দুর্দশাগ্রস্থদের পাশে থাকুন

জীবনযাপনের যাবতীয় আবশ্যিক খরচ মেটানোর উপায়গুলো একে একে বন্ধ হয়ে আসছে। এ কথা ঠিক যে অন্য অনেক কিছু হয়তো সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা যায়, কিন্তু পেট চালানোর তাগিদ তো বাকি রাখা যায় না। দুর্যোগ মোকাবিলায় সুলতানা কামালের একগুচ্ছ পরামর্শ
জীবনযাপনের যাবতীয় আবশ্যিক খরচ মেটানোর উপায়গুলো একে একে বন্ধ হয়ে আসছে। এ কথা ঠিক যে অন্য অনেক কিছু হয়তো সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা যায়, কিন্তু পেট চালানোর তাগিদ তো বাকি রাখা যায় না। দুর্যোগ মোকাবিলায় সুলতানা কামালের একগুচ্ছ পরামর্শ

মার্চ মাস থেকে একান্ত ব্যক্তিগত কারণে আমি লন্ডনবাসী। এখানে আসার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই করোনাভাইরাসের দাপটে গৃহবন্দী অবস্থায় চলে যেতে হলো। সদ্যোজাত শিশু ও সত্তর বছর বয়সী মা—এই আমাকে আমার মেয়ে আর জামাতা মিলে অদৃশ্য কিন্তু ভয়ংকর শত্রুর থাবা থেকে বাঁচাতে সদা সন্ত্রস্ত। আমাকে রাখা হয়েছে কড়া পাহারায়। যুক্তরাজ্যে কোভিড-১৯–এর প্রকোপ বাড়তে থাকায় যথাসম্ভব সুরক্ষিত থাকার আপ্রাণ চেষ্টাই এখন সবচেয়ে বড় কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যেই চারদিকের খবরাখবরও কানে আসছে। অবধারিতভাবেই দেশের খবরের জন্যই উদগ্রীব হয়ে থাকি। ব্যক্তিগত যোগাযোগে এবং গণমাধ্যম মারফত পরিস্থিতির যে বর্ণনা পাই, তাতে উৎকণ্ঠিত না হয়ে পারা যায় না।

মানুষ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেকে বা অন্যকে বাঁচাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারটিকে এখনো গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করছে না। সরকারের নির্দেশনা, বেসরকারি বা সামাজিক সংগঠনের তৎপরতা, গণমাধ্যমের সতর্কবাণী সবকিছুকে তুচ্ছ করে মানুষ একে অপরের সংস্পর্শে আসছে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাতায়াত করছে। সেনাবাহিনীর উপস্থিতিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ফল আনছে না। এ তো গেল সংক্রমণ রোধে আমাদের ব্যক্তিগত ও সামগ্রিক দায়বদ্ধতার প্রতি নিদারুন অসচেতনতা এবং অবহেলার প্রকাশ। অন্যদিকে মানুষ গৃহবন্দী হয়ে থেকে প্রতিদিনকার জীবন চালাবে কী করে, সেই প্রশ্নও এখন প্রকটভাবে সামনে চলে এসেছে। দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী, নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত সীমিত উপার্জনের মানুষ—তাঁরা বিত্তশালীদের তুলনায় যে অধিকতর এবং ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। জীবনযাপনের যাবতীয় আবশ্যিক খরচ মেটানোর উপায়গুলো একে একে বন্ধ হয়ে আসছে। এ কথা ঠিক যে অন্য অনেক কিছু হয়তো সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা যায়, কিন্তু পেট চালানোর তাগিদ তো বাকি রাখা যায় না।

খুব সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের (৭১ টিভি, ১২ এপ্রিল) আলোচনায় একটি তথ্য উঠে এসেছে যে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে খাদ্যসহায়তা প্রয়োজন, এমন মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটি। এবং এই প্রয়োজন এখনই। আর একটি মতামত হলো, এই সহায়তা অন্তত এক বছর ধরে অব্যাহত রাখতে হবে। যতদূর শুনেছি সরকার তার প্রশাসনের এবং নিজ দলীয় সদস্যদের মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। সরকারের একার পক্ষে এত বিশাল কর্মযজ্ঞ সুষ্ঠুভাবে সমাধা করা সম্ভব নয়, এই উপলব্ধিতে বেসরকারি ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করার কর্মপরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেটাও অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে। এর জন্য সর্বক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বাড়ানো এবং ন্যায্য ও দুর্নীতিমুক্তভাবে এ দায়িত্ব পালন করার সার্বিক প্রচেষ্টা করতে হবে সবাই মিলে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বিলম্ব না করে ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ জোগাড় করার কাজ হাতে নিয়েছে। এখানে বাসদের ‘মানবতার ঘর’ও একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। আমার বিভিন্ন ক্ষেত্রের সহকর্মীরা ব্যক্তিগত কিংবা পাড়াভিত্তিক উদ্যোগ নিয়ে যথাসাধ্য খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে। অত্যন্ত মহৎ এই উদ্যোগ যে নেহাতই অপ্রতুল, সন্দেহ নেই। তবে কিছু মানুষকে অবশ্যই উদ্বুদ্ধ করার মতো। অনদিকে জামালপুরের মতো ঘটনা বা অন্যান্য শহরে খাদ্যসামগ্রী আত্মসাৎ করে নিজের ঘরে মজুত করার যে খবর পাওয়া গেছে, তার পুনরাবৃত্তি কাম্য নয় কারোরই। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আশা করি প্রশাসন, রাজনৈতিক কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এই বার্তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে সচেষ্ট থাকবেন।


খাদ্য সরবরাহ ত্রাণকেন্দ্রিক না হয়ে উৎপাদক গোষ্ঠী ও সরবরাহকারীর সঙ্গে সরাসরি গ্রাহকের অনলাইন/এসএমএস অর্ডারের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে দিতে পারলে খাবার সংগ্রহ করার অজুহাতে লোকজনকে বাড়ির বার হতে হবে না। বাড়ির দরজায় প্রয়োজনীয় দ্রব্য পৌঁছে দিয়ে সরবরাহকারী নিরাপদ দূরত্ব থেকে গ্রহীতার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারেন। একটু সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজটি করা আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশে একেবারে অসম্ভব হবে না বলে আশা করতে চাই। বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য অধিকতর যত্ন নিয়ে এ ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা যেতে পারে।

সংবাদভাষ্য বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন অনুসরণ করে সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের চিহ্নিত করা দুঃসাধ্য নয়। শিশু, বস্তিবাসী, আদিবাসী সম্প্রদায়, একা নারীদের পরিবার, দিনমজুর-কৃষি বা শিল্পকারখানার শ্রমিক, তাঁদের জন্য অবিলম্বে এ রকম কিছু ব্যবস্থা শুরু করা যায়। অবশ্যই যেন এ ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে করা হয়। এতে সমাজের বিত্তশালী ও আগ্রহীদের সামর্থ্য ও সক্ষমতা অনুযায়ী সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে হাত দিতে হবে। তবে এটাই একমাত্র উপায় বলতে চাই না। বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে নীতি ও পরিকল্পনা নিরূপণে ভূমিকা রাখতে পারেন। মোটকথা বিপন্ন মানুষগুলো যাতে খাদ্যাভাবে আরও বিপর্যস্ত হয়ে না পড়ে, সে জন্য আসুন সবাই মিলে যার যা অবস্থান, সেখান থেকে তার যথাযথ উপায় বার করার চেষ্টা এবং তা কার্যকর করার জন্য পরস্পরের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করি।

সাধারণ মানুষের সুরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী এবং অন্য যাঁরা আমাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের নিরাপত্তা বিধানে যেন কোনো বিচ্যুতি না ঘটে, সেদিকে লক্ষ রাখাটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সরকারকে এ বিষয়ে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।

এরই মধ্যে দিনের নিয়মে নতুন বছর এসে গেল। বৈসাবি, ইস্টার পার হয়ে ১৪২৭ সাল সমাসন্ন। যতই সুদূরপরাহত মনে হোক না কেন, তারপরও নতুন বছরে সবার মঙ্গল কামনা করি। পৃথিবী আবার সবার সসম্মান মর্যাদাসম্পন্ন স্বাভাবিক বাসভূমিতে পরিণত হোক, এই প্রার্থনা রাখি।


১৩ এপ্রিল, ২০২০। লন্ডন, যুক্তরাজ্য।

সুলতানা কামাল: মানবাধিকারকর্মী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ১৩ এপ্রিল, ২০২০। লন্ডন, যুক্তরাজ্য।