করোনাকালে নতুন অর্থনৈতিক নীতিকাঠামোর খোঁজে

>

সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা মূলত দুটি নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হয়। রাজস্ব নীতি বা ফিস্ক্যাল পলিসি এবং মুদ্রানীতি বা মানেটারি পলিসি। প্রথম পর্বে নতুন সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার মৌল নীতি নিয়ে আলোচনা হলো।  দ্বিতীয় পর্বে থাকবে মুদ্রানীতি। আর শেষ পর্বে রাজস্বনীতি।

করোনাভাইরাস মহামারি নতুন ধরনের অর্থনৈতিক চিন্তার জরুরত জানাচ্ছে। এবারের মন্দা অন্য মন্দার থেকে ভিন্ন। সাধারণত চাহিদা ও জোগানে ব্যাপক ধসের ফলে মন্দা হয়। লকডাউনের ফলে বিশ্ব আজ এ মন্দায় নিপতিত হয়েছে। সরকারের দ্বারা অর্থনৈতিক কার্যাবলি বন্ধের কোনো নজির ইতিহাসে নেই। বিচক্ষণতার সঙ্গে সরকারকেই এ বিপর্যয় মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিতে হবে। আগের প্রতিটি মন্দাই রাষ্ট্রীয় নীতি-কৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। সুতরাং প্রচলিত সমাধান কাজে আসবে না।

সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা মূলত দুটি নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হয়। রাজস্ব নীতি বা ফিস্ক্যাল পলিসি এবং মুদ্রানীতি বা মানেটারি পলিসি। আমরা তিন পর্বে করোনাকালের নতুন সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলব। প্রথম পর্বে নতুন সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার মৌল নীতি নিয়ে আলোচনা হবে। দ্বিতীয় পর্বে থাকবে মুদ্রানীতি। আর শেষ পর্বে রাজস্বনীতি।

‘ভি’ নাকি ‘আই’?
করোনাভাইরাসের সমাপ্তি কখন এবং কীভাবে হবে, তা অনিশ্চিত। অর্থনৈতিক কার্যাবলি পুনরায় সচল হওয়ার দিনক্ষণও নিশ্চিত করে বলা যচ্ছে না। সবকিছু বারবার বন্ধ করতে হবে কি না—তাও বলা অনিশ্চিত। ইংরেজি অক্ষরের চারটি অবয়বনির্ভর দৃশ্যকল্পের কোনটি বাস্তব হবে? ‘ভি’ অর্থাৎ ছয় মাস পর অর্থনীতি ফিরে দাঁড়াবে, ‘ইউ’র মতো, বেশ কিছুদিন পর ঘুরে দাঁড়াবে, না ‘এল’-এর মতো—অনেক দিন লাগবে অথবা ‘আই’-এর মতো—নিম্নগামী হতেই থাকবে।

তারল্য কি সমাধান দেবে?
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তারল্য বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। অনেক দেশ মানুষের হাতে নগদ অর্থ পৌঁছে দিচ্ছে। বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বৃদ্ধির কারণে পণ্য ব্যবহারে যে ব্যাপক কমতি দেখা যাবে, তা শুধু তারল্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব হবে, এমনটা আশা করা যায় না। বেকারত্বের কারণে হ্রাসকৃত পণ্যচাহিদা সমগ্র অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে ক্রমহ্রাসমান পণ্য উৎপাদনের ফলে পণ্য জোগানে ঘাটতি দেখা যাবে। বেকারত্বের হার আরও বাড়বে, আয় কমে যাবে এবং পরিশেষে ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়ে অর্থনীতিতে মন্দা সৃষ্টি হবে। সমগ্র অর্থনীতি একটি ভয়ংকর আবর্ত চক্রের মধ্যে ঘুরবে।

অতীতের মন্দার মডেল অকার্যকর
আগের প্রতিটি মন্দাই রাষ্ট্রীয় নীতি-কৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। ‘মহামন্দা’ শব্দবন্ধটি অস্ট্রীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদদের দেওয়া। ১৯৩০-এর মহামন্দাকালে নীতিনির্ধারণে তাঁরাই প্রভাবশালী ছিলেন। তাঁরা ‘সে’র বিধি তথা পণ্যের উৎপাদন তার চাহিদা সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘ মেয়াদে বাজারে পণ্যের জোগান ও পণ্যের চাহিদা সমান হয়ে ভারসাম্যাবস্থা সৃষ্টির তত্ত্বের সমর্থক ছিলেন। এ তত্ত্বগুলো অনুসরণ করে তাঁরা বিনিয়োগ এবং ব্যবসার দুরবস্থা দূর করতে কোনো জোরাল ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যর্থ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া হয়ে আপনা-আপনি গুটিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থার পতন তাঁরা রোধ করতে পারেননি। একে চ্যালেঞ্জ করে কেইন্স ও তাঁর অনুসারীরা জোরাল রাজস্বনীতির মাধ্যমে ক্রমহ্রাসমান ভোক্তা কর্তৃক ব্যয় রোধ করে সামষ্টিক চাহিদা বাড়ানোর নীতিকাঠামো তুলে ধরলেন। কয়েক দশক পরে মানেটারিস্ট অর্থনীতিবিদেরা পাল্টা-বিপ্লব করে বসলেন। তাঁদের ভাষ্যে, অর্থ সরবরাহ সংকুচিত হলেই মন্দা সৃষ্টি হয়; মোট দেশজ উৎপাদন সামষ্টিক মুদ্রা সরবরাহের সমান। কয়েক দশক ধরে মুদ্রাস্ফীতিকে লক্ষ্যবিন্দুতে রেখে মুদ্রানীতির মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনীতি-কৌশল পরিচালিত হতে থাকল। বাজেট-ঘাটতিকে লাগাম টেনে ধরা ছাড়া রাজস্বনীতির ভূমিকা অগ্রাহ্য হলো। ২০০৮-এর আর্থিক মন্দাকালীন এক ‘নতুন ঐকমত্য’ নীতিকাঠামো কেন্দ্রে চলে আসে। বণ্ডের বিপরীতে প্রচুর তারল্যের জোগান দেওয়া হয় ও কৃচ্ছ্র রাজস্বনীতি গ্রহণ করা হয়। এতে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সুবিধা পেলেও কর্মসংস্থান তেমন বাড়েনি ও আর্থিক খাতের সহজাত ঝুঁকি রয়েই গেছে।

বাংলাদেশ আগেই দুর্বল হচ্ছিল
করোনার প্রাদুর্ভাবের আগেই বাংলাদেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে ছিল। কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে জিডিপিতে বেসরকারি বিনিয়োগের অনুপাত একই রয়েছে। পুঁজি পাচার বেড়েছে। পুঁজিবাজারে মাঝেমধ্যেই ধস নামছে। প্রকৃত মজুরিবৃদ্ধি কমেছে। কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্যও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। সরকারের আয় ক্রমেই কমে যাওয়ায় বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিশাল ঋণ নিতে হয়েছে। ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ায় ব্যয় বেড়েছে। রপ্তানি, আমদানি ও অভিবাসী আয়ের হ্রাস চিন্তাদায়ক। বাজেট বরাদ্দ কম থাকায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত সঙিন। সামাজিক নিরাপত্তাজাল অপর্যাপ্ত।

নতুন কাঠামোর মূলনীতি
এ পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়সংগত একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করাই নীতিকাঠামোর মৌল ভিত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের তিন স্তম্ভ—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার এ নীতিকাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে। এ রাষ্ট্রকে নাগরিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ছয়টি মৌলনীতি নিয়ে আলোচনা করব।

ব্যবহারিক মূল্যবৃদ্ধিতে বিনিয়োগ
কোভিড-১৯ রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিক পরিসেবাসমূহ তথা স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের ব্যর্থতাগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। বাজেটীয় ঘাটতি লাগাম টানার তথাকথিত নীতির কারণে ব্যবহারিক মূল্য বৃদ্ধিকারী জনসেবা খাতগুলো অবহেলিত হয়েছে এবং বরাদ্দ কমেছে। পুঁজি বা বিনিময় মূল্যবৃদ্ধিকারী খাত অগ্রাধিকার পেয়েছে। ‘বাজারই মূল চালিকা শক্তি’ এবং ‘সমাজ ও বাজার সমার্থক’ ধারণা প্রাধান্য থাকায় রাষ্ট্র সর্বজনকে গণদ্রব্য বা পাবলিক গুডস অথবা সামাজিক নিরাপত্তা-সুবিধা প্রদানের বাধ্যবাধকতা থেকে বিযুক্ত থেকেছে।

প্রকৃতপক্ষে বাজার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নিয়মাধীন। রাষ্ট্র কর্তৃক জনদ্রব্য প্রদান নাগরিকের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে। সক্ষমতাসম্পন্ন নাগরিকই অর্থনৈতিক কাঠামো, রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এবং সামাজিক সংগঠন পরিবর্তনে ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখতে পারে।

সর্বজনের জন্য শোভন জীবনমান
সারা বিশ্ব ‘কাউকে বাদ রেখে নয়’ উপজীব্য ধারণ করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। কোভিড-১৯ যে নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে, তা নিরসনকল্পে প্রয়োজন পূর্ণ জীবন চক্র ভিত্তিক শিশু, মাতা, যুবক থেকে বয়স্ক পরিব্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম। আয়সহায়তা, স্বাস্থ্যভাতা, শিশু প্রতিপালন ভাতা, আবাসন সহায়তা, প্রতিবন্ধী ভাতা, অবসর ভাতা, বেকারত্ব ভাতা ইত্যাদি এ কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করতে হবে। এ ভাতাগুলো প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

গুণকপ্রভাব বা ‘মাল্টিপ্লায়ার ইফেকটস’ সৃষ্টিকারী বরাদ্দ
রাষ্ট্রের অর্থ জনগণেরই অর্থ। জনগণের অর্থ কেবল গুণকপ্রভাব তৈরিকারী খাতগুলোয় বরাদ্দ করতে হবে। জনগণের অর্থ যাতে মুষ্টিমেয়র হাতে না যায়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যেমন, বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন না করলেও ক্যাপাসিটি চার্জবাবদ ব্যাপক অঙ্কের ভর্তুকি দেওয়া অথবা রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশকে অযৌক্তিক সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। প্রণোদনা কেবল প্রকৃত খাতগুলোকে প্রদান করা প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান জরুরি; কিন্তু কর্মসংস্থানই মূল নিয়ামক।

লক্ষ্য বা মিশনভিত্তিক কর্মসূচি
লক্ষ্যভিত্তিক নীতিমালা নানা গুণকপ্রভাব তৈরির সঙ্গে সঙ্গে প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। উদাহরণস্বরূপ, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সামনে রেখে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার উৎপাদনক্ষমতা এবং দক্ষতাকে বাড়িয়ে তুলবে। ফলে সামষ্টিক চাহিদা, ভোগ, বিনিয়োগ এবং রপ্তানিকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলবে।

দেশব্যপী গ্রামীণ অর্থনীতি উজ্জীবনী সমন্বিত শিল্পায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া যেতে পারে। এ কর্মসূচির আওতায় দেশের প্রধান মহাসড়কের পাশে শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে। এতে অল্প ব্যয়ে ও সহজে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে শিল্পায়ন গুটি কতক নগরে সীমাবদ্ধ থাকবে না। দেশব্যাপী সুষম বিস্তৃত হবে। প্রতিটি অঞ্চলে ‘বিকাশ কেন্দ্র’ বা গ্রোথ সেন্টার ও এলাকাভিত্তিক বিশেষ ধরনের শিল্পও গড়ে উঠবে। এ ছাড়া পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ, কাঁচামাল সংগ্রহ ও জোগান সহজতর হবে। শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবনযাত্রায় যুগান্তকারী প্রভাব পড়বে।

রূপান্তরকারী উৎপাদনব্যবস্থা
বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের ও পরবর্তী সময়ে উন্নত দেশে পরিণত হতে আকাঙ্ক্ষী। উন্নয়নের পরবর্তী সোপানে যেতে রূপান্তরকারী উৎপাদনব্যবস্থার প্রয়োজন। যেমন, পরিবেশবান্ধব নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ এবং প্রকৃতি উভয়ের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীববৈচিত্র্যর অবক্ষয় দূর করা সম্ভব।

সক্রিয় নাগরিকতা
নাগরিক সক্রিয়তা জনসম্পদের ব্যবহারে রাষ্ট্রের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা করতে পারে। জবাবদিহির মাধ্যমেই জাতীয় অর্থব্যবস্থা জনগণের হয়ে ওঠে। যেমন, বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়ন একচেটিয়াভাবে নির্বাহী বিভাগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নাগরিক কর্তৃক রাষ্ট্রীয় আয় ও ব্যয়ের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, রোধন ও সমন্বয়নের সুযোগ না থাকায় ক্রমেই সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যিক হয়ে পড়ছে।

আগামীকাল দেখুন দ্বিতীয় পর্বের প্রসঙ্গ মুদ্রানীতি
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারপারসন, উন্নয়ন অন্বেষণ
[email protected]