জিডিপি ভাবনা আপাতত দূরেই থাকুক

আ হ ম মুস্তাফা কামাল। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
আ হ ম মুস্তাফা কামাল। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির মোহ আমাদের প্রায় সবারই কমে বেশি আছে। তবে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের যে বেশি আছে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জিডিপি প্রবৃদ্ধি মানেই যে অর্থনীতির উন্নতি না ৬০ দশকেই যদিও এর ফয়সালা হয়ে গেছে। তারপরেও প্রবৃদ্ধির বিভ্রম কাটানো সহজ নয়। এমনকি প্রবৃদ্ধি বাড়লে এর ছিটেফোঁটাও চুঁইয়ে নিচে নামার যে ‘ট্রিকল ডাউন’ নীতি, সেখান থেকেও কিন্তু খোদ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) সরে এসেছে।

সন্দেহ নেই গত এক দশকে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে একটা শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। আর সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বাংলাদেশ ধরে রেখেছে ৯০ এর পর থেকেই। অর্থাৎ জিডিপি বাড়ার একটা শক্ত ভিত অনেক দিন ধরেই তৈরি হচ্ছিল। প্রয়োজন ছিল একটি ভালো পরিবেশের। আওয়ামী লীগ সরকার সেই পরিবেশটি দিতে পেরেছে। প্রাপ্য এই প্রশংসাটুকু দিয়েই বলা যায়, সময় এখন বৈরী, আর তা পুরো বিশ্ব জুড়েই। সবাই জানি করোনাভাইরাস জীবনের ওপর যতটা আঘাত, জীবিকার ওপর আঘাতও মোটেই কম নয়। সারা বিশ্বের অর্থনীতি থমকে আছে। অর্থনীতির ক্ষত কতটা তা পুরোপুরি জানা যাবে করোনাভাইরাসের বিদায়ের পরে।

তবে এরই মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির এক ধরনের হিসাব কষা শুরু হয়ে গেছে। পাশাপাশি শুরু হয়েছে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে নানা কর্মসূচি ঘোষণা। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক করোনাভাইরাসের প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি কোথায় দাঁড়াবে এ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলা দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২ থেকে ৩ শতাংশ হারে নেমে যেতে পারে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ নিয়ে কিছুটা সতর্ক একটি প্রতিক্রিয়াও দিয়েছেন। বলা বাহুল্য যে তিনি বিশ্বব্যাংকের এই প্রাক্কলন মানেননি। সর্বশেষ, আইএমএফও একই ধরনের মূল্যায়ন করেছে।

বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ২০১৯ সালটি কিন্তু খুব ভালো ছিল না। মন্দার আশঙ্কা নিয়ে পুরো বছরটি কেটেছে। আর এর প্রভাবে অর্থবছরের প্রায় শুরু থেকেই বাংলাদেশের রপ্তানি খাত ছিল মন্দায়। একই অবস্থা ছিল আমদানির ক্ষেত্রেও। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিও খুব স্বস্তিদায়ক ছিল না। এ কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছিল। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহও ছিল বেশ কম। সব মিলিয়ে অর্থনীতির গতি যে শ্লথ হয়ে যাচ্ছে তার ইঙ্গিত ছিল প্রায় সব সূচকেই। আর ব্যাংক খাততো দুর্বল অনেক আগে থেকেই। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল প্রবাসী-আয়। ‘অর্থের সন্ধানে মরিয়া সরকার’ বা ‘একটি ছাড়া অর্থনীতর সব সূচকই নিম্নমুখী’-এসবই ছিল বিভিন্ন সংবাদের শিরোনাম। এ রকম এক অবস্থায় করোনার আঘাত। মহামারি কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়েই অর্থনীতির মহামন্দা নিয়ে আসছে।

এ রকম এক সময়ে অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও জিডিপির কথা পুরোপুরি ভুলে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো। জিডিপি কত হরে এই বিতর্ক এখন একেবারেই অহেতুক। বরং বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের এই প্রাক্কলনকে সতর্কবার্তা হিসেবে নেওয়াটাই অর্থনীতির জন্য ভালো। মনে রাখা দরকার পরিস্থিতি যথেষ্ট খারাপ, এক দশকের অর্জন মুছে যাওয়ার উপক্রম, দারিদ্র্য পরিস্থিতি উন্নতির যে ধারায় দেশ এসেছিল তাও হয়তো আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। এই মুহূর্তের প্রথম কাজই হচ্ছে জীবন বাঁচানো, আর জীবিকা বাঁচানো। আর এ দুটো করা গেলে জিডিপিও বাড়বে। সারা বিশ্ব এখন এ কাজটিই করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবের সময় অর্থনীতির বেশ কিছু দুর্বলতা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বড় দুর্বলতা হচ্ছে আনুষ্ঠানিক খাতে বাইরে যারা তাদের হাতে সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কোনো পদ্ধতি আমাদের জানা নেই। এখনো দেশের বড় সংখ্যক মানুষ ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে। সুতরাং তাদের কাছে সহায়তা কীভাবে যাবে তাও আমরা জানি না। স্বাভাবিক সময়েই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রধান সমস্যাই হচ্ছে অর্থায়নের, অর্থাৎ ব্যাংক থেকে ঋণ না পাওয়া। আর এখন ব্যাংক ঋণনির্ভর প্রণোদনার ভাগ তারা কীভাবে পাবেন তাও জানা নেই। সরকার বা অর্থমন্ত্রী সবচেয়ে বেশি ভরসা করে আছেন ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর। খেলাপি ঋণসহ সুশাসনের নানা সংকটের কারণে দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা সবারই জানা। আরেক দুর্বলতা হচ্ছে ৪০ বছরেও দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখেনি। আবার যারা দুস্থ তাদের কাছে খাদ্য নিয়ে যাওয়ার কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থাও আমরা তৈরি করতে পারিনি। ফলে খোলা বাজারে চাল বিক্রি যেমন বন্ধ করতে হয়েছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকেও ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে সাহায্যের চাল চোর ধরতে। অথচ এগুলোই ছিল এ সময়ের সবচেয়ে জরুরি কাজ।

এক দশকের উচ্চ প্রবৃদ্ধির মধ্যেও অর্থনীতির আরেকটি বড় দুর্বলতার নাম ‘কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি’। এখন ঘরবন্দী মানেই কাজ বন্ধ। ঘরবন্দী জীবন কেটে গেলেই কাজে ফিরতে হবে। সবাই যেন কাজে ফিরতে পার সেই ব্যবস্থাটি করা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে সৃষ্টি করতে হবে নতুন কর্মসংস্থান। আর এ জন্য লাগবে নতুন বিনিয়োগ। কিন্তু চাহিদা না থাকলে নতুন বিনিয়োগ তো হবেই না, বিদ্যমান বিনিয়োগও অলস বসে থাকবে। চাহিদা বাড়ানো হবে অর্থনীতির জন্য সামনের দিনের প্রধানতম কাজ। আর চাহিদা তখনই বাড়বে, যখন মানুষের হাতে টাকা থাকবে। মন্দার বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর অনিশ্চয়তা, অর্থ খরচ না করার প্রবণতা। আর প্রবাসী শ্রমিকদের কাজ কমে গেলে বা ফিরে আসতে হলে পল্লি অঞ্চলে চাহিদার ওপর বিশাল আঘাত নেমে আসবে। এটিও ঘটবে। সব মিলিয়ে সংকট বহুমাত্রিক। ফলে সামগ্রিক ভাবেই মানুষের হাতে অর্থ থাকার কাজটি সরকারের পরিকল্পনার একটি বড় অংশ জুড়েই থাকতে হবে। মনে রাখা আরও জরুরি, মানুষের হাতে কাজ না থাকলে তা হবে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্যও বড় হুমকি।

বাংলাদেশের মতো দেশে পর্যাপ্ত অর্থ হাতে নিয়ে পরিকল্পনা করা এবং এর বাস্তবায়ন মোটেই সহজ নয়। সরকার মুখে যতই বলুক, অর্থ একটি বড় সমস্যার নাম। আর এ কারণেই প্রণোদনা কর্মসূচি মূলত ব্যাংকনির্ভর। বাইরের ভরসা কেবল বহুপক্ষীয় দাতা সংস্থা। সরকারের চলতি ব্যয়ের খাতটি এতই বড় যে কৃচ্ছ্রসাধন থেকে খুব বেশি সাশ্রয় করা যাবে বলে মনে হয় না। খানিকটা স্বস্তি হচ্ছে জ্বালানি তেল কিনতে কম অর্থ লাগবে। হবে তেলের দাম কমা মানেই মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের আয় কমে যাওয়া। ফলে সরকারের হাতে থাকা সর্বশেষ পথ হচ্ছে টাকা ছাপানো। তাতে আবার মূল্যস্ফীতির ভয়। সামাল দিতে না পারলে পরিস্থিতি হবে ভয়ংকর।

সুতরাং জিডিপি কত হবে তার চেয়েও বড় দুর্ভাবনা অর্থনীতিতে আছে। আর বাজার ব্যবস্থা সব ঠিক করে দেবে এমন পরিস্থিতি একেবারেই নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই করোনাকালই হচ্ছে এমন একটি সময়, যখন সবার ভরসার জায়গা কেবল সরকার, একমাত্র সরকার। এ সময়ে জীবন ও জীবিকা টিকিয়ে রাখার পুরো কাজটি করতে হবে সরকারকেই। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকবেন সবাই।

সরকার প্রধান তো থাকবেনই, তবে সারা বিশ্ব জুড়েই সবার নজর থাকবে অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরদের দিকে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের জন্য সামনে অনেক কাজ। অনেক কিছুই তাকে হয়তো নতুন করে শুরু করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে ভাবতে হবে নতুন করে। পাশাপাশি অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার সঠিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দুরূহ কাজে নেতৃত্ব দিতে হবে তাকেই। এ কাজে তিনি সহকর্মীদের কতটা পাবেন, প্রশাসনযন্ত্র কতটা সহায়ক হবে বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়ার মানসিকতা তার নিজের কতটা আছে, তাও কিন্তু বড় প্রশ্ন। তারপরেও সব মিলিয়ে অর্থমন্ত্রীর সামনে কঠিন এক সময়। এই যুদ্ধের মাঠে নামার সময়ে জিডিপি ভাবনা আপাতত না হয় দূরেই থাকুক।

শওকত হোসেন: প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক
[email protected]