের পরিচিতি সরকারকে তালিকাভুক্ত করতে হবে। যদি ফলাফল নেগেটিভ হয়, তাহলে একসঙ্গে ১ হাজার ব্যক্তি করোনাভাইরাসমুক্ত বলে চিহ্নিত হবেন। যদি ফলাফল পজিটিভ হয়, তবে প্রত্যেক ব্যক্তির দ্বিতীয় সোয়াব আলাদা করে পরীক্ষা করে আক্রান্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে হবে। এভাবে অপেক্ষাকৃত স্বল্পসংখ্যক পরীক্ষার মাধ্যমে আক্রান্ত ও সুস্থদের আলাদা করা সম্ভব হবে। ফলে বিপুলসংখ্যক সুস্থ ব্যক্তি তাঁদের নৈমিত্তিক জীবনে ফিরে গিয়ে পুনরায় অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে পারবেন। 

কটলিকফ ও কটলিকফ সুপারিশকৃত ওপরের পদ্ধতিটি একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (সায়েন্টিফিক প্রটোকল) এবং এর বাস্তবায়নের জন্য একটি বৈজ্ঞানিক টাস্কফোর্স এবং এর আয়োজনের জন্য বিপুল জনবল ও সম্পদ প্রয়োজন হবে। আমাদের মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ভাইরোলজিস্ট ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কটলিকফ ও কটলিকফ বর্ণিত গ্রুপ টেস্টিং পদ্ধতির বাস্তবায়নযোগ্যতা ও কার্যকারিতা ভেবে দেখতে পারেন। আমাদের মতো জনবহুল দেশে এ পদ্ধতি ভালো ফল দিতে পারে। 

আমরা এমন একটা দুঃসময়ে অবস্থান করছি, যেখানে অপেক্ষার সামাজিক ও আর্থিক মূল্য অনেক বেশি। করোনাভাইরাস আক্রান্ত লোকজন যত দিন অচিহ্নিত থাকবেন, ততই সংক্রমণ ও প্রাণহানি বাড়বে। আবার কোয়ারেন্টিন দীর্ঘমেয়াদি হলে অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়বে। উৎপাদন বন্ধ থাকলে দেশীয় পণ্যের সরবরাহ কমবে, মূল্যস্ফীতি ঘটবে ও রপ্তানি কমবে, রপ্তানিসংশ্লিষ্ট আমদানি কমবে। ফলে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির আয় কমবে। আমদানি ও স্থানীয় উৎপাদন হ্রাসের ফলে রাজস্ব আয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার সঙ্গে যোগ হয়ে দেশের অর্থনীতির এসব বিরূপ প্রভাব পুরো সামষ্টিক অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলবে। 

ইতিমধ্যে করোনাভাইরাসজনিত সমস্যা থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে সফল দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এক, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন। যে বিষয়গুলো এক, সেগুলো হলো সরকারি পর্যায়ে রোগ বিষয়ে স্বচ্ছতার নীতি অনুসরণ (সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, জাপান ও শ্রীলঙ্কা), সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কার্যকর নির্দেশনা প্রদান ও জনগণকে সম্পৃক্ত করা (সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, জাপান ও শ্রীলঙ্কা) ও ব্যাপক হারে টেস্টিং (সিঙ্গাপুর, কোরিয়া), বিমানবন্দরে আসা যাত্রী নিয়ন্ত্রণ ও তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিং (সিঙ্গাপুর, কোরিয়া ও শ্রীলঙ্কা) এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও মাস্কের ব্যবহার (জাপান, চেকোস্লোভাকিয়া)। 

বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের প্রভাব ও বিস্তার আবহাওয়া, ভাইরাসের স্ট্রেইনের ভেদাভেদ ও জনগণের অসংক্রামতা ও সামাজিক অবস্থাভেদে ভিন্ন। তাই অন্যদের মতো বাংলাদেশকেও এ ক্ষেত্রে সফল হতে হলে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজস্ব কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে। এ জন্য আমাদের সম্মিলিত মেধা ও প্রচেষ্টাকে একত্র করে কাজে লাগাতে হবে।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও প্রতিষ্ঠাতা সিইও ইডকল