সংক্রমণ রোধে অগ্রাধিকার

সরকার ১৬ এপ্রিল সমগ্র বাংলাদেশকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করে। ২০ এপ্রিল জাতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর বেরোল, ‘সংক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে’। অর্থাৎ, সরকার যে সময় ঝুঁকিটা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে, তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ ওয়াকিবহাল মহল অনেক আগে থেকেই সংক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করে আসছিলেন। 

যাহোক, সংক্রমণ যখন সারা দেশে ছড়িয়েই পড়েছে, তখন করণীয় কী? প্রথমত দেখতে হবে কী প্রক্রিয়ায় এটা ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নতুন নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার খবর আসছে, আমরা জানতে পারছি, সংক্রমিত ব্যক্তিরা অন্যান্য এলাকা থেকে কিছুদিন আগে বাড়ি ফিরেছেন। প্রথম দিকে সংক্রমণ ছড়িয়েছে করোনা-আক্রান্ত দেশগুলো থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের মাধ্যমে। এখন দেশের বিভিন্ন জেলায় যে ব্যক্তির দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে, তাঁরা সম্প্রতি দেশের ভেতরেরই এমন সব এলাকা থেকে সদ্য বাড়ি ফিরেছেন, যেসব এলাকায় অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ ইতিমধ্যে সংক্রমিত হয়েছেন। 

রাজধানী ঢাকার ১৪৩টি স্থানে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পুরান ঢাকার কিছু অংশে সংক্রমণের হার বেশি। ঢাকার আশপাশে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীতে সংক্রমণের মাত্রা উদ্বেগজনক স্তরে পৌঁছেছে। সাধারণ ছুটি ঘোষণা ও লোকজনকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়ার পর এসব এলাকা থেকে অনেক মানুষ দেশে বিভিন্ন জেলায় নিজ নিজ বাড়িতে গেছেন। তাঁদের মধ্যে এবং তাঁদের সংস্পর্শে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যেই এখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে বেশি মাত্রায়।

অর্থাৎ প্রথম করণীয় কাজ হলো সর্বাধিক মাত্রায় সংক্রমিত এলাকাগুলোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া, সেগুলোকে কার্যকর অর্থে লকডাউন বা অবরুদ্ধ করা এবং আক্রান্তদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা। ওই সব এলাকা থেকে কোনো মানুষ বাইরে যাবে না, বাইরে থেকে কেউ ওই সব এলাকায় প্রবেশ করবে না—এটা নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। কারণ, বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা ছাড়া সংক্রমণের আরও বিস্তার রোধ করার কোনো বিকল্প নেই। 

চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে করোনাভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে চীন সরকার পুরো প্রদেশকে সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ করার সুফল পেয়েছে। করোনাভাইরাস হুবেই প্রদেশের বাইরে চীনের আর কোনো অঞ্চলে ছড়াতে পারেনি। আমরাও যদি অবিলম্বে সর্বাধিক আক্রান্ত এলাকা ও স্থানগুলো শনাক্ত করে সেগুলোতে কঠোর অবরুদ্ধ দশা কার্যকর করতে পারি, তাহলে সংক্রমণ ওই সব স্থান ও এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এখনো সম্ভব। 

এই কাজ করতে হবে সুসংগঠিতভাবে। কোনো শহর, গ্রাম, পাড়া, মহল্লার একটি বা দুটি বাড়িতে সংক্রমণ শনাক্ত হলে সেই বাড়িগুলোকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করতে হবে, যেন সংক্রমণ অন্যত্র ছড়াতে না পারে। কিন্তু অবরুদ্ধ দশায় বাড়ির বাসিন্দারা যেন জীবনধারণের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৩২টিই ইতিমধ্যে অবরুদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। এর অর্থ এই জেলাগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে। বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করতে হবে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় মানুষের চলাচল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে। এমনকি ইঞ্জিনচালিত নয়, এমন ছোট যানবাহনের চলাচলও বন্ধ করা দরকার।

এসব দায়িত্ব পালনের জন্য আন্তরিক লোকবল প্রয়োজন। সরকারি প্রশাসনের পাশাপাশি সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদেরও তৎপর হওয়া প্রয়োজন।