বোরো চাষিদের সহযোগিতা দরকার

সরকার বলেছে, এ বছর বোরো মৌসুমে ৬ লাখ টন ধান আর চাল ১১ লাখ টন কেনা হবে। সংগ্রহের পরিমাণ গত বছরের চেয়ে ২ লাখ টন বাড়ানো হয়েছে। তবে সংগ্রহ মূল্য গত বছরের মতোই রাখা হয়েছে। এ বছর ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। হেক্টরপ্রতি যদি ৬.৪ মে. টন ধান হলে সম্ভাব্য উৎপাদন তিন শ সাত লাখ মে. টন। সরকার সংগ্রহ করতে চাইছে ধান-চাল মিলিয়ে মোট ১৭ লাখ টন, মোট উৎপাদিত বোরো ফসলের মাত্র ৫-৬ শতাংশ মাত্র। করোনাভাইরাস দুর্যোগের মুখে এই সংগ্রহ-লক্ষ্যমাত্রা কি পর্যাপ্ত? আরও কিছু কি করার আছে? জাতির খাদ্যনিরাপত্তার কথা ভেবেই প্রশ্নটি বিবেচনার দাবি রাখে।

ধানচাষিদের কথা শুনতে হবে

গত বছর ধানচাষিরা প্রতি মণে এক-দু শ টাকা লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করেছেন। প্রতি মণে দুই শ টাকা লোকসান হলে বোরো চাষিদের এক মৌসুমে লোকসানের অঙ্ক হয় ১৫ হাজার কোটি টাকার ওপরে। ধানচাষিরা অন্তত চারটি খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে ধান ফলান। শুরু হয় বীজ দিয়ে। তারপর কিনতে হয় সার, কৃষি যন্ত্রাংশ, পানি ও কীটনাশকের খরচ। জমি লিজ আর ধান কাটার খরচ না হয় বাদ রাখছি।

ধানচাষির বীজ খাতে খরচ প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, সেচে যায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় ৫৫ লাখ মে. টনের বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহারের কথা আছে। এর ৭০-৭৫ ভাগ ধানের আবাদে যায়। এ জন্য কৃষকের খরচ ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। সঙ্গে আছে কৃষি যন্ত্রাংশের খরচ। তার বার্ষিক বাজার এখন ১০ হাজার কোটি টাকা। বড় আরেক খাত কীটনাশক। এর জাতীয় বাজারটি যদি দুই হাজার কোটির হয়, তার অর্ধেক অন্তত ধানচাষিদের কাছ থেকে যায়। এসবের ব্যবসায়ী হাজার হাজার কোটি টাকা পাচ্ছেন। সরকার সার, কৃষি যন্ত্রাংশ ইত্যাদিতে যে ভর্তুকি দেয়, তারও আংশিক সুবিধা পান ওই ব্যবসায়ীরা।

সার, বীজ, কীটনাশক ও পানি ব্যবসায়ী ছাড়াও ধান উৎপাদনের সুবিধাভোগী সরবরাহ ব্যবস্থা। 

চালের সরবরাহ ব্যবস্থাটি অদ্ভুত

চালের উৎপাদন বাড়ছে, দামও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। শহুরে ভোক্তা উদ্বৃত্ত উৎপাদনের সুবিধা পান না। গ্রামের উৎপাদকও শহরের বাড়তি দামের হিস্যা পাচ্ছেন না। চাল বাজারের বিশাল ধাঁধা এটা। ফসল-পূর্ব পর্যায়ে চাষিদের থেকে সরাসরি অর্থ যায় সার-কীটনাশক-বীজ-পানি ও যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ীদের কাছে। ফসল-পরবর্তী পর্যায়ে খোদ ধানই চলে যায় ৫-৬ স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু মানুষও চাল অর্থনীতির সুবিধা পান। সবচেয়ে বড় বাজারশক্তি আড়তদার ও অটো রাইস মিল। আছে ফড়িয়া, ব্যাপারী, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ী। সবাই যার যার সংঘবদ্ধতা ও ‘পরিস্থিতি অনুযায়ী’ মুনাফার অঙ্ক বসাতে চেষ্টা করেন। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে চালের দাম এমনভাবে বাড়ে,Ñ উৎপাদন পর্যায়ে তার ব্যাখ্যা মেলে না। এ রকম বিপজ্জনক একটা সরবরাহ ব্যবস্থাই চালের বাজার। এই বাজারে উৎপাদকের অংশগ্রহণ নগণ্য। এ এক অদ্ভুত অবস্থা। এই কারণে ‘ধনী জেলা’গুলোর তালিকায় প্রধান প্রধান ধান উৎপাদক জেলার নাম নেই। তাহলে চাষির অবদান যাচ্ছে কোথায়?

