বন, বন্য প্রাণী ও বিবস্ত্র পৃথিবীর মহামারি

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীর দাবিদার আমরা আজ বড় অসহায় হয়ে পড়েছি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের গরিমায় প্রায় সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এক অজানা অণুজীবের সঙ্গে আজ আমরা পেরে উঠছি না। পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ এলাকা আমাদের একচ্ছত্র দখলে, অথচ হঠাৎ করেই আজ আমরা নিরুপায়। এক অদৃশ্য ক্ষুদ্রাতিÿক্ষুদ্র করোনাভাইরাস মোকাবিলায় গলদঘর্ম হয়ে পড়ছি। পৃথিবী নামক গ্রহের কয়েক শ কোটি মানুষ আজ কার্যত গৃহবন্দী। বড় বড় শহর মানুষের মৃতদেহে ভরে উঠছে। আমরাও এই বিপর্যয়ের বাইরে নই। প্রাণপ্রিয় স্বজনের মরদেহ আজ আমাদের কাছে শুধু অচ্ছুতই নয়, সামাজিক কবরস্থানে কবর দিতেও আমরা ঘোর বিরোধী।

একটু ভাবুন তো ওই কফিনের ভেতরে আমিও তো থাকতে পারতাম। মানবসভ্যতার পথ ধরে গড়ে ওঠা পারস্পরিক বিশ্বাস, সম্প্রীতি, কৃষ্টি মুহূর্তেই ধূলিসাৎ। করোনাভাইরাস আজ আমাদের নীতি-নৈতিকতা, সামাজিকতা ও ভালোবাসার মতো মূল্যবোধের শিকড় উপড়ে ফেলেছে। কেন ঘটছে এই মহামারি, পৃথিবী কি আজ গভীর কোনো অসুখে পড়েছে?

সৌরজগতের বসবাসযোগ্য একমাত্র গ্রহ পৃথিবী আজ বিপর্যস্ত। বিলাসী জীবনযাপনে আমাদের সম্পদের যে চাহিদা আজ তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করতে প্রায় দুটি পৃথিবীর প্রয়োজন। গগনবিদারী দালানকোঠা, উন্নত রাস্তাঘাট, ঝলমলে শহর, বন্দর আমাদের উন্নয়নের মূলমন্ত্র। এসব উন্নয়ন করতে গিয়ে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আমরা ৫২ কোটি টন সাধারণ বর্জ্য, ১০ কোটি টন বিপজ্জনক বর্জ্য, সোয়া এক কোটি টন ইলেকট্রনিক বর্জ্য পৃথিবীর বুকে নিক্ষেপ করেছি। প্রতি সেকেন্ডে আমরা প্রায় দেড় লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছি। ফলে সবুজ–সতেজ পৃথিবী প্রতিনিয়ত একটি মৃত ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় আজ আমাদের ফুটবল মাঠ, ট্রেন, পার্ক ইত্যাদি হাসপাতালে পরিণত হচ্ছে।

আদতে পৃথিবীর প্রায় দেড় কোটি বর্গকিলোমিটার প্রাইমারি বনাঞ্চল দ্বারা আবৃত থাকলেও এর অধিকাংশ ইতিমধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত। বর্তমানে পৃথিবীর যে ৩৫ শতাংশ এলাকায় বন অবশিষ্ট আছে, তাও নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিলীন হওয়ার পথে। আমাদের গ্রাস থেকে পাহাড়, পর্বত, বন-বনানী, নদী–সাগর—কোনো কিছুই বাদ যায়নি। চলতি বছরের গত তিন মাসে আমরা ১৩৫ কোটি ঘনফুট কাঠের সমপরিমাণ গাছ কেটেছি। এর ফলে ৭০ লাখ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। প্রতি মিনিটে ২৭টি ফুটবল মাঠের সমান বনভূমি আজ আমাদের উন্নয়নের বলি। বিগত ৫০ বছরে পৃথিবীর বন্য প্রাণীর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। প্রতি পাঁচ মিনিটে পৃথিবী থেকে একটি প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে। পৃথিবী আজ অনেকটাই বিবস্ত্র, বন প্রাণীরা বাস্তুহারা।

প্রায় ১০ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে মেরুদণ্ডী প্রাণীর মোট ওজনের মধ্যে মানুষ ছিল ১ শতাংশ, বাকি ৯৯ শতাংশ ছিল বন্য প্রাণী। ২০১১ সালে এসে মানুষ দখল করেছে ৩২ শতাংশ, মাত্র ১ শতাংশ বন্য প্রাণী। অবশিষ্ট ৬৭ শতাংশ গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি। আমাদের খাদ্যচাহিদা মেটাতে বন্য অবস্থা থেকে এদের আজ আমরা গৃহপালিত পশুতে পরিণত করেছি। তবে এসব গৃহপালিত প্রাণী খেয়ে আজ আমরা আর তৃপ্তি পাই না। ইঁদুর, বাদুড়, সাপ, ব্যাঙ, বাঘ, হরিণ, কুমিরসহ জগতের সব প্রাণী খেতে আমাদের রসনা বড়ই কাতর। আমাদের রোগবালাই দূর করতে এদের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের এই নিয়ন্ত্রণহীন চাহিদা মেটাতে আমরা প্রতি ৫ মিনিটে একটি বনরুই, প্রতি ৩০ মিনিটে একটি হাতি এবং প্রতি ৮ ঘণ্টায় একটি গন্ডার শিকার করছি। গত ১৯ বছরে প্রায় ৯ লাখ বনরুই আমাদের শিকারে পরিণত হয়েছে। এই নিরীহ প্রাণীর গন্তব্য হয়েছে আমাদের রান্নাঘর ও ওষুধ কারখানা।

