দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ

এক জটিল উভয়সংকটের আকারে দিন দিন বেড়ে চলেছে করোনা মহামারির প্রকোপ। সংকটের একদিকে ভাইরাস সংক্রমণ বিস্তারের ঝুঁকি, অন্যদিকে সেই ঝুঁকি এড়ানোর লক্ষ্যে পুরো জাতির অবরুদ্ধ দশার অনিবার্য ফল হিসেবে উদ্ভূত জনদুর্ভোগ। প্রতিদিন আরও বেশি সংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হচ্ছেন। এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিদিন। ফলে সংক্রমণের বিস্তার রোধ ও আক্রান্ত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ বাড়ছে প্রতিদিন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দৃশ্যমান তৎপরতার কার্যকারিতা ও ফলপ্রসূতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, তেমনই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে অবরুদ্ধ দশায় আয়রোজগার হারানো বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারণের নিশ্চয়তা নিয়ে।

স্বাস্থ্যগত দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, করোনা রোগীদের শনাক্ত করার জন্য পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যাও বেড়েছে। করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য পৃথক হাসপাতালের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব ব্যবস্থা কতটা কার্যকরভাবে পরিচালিত হচ্ছে, কী করা হচ্ছে, কী করা উচিত কিন্তু করা হচ্ছে না, আরও কী কী করা উচিত—এসব বিষয়ে আলোচনা ও খবরাখবর মোটামুটি পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এই মহামারির কারণে যে বিপুলসংখ্যক কর্মহীন, আয়হীন, অবরুদ্ধ মানুষের দৈনন্দিন জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে, তাঁদের সম্পর্কে বিশদ খবর পাওয়া যাচ্ছে না। যে সামান্য খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে নেতিবাচক ও হতাশাব্যঞ্জক ঘটনার খবরই বেশি। যেমন দরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দ ত্রাণসামগ্রী চুরির হিড়িক লেগেছে। পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী আছে বলে সরকারি প্রশাসনের আশ্বাস সত্ত্বেও নিরন্ন মানুষ, ক্ষুধার্ত মানুষ ত্রাণসাহায্যের দাবিতে সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ, মানববন্ধন করছেন। কারণ, তাঁরা ও তাঁদের সন্তানেরা অনাহার–অর্ধাহারে কষ্ট পাচ্ছে।

রোগ ছড়ানো ঠেকাতে হবে, রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে—এসব কথা বলার পাশাপাশি আমরা বরাবর বলে আসছি যে দরিদ্র, বিপন্ন মানুষের পাশে সত্যিকার অর্থে দাঁড়াতে হবে। তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ করতে হবে। এ পর্যন্ত যা বরাদ্দ করা হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। বরাদ্দ আরও অনেক বাড়াতে হবে। কিন্তু শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই সব বিপন্ন মানুষের দুর্দশা দূর হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ, দেখা যাচ্ছে ত্রাণ সাহায্য বিতরণে স্বচ্ছতা, নজরদারি, জবাবদিহির ঘাটতি আছে। সে কারণেই চুরির হিড়িক পড়েছে। ত্রাণচোরদের বিরুদ্ধে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ সত্ত্বেও ত্রাণ চুরি বন্ধ হচ্ছে না। প্রতিদিন আত্মসাৎকৃত ত্রাণসামগ্রী উদ্ধারের খবর পাওয়া যাচ্ছে। আত্মসাৎকারীদের গ্রেপ্তারের খবরও আসছে। এই চোরদের প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মী।

ত্রাণসামগ্রী বিতরণের আরও একটি বড় সমস্যা হলো এই কাজ করা উচিত সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়িয়ে। কিন্তু তা হচ্ছে না। ত্রাণপ্রার্থী মানুষকে ঘরের বাইরে এসে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে, ভিড়ের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বিরাট। এই ভিড় এড়ানোর ব্যবস্থা অবশ্যই করা দরকার। এ জন্য সরকারি প্রশাসনকে তৎপর হতে হবে। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত গরিব মানুষের ঘরে ঘরে ত্রাণসাহায্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজে স্থানীয় সরকারকাঠামোকে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু সেটা করতে হবে সততার সঙ্গে কঠোর নজরদারির মাধ্যমে। কারণ, স্থানীয় সরকারের তৃণমূল পর্যায়ে ত্রাণসামগ্রী চুরির প্রবণতা এ দেশে মজ্জাগত ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।