খাদ্যনিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক তাণ্ডবের ধাক্কা বাংলাদেশেও লেগেছে। আমার এ লেখাটি দেশের কৃষি নিয়ে। এ মুহূর্তের ভাবনা ও করণীয় কী কী হতে পারে, তা নিয়ে অন্তত দুটো বিষয়ে আশ্বস্ত থাকা যায়। এক. দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত আছে, খাদ্যাভাবের সম্ভাবনা নেই। বাজারে যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর দাম না বাড়ে, সে ব্যাপারেও সরকারের কঠোর সতর্কবার্তা রয়েছে। দুই. পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর এক ইঞ্চি জায়গাও অনাবাদি না রাখার আহ্বান। এটা কৃষক, শ্রমিক, কৃষিবিজ্ঞানী, গবেষক, উপকরণ ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের উত্সাহী করবে। করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।

কৃষিতে জরুরি কাজগুলো ঠিকমতো করে যেতে হবে।

১. এ মাসের শুরুতে বোরো ধানে থোড় আসছে। বোরো ধান প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ চালের জোগান দেয়। এখন সেচব্যবস্থা সার্বক্ষণিক চালু রাখতে হবে। প্রায় ১৫ লাখ অগভীর নলকূপ, প্রায় ৩৫ হাজার গভীর নলকূপ ও লক্ষাধিক পাওয়ার পাম্প সচল রাখার জন্য ডিজেল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

২. সেচযন্ত্রের মেরামতকাজ নির্বিঘ্ন রাখতে খুচরা যন্ত্রপাতির দোকান চালু রাখা দরকার। হাটবাজারের দোকানপাট বন্ধ থাকায় গ্রামীণ মেকানিকেরা নিয়মিত বসতে পারছেন না। ইউনিয়ন পর্যায়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের উদ্যোগে স্থানীয় মেকানিকদের সঙ্গে মোবাইল ফোনভিত্তিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গঠন করা যেতে পারে, যাতে কারও সেচযন্ত্র বিকল হলে দ্রুত তাদের সার্ভিস নেওয়া যায়।

৩. আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হাওর এলাকায় বোরো ধান কাটা শুরু হবে। এ কাজে দূরদূরান্ত থেকে ধান কাটা শ্রমিকেরা হাওর অঞ্চলে যায়। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এবার তাদের চলাচল বিঘ্নিত হতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবহন খাতের সুসমন্বয়ের মাধ্যমে তাদের সুলভে চলাচলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

৪. মে মাস থেকে সমগ্র দেশে বোরো ধান কাটার পুরো মৌসুম শুরু হবে। বরাবরের মতো এবারও ধান কাটা শ্রমিকের সংকট থাকবে। শ্রমিকের মজুরিও বাড়তে পারে। তাই দ্রুত ধান কাটা ও মাড়াইযন্ত্রের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা খুব জরুরি।

৫. সরকারের ভর্তুকির মাধ্যমে ধান কাটা যন্ত্রপাতি বিতরণের কাজ চলমান আছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রের মতে, উপজেলাওয়ারি কোন মডেলের যন্ত্রের কত চাহিদা আছে, তার ভিত্তিতে কোন উপজেলায় কয়টা যন্ত্র দেওয়া যাবে, তা কৃষি পুনর্বাসন কমিটিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। উপজেলা পর্যায় থেকে এখন ওই সব যন্ত্রপাতি কোন কোন কৃষক পাবেন, তার তালিকাটি চূড়ান্ত করে অধিদপ্তরে পাঠানো অত্যন্ত জরুরি। দীর্ঘ ছুটির ফাঁদে পড়ে কাজটি বিলম্ব হলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কমিটিকে এটাকে অত্যাবশ্যকীয় কাজ হিসেবে তাগিদ দিয়ে দ্রুত কাজটি করিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ভর্তুকি মূল্যে যন্ত্র কারা পাবেন, এটা জানা হয়ে গেলে যন্ত্র সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও দ্রুত প্রয়োজনীয় চুক্তিপত্র সম্পাদনের কাজ সেরে ফেলতে হবে। এ কাজটি অবিলম্বে শেষ করার বড় সুবিধা হলো যাঁরা ভর্তুকি সুবিধা পাবেন না, তাঁরা আর ওই আশায় বসে না থেকে বাজারমূল্যেই হার্ভেস্টার ও রিপার কিনতে এগিয়ে আসবেন। ভর্তুকি সিদ্ধান্তে বিলম্ব মানেই সম্ভাব্য কৃষিযন্ত্র উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের আশা-নিরাশার দোলাচলে ফেলে রাখা। এটা মোটেই কাম্য নয়।

৬. এখন গম কাটা চলছে। ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গাসহ উত্তরবঙ্গে গমের ফলন মোটামুটি ভালো হয়েছে। তবে মাঠপর্যায়ের একটি খবর হলো কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন বারি-গম ২৬ ব্লাস্ট রোগের কারণে ফলন কম হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, কৃষক ও বিএডিসি যেন এবার থেকে ব্লাস্টপ্রতিরোধী গমের জাত যেমন বারি-গম ৩০ ও এর ঊর্ধ্বের জাতগুলোর বীজ সংরক্ষণ করে। বারি-গম ৩৩-এর সুনাম রয়েছে বলে শোনা যায়।

৭. আউশ ধান বোনার সময় হয়ে আসছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ৮ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আউশ ধান বোনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় বীজ-সার প্রণোদনা প্যাকেজ সময়মতো ডেলিভারির প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। বেসরকারি বীজ ব্যবসায়ীদেরও প্রস্তুত থাকতে উৎসাহ দিতে হবে। আউশ মৌসুমেই পাটও বুনতে হবে। একটু আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টন পাটের বীজ ভারত থেকে আমদানি করতে হবে। এর মধ্যে মাত্র অর্ধেক এসে পৌঁছেছে। বাকি প্রায় ২ হাজার টন দুই দেশের লকডাউন পরিস্থিতিতে আটকে না পড়ে, যাতে সময়মতো দেশে এসে পৌঁছায়, সে ব্যাপারেও তৎপর থাকতে হবে। বৈশাখ মাসের প্রথম দিকেই পাট না বুনলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাবে না।

৮. কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে এখন থেকেই করোনার পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চয়তার প্রশ্নে আগামী রোপা আমান ধান, ভুট্টা ও শাকসবজির কথাও মাথায় রেখে আগাম পরিকল্পনা করতে হবে। জাপান, কোরিয়া ও চীন থেকে আমরা সবজির বীজ আমদানি করি। এসব দেশও যেহেতু করোনায় আক্রান্ত, কাজেই আগেভাগেই বীজ আমদানির ব্যবস্থা পাকাপাকি করে রাখতে হবে।

৯. ফসল খাতের বাইরে দুগ্ধ খাত করোনার প্রভাবে ইতিমধ্যেই বিপাকে পড়েছে। ছোট-বড় সব দুগ্ধ খামারি প্রমাদ গুনছেন। না পারছেন দুধ দোহন বন্ধ করতে, না পারছেন কাঁচা দুধ বিক্রি করতে। অথচ গাভিকে খাওয়ানো ও চিকিৎসা সবই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। করোনার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হলে দুগ্ধ খামারিদের আর্থিক সহায়তাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। দুধ কোম্পানি, খামারি ও বিজ্ঞানীরা মিলে এ পরিস্থিতিতে দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ বা গুঁড়া দুধ উৎপাদন ও সংরক্ষণ বিষয়ের উপায় নির্ধারণে প্রচেষ্টা নিতে পারেন।

সবশেষে বলব, করোনা পরিস্থিতি বেশ জটিল; এর প্রভাবও বহুমাত্রিক। এই পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি, গ্রামীণ অর্থনীতি ও খাদ্য পুষ্টির বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের আগাম দৃশ্যপট পরিকল্পনা করতে হবে।

এম এ সাত্তার মণ্ডল: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক কর্ম সম্পাদন কমিটির সদস্য উপদেষ্টা