এই প্রতিবেদন লেখার সময় বাজারে চালের কেজি গড়ে ৫০ টাকা। এই হিসাবে ২৫ কেজি চালের দাম ১ হাজার ২৫০ টাকা। এক মণ ধান থেকে গড়ে ২৫ কেজি চাল হয়। কৃষক পর্যায়ে এক মণ ধান বিক্রি হয় ছয় শ থেকে সাত শ টাকায়। তার মানে অন্য কেউ প্রতি কেজি চালে প্রায় ২৫ টাকা আয় করছে। দেশে চাল উৎপাদিত হয় ৩ হাজার ৫০০ কোটি কেজি। এর প্রায় অর্ধেক বাজারে আসে। সে ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভের অঙ্কটি হিসাব করাও দুঃসাধ্য। 

সমস্যাটি কাঠামোগত

ধান-চালের অর্থনীতিতে সমাজের বড় একটা জনগোষ্ঠী থেকে ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠীর দিকে সম্পদ স্থানান্তরের স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে। এটা পদ্ধতিগতভাবে অসাম্য বাড়াচ্ছে গ্রামে। লোকসানি চাষিরা কেবল আর্থিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হন না,Ñ এতে তাঁদের জীবনের দৈর্ঘ্যও কমে। চিকিৎসা, শিক্ষা, বিনোদন, বিশুদ্ধ পানি ও উন্নত খাবারে তাঁদের অভিগম্যতাও কমে। তাঁদের আবাসন সংকটে ভুগতে হয়। 

ধান অর্থনীতির উত্থান-পতনের সঙ্গে দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতিরও গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যেহেতু চালের সর্বাধিক ক্রেতা শহরে,Ñ তাই চালের দামের সঙ্গে শহুরে দারিদ্র্য পরিস্থিতির সম্পর্ক প্রশ্নাতীত। বিভিন্ন গবেষণায় এ–ও দেখা গেছে, চালের মূল্যবৃদ্ধি গ্রামের দারিদ্র্য পরিস্থিতিরও অবনতির এক বড় কারণ। 

এভাবে দারিদ্র্য বাড়লে আর কী ঘটে এবং কেন এসব একটা কাঠামোগত সন্ত্রাসÑ, এ নিয়ে বিতর্ক উঠতে পারে। কিন্তু কেউ যখন একদল মানুষের থালা থেকে খাবার কমিয়ে ফেলে, শরীর থেকে সুস্বাস্থ্য কেড়ে নেয়, জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং এসব যখন একটা প্রক্রিয়ায় বারবার ঘটে, তখন তাকে কাঠামোগত সহিংসতাই বলতে হবে। 

তবে ২০২০ সালে এই অবস্থায় নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে। ভাইরাস সংক্রমণের মুখে আগামী মাসগুলোতে খাদ্যনিরাপত্তার প্রশ্নটি প্রধান ভাবনার বিষয় হয়ে উঠবে। বোরো মাঝপথে এখন। এক মাসের মধ্যে ধান আসবে। কিন্তু কৃষক জানে না কীভাবে ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। এ–ও জানে না প্রত্যাশামতো ‘বাজার’ পাবেন কি না। অনেক এলাকা লকডাউন। হাট-বাজার বিপন্ন। পরিবহন বন্ধ। ধানক্ষেতগুলো সবুজ থেকে সোনালি রং নিচ্ছে। দূর থেকে দেখতে সুন্দর লাগছে সেটা। কিন্তু চাষিদের ঘুম নেই। শহরেও মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ভাইরাস শঙ্কার পাশাপাশি রয়েছে খাদ্যশস্যের সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ। 

এ রকম এক ক্রান্তিকালে বোরো নিয়ে পুরো বাংলাদেশকে যুদ্ধকালীন জাতীয় ঐক্যের কথা ভাবতে হবে। এই ফসল নির্বিঘ্নেœ ঘরে তুলতে চাষিদের সব উপায়ে মদদ দরকার। এই ধানের বিরাট অংশ ন্যায্য দামে সংগ্রহ করে জাতীয় হেফাজতে রাখা জরুরি। লকডাউন চলতে থাকলে ফসল কাটায় স্থানীয় সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এগিয়ে আসে, তার জন্য উদ্দীপনামূলক আহ্বান দরকার এখনই। সরবরাহব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্তরা কেউ যেন ফসল নিয়ে জাতীয় স্বার্থবিরোধী কিছু করতে না পারে, সেটাও নিশ্চিত করা দরকার। এসব বিষয়ে যুদ্ধকালীন নজরদারি প্রয়োজন।

করোনা সংকট অর্থনীতিকে কত দিন খামচে ধরে রাখবে, Ñআমরা জানি না। কিন্তু এটা তো নিশ্চিত, ১৭ কোটি মানুষকে প্রতিদিন ভাত খেতে হবে। আসন্ন সেই ভাতযুদ্ধের প্রস্তুতিও জরুরি।


আলতাফ পারভেজ গবেষক