অপেক্ষায় আছে এক নতুন বিশ্ব

সাধারণত আপাতদৃষ্টে ছোট মনে হওয়া ঘটনাই পরে বড় অর্থনৈতিক দুর্গতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধকি ঋণ খেলাপের হার বাড়তে থাকা অর্থনীতিবিদদের শঙ্কিত করলেও জনপরিসরে তেমন বিবেচ্য কিছু হয়নি। কিন্তু এটিই বিগত মন্দার আগমনী সংকেত। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, গত শতকের তিরিশের দশকের মন্দার কথাও। ১৯২৯ সালে নিউইয়র্ক শেয়ারবাজারে ঘটা পতনকে শুরুতে অত বড় কিছু মনে হয়নি। কিন্তু এটিই ছিল দীর্ঘসূত্রী এক মন্দার সূচনাবিন্দু, যা ইউরোপে উত্থান ঘটিয়েছিল ফ্যাসিস্ট সরকারগুলোর, যা থেকে বিশ্বকে নিয়ে গিয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতায়। তিরিশের ওই মহামন্দা গোটা বিশ্বের খোলনলচে বদলে দিয়েছিল। নতুন করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি এমনই এক বাস্তবতায় এনে দাঁড় করিয়েছে, যা একই সঙ্গে শঙ্কা ও সম্ভাবনা দুইই সামনে এনেছে।

মোটাদাগে এটা সত্য যে বৈশ্বিক এ মহামারির কারণে বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামোটি ভেঙে পড়বে। কিন্তু এ সত্যটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে সম্ভাবনার বীজ। বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে পড়ার অর্থ হচ্ছে, নতুন কোনো কাঠামোর আবির্ভাব। নতুন বলে, অচেনা বলে তা শঙ্কা তৈরি করবে অধিকাংশের মনে। কারণ, অচেনা রাস্তা তো দীর্ঘ ও ভীতিকর মনে হয়। কিন্তু যদি তাকানো যায়, সম্ভাবনার দিকে তবে আশ্বাসও পাওয়া যায়। কারণ, নতুন পথই দিতে পারে নতুন দিগন্তের আভাস।

অর্থনীতি বিষয়টি আদতে বাতাসের সঙ্গে তুলনীয়। মানুষ বাতাসের সমুদ্রে থেকেও যেমন এর অস্তিত্ব নিয়ে উদাসীন থাকে, অর্থনীতিও তেমনই। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, আরও ভালো করে বললে অর্থনৈতিক উৎপাদন ও বণ্টনপদ্ধতির সঙ্গে প্রত্যেক মানুষ কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। বাতাসের স্বল্পতা যেমন এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সজাগ করে, তেমনি এই মুহূর্তে রোগ প্রতিরোধের অংশ হিসেবে নেওয়া অবরোধব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যাওয়াই তার কথাটি বেশি করে মনে করিয়ে দিচ্ছে। সে এখন টের পাচ্ছে যে ব্যাংক বা চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যেমন, পাড়ার মুদি দোকান বা সেলুনটির সঙ্গেও তার অনুরূপ অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এর একটি বিকল হলে তার প্রভাব পুরো সমাজে পড়ে।

আর যদি বৈশ্বিক অর্থনীতির কথা বলা হয়, তবে এর বিভিন্ন উপাদান এমন জটিলভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত যে তা ঠিকমতো ঠাওর করতে পারাটাও বিরাট যোগ্যতার বিষয়। এই ঠাওর করার কাজটি করেন অর্থনীতিবিদেরা। আর বৈশ্বিক অর্থনীতির এ গতিপ্রকৃতিই বলে দেয় যে ভবিষ্যতের বিশ্বে কোন রাজনৈতিক মতবাদটি বেশি জনপ্রিয় হবে। এখানে রাজনৈতিক মতবাদটি মূলত উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়।

মনে করা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পর বিদ্যমান কাঠামোর অনেক উপাদানই অকেজো হয়ে পড়বে। ফলে বর্তমানের চেনা বৈশ্বিক অর্থনীতি এমনভাবে বদলে যেতে পারে, যা দেখে আর একে চেনা যাবে না। কথা হচ্ছে, কোন বৈশ্বিক অর্থনীতির বদলের কথা বলা হচ্ছে? এ তো সেই অর্থনৈতিক কাঠামো, যেখানে বিলাস ও বৈষম্য একসঙ্গে উৎপাদিত হয়। এ তো সেই কাঠামো যা মানুষের উন্নয়নের কথা বলে, ধ্বংসের লীলায় মাতে। এ তো সেই অর্থনীতি, যা প্রকৃতি থেকে মানুষকে দূরে ঠেলতেই বেশি তৎপর। এ তো সেই কাঠামো, যা মানুষকেও বিচ্ছিন্ন করে পরস্পর থেকে। এই কাঠামো তো খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো মৌলিক বিষয়গুলোকে একটি বড় শ্রেণির কাছে সোনার হরিণ করে তোলে। তাহলে এমন একটি কাঠামো ভেঙে পড়ার শঙ্কায় মানুষ কেন উতলা হবে?

কিন্তু মানুষ উতলা হবে এবং হচ্ছে। কারণ, নতুন ও অচেনার ভয়; অনিশ্চয়তা। চেনা গণ্ডির বাইরে যাওয়ার ভয়। যদিও এই চেনা গণ্ডি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। এই কাঠামোর চ্যাম্পিয়ন যুক্তরাষ্ট্র ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ হারিয়েছে সমন্বয়হীনতার কারণে। অথচ এই কয়েক দিন আগেও দেশটির ইস্তফা দেওয়া প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স, এলিজাবেথ ওয়ারেনরা বারবার করে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে বলে গেছেন। অথচ এই যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় বসেই প্রথম যে পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন, তা হলো—‘ওবামাকেয়ার’ বাতিল। এমনকি এই দুর্যোগেও ট্রাম্প প্রশাসন এই মুহূর্তে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখা আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়ন বাতিল করেছেন। এও তো এই কাঠামোরই ফল।

বিদ্যমান কাঠামোর আরেকটি বড় দুর্বলতা এই সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। তা হলো, জরুরি সরঞ্জামের সরবরাহ সংকট। কয়েক দশক ধরে গলা ফুলিয়ে যে বিশ্বায়নের কথা বলা হয়েছে, তা এই মুহূর্তে হঠাৎ করেই অকেজো হয়ে পড়েছে। বিশ্বায়িত পৃথিবীর বাসিন্দা দেশগুলো দ্রুত সীমানাদেয়াল তুলে দিয়েছে। নিজেদের মতো জরুরি সরঞ্জাম মজুত করেছে। ফলে বিশ্বের কারখানা-দেশগুলো কাঁচামালের অভাবে ভুগছে। কারণ, কাঁচামালের জোগানদাতা দেশগুলো দরজায় খিল এঁটেছে। ফলে কর্মী থাকলেও, উৎপাদন উপায় থাকলেও কাঁচামালের অভাবে এমনকি জরুরি সরঞ্জামও তৈরি করা যাচ্ছে না। আবার উৎপাদন উপায় না থাকায় বিপুল কাঁচামাল নিয়ে বেকার বসে থাকতে হচ্ছে জোগানদাতা দেশগুলোকে। সব অসহায়, সহায়ের খোঁজে বেহুঁশ। অথচ বিশ্বায়ন যদি ফাঁপা না হতো, তবে এই সময়েই সবচেয়ে বড় যূথবদ্ধতা দেখত পৃথিবী।

এই ফাঁপা বিশ্বায়নে এক বড় বদল আসতে পারে সামনের দিনগুলোয়। ঠিক কেমন হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক উৎপাদন বৃদ্ধি ও নিজস্ব সরবরাহব্যবস্থা তৈরি একটি উপায় হিসেবে দেখা দিতে পারে। আগে ঠিক যেমনটা ছিল এই ভারতবর্ষের গ্রামগুলো। ভারতবর্ষে গ্রাম বলতে সেই কাঠামোকেই বোঝাত, যা নিজের উৎপাদন দিয়ে নিজে চলার ক্ষমতা রাখে। আবার পাশের গ্রামে আকাল এলে তার পাশেও দাঁড়াতে পারে। বর্তমান সংকট অতীতের সেই কাঠামোয় ফেরার প্রণোদনা হিসেবে কাজ করতে পারে। অবশ্যই তা অতীতের মতো হবে না। এটি হতে হবে উন্নত ও প্রাযুক্তিক সব সুবিধা নিয়েই। অর্থাৎ একটি সমন্বিত উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থা সামনে আসতে পারে, যেখানে গ্রাম বা এমন কোনো কিছু ক্ষুদ্রতম ইউনিট হিসেবে কাজ করতে পারে।

এই সংকট একইভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে সমাজের একজন মানুষকেও অরক্ষিত রেখে, ঝুঁকিতে রেখে, বাকিদের ঝুঁকিমুক্ত থাকা অসম্ভব। একই সঙ্গে এটি সমাজের প্রতিটি শ্রেণির পরস্পর নির্ভরশীলতার বিষয়টিও অনেক বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তুলেছে। ফলে নতুন একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এই শ্রেণি অবস্থানগুলো পুনর্মূল্যায়িত হতে বাধ্য, যেখানে সবার নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচ্য হবে। সে ক্ষেত্রে সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো বিষয়গুলো অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে। গবেষণা ক্ষেত্রে বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা যেমন সীমানা প্রশ্নটি মুছে দিয়েছেন, তা সামনের দিনে আরও বেগবান হবে নিশ্চিতভাবেই। এটি নিঃসন্দেহে নতুন আলোর দিশা দেবে।

বর্তমান সংকট বিশ্বায়নের মাহাত্ম্য প্রচার করা দেশগুলোর মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, একটি দেশের অন্য দেশের ওপর ঠিক কতটা নির্ভর করা উচিত? ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন এই বিরাট প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে। এই সংকট মৌখিক ঐক্যের প্রকৃত রূপটি প্রকাশ করেছে। ফলে শুধু এই অঞ্চল নয়, প্রতিটি অঞ্চলের দেশগুলোই এমন বিষয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হবে। করোনা-পরবর্তী বিশ্বকাঠামোয় সবচেয়ে বড় আঘাতটি নিঃসন্দেহে পড়বে বিশ্বায়নের ওপর। এই আঘাত পুরো ধারণাটিকেই ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পারে—এটা হলো আশঙ্কা। আর আশা হচ্ছে, এই সংকটের পর বিশ্ব সত্যিকারের এক বিশ্বায়নের যুগে প্রবেশ করবে। শঙ্কা হলো, বর্তমান উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। আশা হলো, এর স্থান এমন এক কাঠামো নিতে পারে, যা সব মানুষকে ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে নিয়ে আসবে, উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থাকে দাঁড় করাবে প্রয়োজনের ভিতের ওপর। আর সবচেয়ে বড় আশার কথা হলো, পৃথিবী সুস্থ হয়ে উঠছে। এই সংকট পরবর্তী বিশ্বের মানুষেরা এই পৃথিবীকে হয়তো বুঝতে শিখবে এবং নিজেকে প্রকৃতির এক ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে মেনে নেওয়ার বুদ্ধিমত্তা দেখাবে। করোনা-পরবর্তী বিশ্ব কেমন হবে, তা নির্ধারণের ভার এখনো মানুষের ওপরই আছে—এর চেয়ে বড় আশা আর কী হতে পারে।

ফজলুল কবির: সাংবাদিক
[email protected]