আজ আমরা করোনা যুদ্ধের মুখোমুখি। এ পর্যন্ত তথ্যে জানা যায়, চীনের উহান শহরের এক বন্য প্রাণী মাংসের বাজার থেকে এই করোনাভাইরাসের উৎপত্তি। বাজারে বিক্রি হওয়া বনরুই থেকে প্রথমে গন্ধগোকুলে, পরে মানুষের মধ্যে এটি স্থানান্তরিত হয়। এই স্থানান্তরপ্রক্রিয়ায় ভাইরাসটি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ১৯৭৬ সালে কঙ্গোর ইবোলা নদীর তীরে ইবোলা ভাইরাসটি নর-বানর থেকে মানুষের দেহে স্থানান্তরিত হয়। পরবর্তী সময়ে এটি মহামারি আকারে দেখা দেয়। ১৯৫০ সালের দিকে শিম্পাঞ্জিতে থাকা এসআইভি মানুষে এসে এইচআইভিতে রূপান্তরিত হয়। কঙ্গোতে শিম্পাঞ্জি শিকার করার সময় এটি মানুষের দেহে আসে। পরবর্তী সময়ে এটি হাইতি ও ক্যারিবিয়ান ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭০ সালের দিকে এটি নিউইয়র্কে পৌঁছে। এইচআইভিতে আজ সারা পৃথিবী জর্জরিত।

বন্য প্রাণী অসংখ্য ভাইরাসের উৎস, মূলত বাহক হিসেবে কাজ করে। এসব ভাইরাস বাহক থেকে অন্য কোনো প্রাণীর দেহে স্থানান্তরিত হলে ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। বাদুড় প্রায় দুই শ ধরনের ভাইরাসের বাহক। এর মধ্যে সার্স, মার্স অন্যতম। ভাইরাস বহনকারী বাদুড়সহ অন্যান্য বন্য প্রাণী কি তাহলে আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই? এমন ক্ষতিকর বন্য প্রাণী তো বিনাশ করাই শ্রেয়? কোভিডের পরিপ্রেক্ষিতে এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। গবেষণায় দেখা যায়, প্রকৃতিতে বাদুড় প্রায় পাঁচ শ প্রজাতির উদ্ভিদের পরাগায়ন ঘটায়। এর মধ্যে আমাদের প্রতিদিনের নাশতার টেবিলের কলাও রয়েছে। আবার একটি বাদুড় প্রতি রাতে তার দেহের ওজনের সমপরিমাণ কীটপতঙ্গ খায়। জিকা, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার ভাইরাস বহনকারী মশা এই বাদুড়ের প্রিয় খাবার।

মানুষ একসময় শকুনকে অশনি বিবেচনা করত। গবাদিপশুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত ডাইক্লোরোফেনাকের কারণে এই উপমহাদেশ থেকে ৯৯ শতাংশ শকুন বিলুপ্ত হলে শকুনের উপকারিতা মানুষের নজরে আসে। ভারতে ১১ বছরের ব্যবধানে শকুনের অনুপস্থিতিতে মৃত গবাদিপশু খেয়ে বেওয়ারিশ কুকুর ৭০ লাখ থেকে বেড়ে ২ কোটি ৯০ লাখে গিয়ে দাঁড়ায়। ওই সময়কালে ৩ কোটি ৮৫ লাখ মানুষ কুকুরের কামড়ের শিকার হয়, এর ফলে সৃষ্ট জলাতঙ্ক রোগ মোকাবিলায় ভারতীয় সরকারের ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার খরচ হয়। শকুনের পাকস্থলী তীব্রÿক্ষয়কারী অ্যাসিডসমৃদ্ধ। ফলে শকুন জলাতঙ্ক, অ্যানথ্রাক্স, কলেরা, ব্রোসেলা, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগের জীবাণু অনায়াসে বিনাশ করতে সক্ষম। অথচ অ্যানথ্রাক্সের একটি স্পোর মাটিতে শত বছর বেঁচে থাকতে পারে।

অতীতের নানা মহামারির মতো কোভিড-১৯ থেকেও হয়তো আমরা রেহাই পাব। তবে আমাদের বোধোদয় হবে কি না, সেটি নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। বিচক্ষণ মানুষের জন্য উন্নয়নের নতুন পথের সন্ধান গবেষণার বিষয় হতে পারে। করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি করতে করতে হয়তো আবার নতুন কোনো ভাইরাসের সৃষ্টি হবে। পৃথিবী আরেকটি মহামারির সম্মুখীন হবে। ফলে প্রতিষেধক তৈরির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধের উপায় খোঁজাটাও জরুরি। উন্নত মানের হাসপাতাল আর আধুনিক যন্ত্রপাতি বানিয়ে মানুষের রোগের চিকিৎসা করা যেতে পারে, পৃথিবীর অসুখের নিরাময় হবে না। ভবিষ্যতে অন্য কোনো মহামারি থেকে রেহাই পেতে হলে বিবস্ত্র ও বিকলাঙ্গ পৃথিবীর চিকিৎসায় আমাদের মনোযোগী হতে হবে।

এম এ আজিজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক