বিশ্বব্যবস্থা বদলাবে না, আরও খারাপ হবে

বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তনের কারণ হতে পারে করোনা মহামারি। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কে আরও অবনতি হয়েছে। ছবি: রয়টার্স
বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তনের কারণ হতে পারে করোনা মহামারি। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কে আরও অবনতি হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

করোনার প্রাদুর্ভাবে সারা বিশ্ব জেরবার। আইএমএফসহ অনেকেরই শঙ্কা আরেক দফা মন্দার কবলে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব। বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তনের কারণ হতে পারে করোনা মহামারি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক। অনেকের ধারণা ছিল করোনা কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এবং চীন হবে এর প্রধান শিকার। কিন্তু করোনার বৈশ্বিক বিস্তার ভাবনায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য করছে। ইতিমধ্যেই করোনার রাজনৈতিক প্রভাবও পরিলক্ষিত হতে শুরু করেছে। তবে রাজনৈতিক প্রভাব তাৎক্ষণিক হলেও অর্থনৈতিক প্রভাব হবে ধীর ও দীর্ঘস্থায়ী।

করোনা বিশ্বায়ন ধারণায় আঘাত হানবে। একই সঙ্গে নয়া উদারবাদ রাজনীতিকে দুর্বল করে দেবে। এবং পুঁজিবাদ ও লোকরঞ্জনবাদকে নতুনভাবে শক্তিশালী করবে। করোনার ব্যাপক বিস্তারের পুঁজিবাদ সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখছে। মুনাফামুখী প্রবণতাই করোনা বিস্তারের অন্যতম কারণ। শুরুতেই দ্রুত কলকারখানা, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলে প্রাদুর্ভাব অনেকটাই কমানো সম্ভব হতো। কিন্তু বন্ধ কি আর হয় মুনাফানির্ভর অর্থনীতিতে? এখানে লাভ-ক্ষতির অঙ্ক আছে। মানুষের মৃত্যু নিয়ে পুঁজিপতিদের খুব বেশি ভাবনা নেই। বছর শেষে ব্যালেন্স শিটে টান না পড়লেই হয়। তাই তো কলকারখানা বন্ধ করতে নানা টালবাহানা করেছে সরকারগুলো শুরুর দিকে। জনবান্ধব না, ব্যবসায়ী বান্ধব সরকারের সংখ্যাই বেশি বিশ্বে। যে কারণে ব্যাপক হারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন।

করোনার এই ব্যাপক বিস্তৃতি ও প্রাণহানি সরকারগুলোর জাতীয়তাবাদী ও কর্তৃত্ববাদী চরিত্রকে প্রকাশ করে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। আমদানি ও রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে অনেক দেশ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ১১ মার্চ ইউরোপ থেকে যাত্রী প্রবেশ বন্ধ ঘোষণা করেন। হাঙ্গেরির ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী সরকারও সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। সংকট মোকাবিলার জন্য হলেও পরবর্তী সময়ে সরকারগুলোর এই ধরনের নীতি অর্থনীতি ও রাজনীতিকে আন্তর্জাতিক রূপ থেকে জাতীয়তাবাদী চরিত্রের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

সাম্প্রতিক এই সিদ্ধান্তগুলো হতে পারে সাময়িক। করোনার মহামারি হ্রাস পেলেই সরকারগুলো তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনও করতে পারে। কিন্তু করোনা অর্থনীতির গতিপ্রবাহকে প্রভাবিত করবে। করোনার আগে থেকেই কিছু দেশের সিদ্ধান্ত বিশ্বায়নকে নাকচ করে দিচ্ছিল। পণ্য ও শ্রমের অবাধ প্রবাহকে আটকে দেওয়ার জন্য অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি, ফ্রান্স বিভিন্ন দেশে লোকরঞ্জনবাদীরা সক্রিয় হয়ে উঠছে। লোকরঞ্জনবাদীরা দেশীয় অর্থনীতিকে রক্ষার কথা বলে অভিবাসন বন্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে চাইছে। করোনার বিপর্যয় লোকরঞ্জনবাদীদের নতুন করে সুযোগ দেবে। ইতিমধ্যে চীনাবিরোধী একধরনের প্রচারণা গড়ে উঠছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাকে চীনা ভাইরাস বলে মন্তব্য করেছেন।

এ ধরনের প্রচারণা চীনকেন্দ্রিক পণ্য সরবরাহব্যবস্থাকে বিপাকে ফেলতে পারে। সস্তা শ্রমের কারণে চীনের বাজার বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চীনে শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুই দফা চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছেন। শুল্ক আরোপ ও করোনার কারণে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে চীনের রপ্তানি ২০১৯ সালের তুলনায় ১৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অনেক কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। ইউরোপীয় কোম্পানি, বিশেষ করে গাড়ি ও আইফোনের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।

শ্রমের মজুরি বৃদ্ধি ও বর্তমান পরিস্থিতির চাপে বিনিয়োগকারীরা বিকল্প অনুসন্ধানে নামতে পারে। চীনের বিকল্প হিসেবে ভিয়েতনাম বা ইন্দোনেশিয়াকে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের পছন্দ হতে পারে। এ ছাড়া মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকা উত্তম পছন্দ হতে পারে। ইউরোপের ব্যবসায়ীরা পূর্ব ইউরোপ বা তুরস্কের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে।

ভবিষ্যৎ এই অর্থনৈতিক দুর্যোগ এড়ানোর জন্য চীন শক্ত হাতে করোনা মোকাবিলা করেছে যথারীতি নিজের চরিত্র বজায় রেখেই। সমাজকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, তথ্য চেপে রেখে, সাংবাদিকদের আটক করে শক্তি ও সামর্থ্যের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটিয়েছে চীন। এ কারণেই চীনে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়ে তর্ক রয়েছে। চীন তিন হাজারের বেশি মৃত্যুর হিসাব দিলেও পশ্চিমা গণমাধ্যম বলছে এর সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। ডেইলি মেইল–এর হিসাব অনুসারে ৪২ হাজার এবং ওয়াশিংটন পোস্ট–এর হিসাবে ৫০ হাজার। ব্লুমবার্গ বলছে, চীনের মোবাইল কোম্পানিগুলো এক মাসে ২ কোটি ১৪ লাখ মোবাইল গ্রাহক হারিয়েছে।

ওদিকে তুর্কমিনিস্তানে করোনা শব্দ উচ্চারণ ও মাস্ক ব্যবহার করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। হাঙ্গেরির ভিক্টর ওরবান পার্লামেন্ট থেকে অগাধ ক্ষমতা লাভ করেছেন করোনা মোকাবিলার জন্য। পার্লামেন্টের অনুমোদন ছাড়াই তিনি করোনা নিয়ে গুজবের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। সমালোচকেরা বলছেন, ওরবান করোনাকে পুঁজি করে নিজের ক্ষমতা বাড়িয়ে নিলেন। মিসর তিন পশ্চিমা সাংবাদিককে বহিষ্কার করেছে সরকারের ভুল তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশের জন্য। ইরানও শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতা, জীবাণু অস্ত্রের প্রয়োগ ইত্যাদি কথা বলে করোনার বিস্তার স্বীকার করতে চায়নি। উত্তর কোরিয়া নিজেদের করোনামুক্ত ঘোষণা করেছিল এবং দেশটির ভেতরে এই ঘোষণা নাকচ করে দেওয়ার কোনো শক্তি নেই। এ রকম অনেক দেশের শাসকেরাই করোনার তথ্য চেপে যাচ্ছেন এবং গুজব ছড়ানোর কথা কলে বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রহিত করছেন।

অনেকেই বলাবলি করছেন করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে পারে। বিশেষ করে চীনের একক নেতৃত্বের উত্থান ঘটতে পারে। মনে হয় না এমন কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কারণ, চীন এখনো একক নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত না। বরং বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাই বজায় থাকবে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব আরও বাড়তে থাকবে। পাশাপাশি রক্ষণশীল ধারা দেশে দেশে শক্তিশালী হবে। রক্ষণশীলেরা স্থানীয় বাজারের চাহিদা নিশ্চিত করে রপ্তানির নীতিকে সমর্থন করবে। অভিবাসন বন্ধের পক্ষে কাজ করবে স্থানীয় শ্রমকে ব্যবহারের জন্য।

মূলত করোনা সংকট রক্ষণশীল ও উদারনৈতিক উভয় পক্ষকেই যুক্তি তৈরি করার সুযোগ দেবে। যেমন করোনা সংকট নিয়ে রক্ষণশীল ও বিশ্বায়ন বিরোধীদের যুক্তি হতে পারে, আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) ওপর ভরসা করেছিলাম এবং ডব্লিওএইচও ব্যর্থ হয়েছে। ডব্লিওএইচওর পরামর্শ সবাইকে মানতে হয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা সফল হয়নি। বরং স্থানীয়ভাবে মোকাবিলার নীতি গ্রহণ করতে হবে। অন্যদিকে উদার আন্তর্জাতিকতাবাদীরা করোনার অভিজ্ঞতা থেকে বৈশ্বিক হেলথ গভর্ন্যান্সের ওপর গুরুত্বারোপ করবে বেশি করে।

মোটকথা, উদারপন্থী ও রক্ষণশীল উভয় দলই করোনার মহামারিকে ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান সংহত করতে চেষ্টা করবে। এতে আন্তর্জাতিকতাবাদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সংঘাত তৈরি হবে। তবে নতুন ব্যবস্থার সূচনা করবে না। পরিস্থিতিকে উল্টেও দেবে না। হার্ভার্ডের রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক ড্যানি রড্রিক মনে করেন, নয়া উদারতাবাদ, বিশ্বায়নের ধারণা দিন দিন আকর্ষণ হারাবে। লোকরঞ্জনবাদী কর্তৃত্ববাদী শাসকদের অবস্থান আরও পাকাপোক্ত হবে। বিশ্বায়নের নীতিকে জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রতিস্থাপিত করবে। রাষ্ট্রের ভেতরে ধনিক শ্রেণি, নব্য ফ্যাসিবাদ এবং বিশ্বায়নবাদী উদারপন্থীদের মধ্যে লড়াই আরও প্রকট হবে। অধিকাংশ ভোটারদের আকর্ষণ করার মতো কোনো কর্মসূচি দিতে বামপন্থীরা পারবে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হয় অধ্যাপক রড্রিক খুব একটা ভুল কিছু বলেননি।

মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক