চিলমারির বন্দরে কিছু অভাবী মানুষ

পয়লা বৈশাখের বিকেল। চিলমারী নদীবন্দর। সুনশান ঘাট। ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছেন দু-একজন কুলি ও মাঝি। রমনা পানাতিপাড়ার পক্ষাঘাতগ্রস্ত কুলি আবুল কাশেম বন্দরের সাইনবোর্ডের পাশে, রাবার বটের ছায়ায় বসে আছেন। চঞ্চল চোখে ইতিউতি তাকাচ্ছেন। কারও যদি একটু দয়া হয়।

কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করতেই আরেকজন কুলি মিন্টু মিয়ার সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখেই দাঁড়ালেন। একসময় নিজের নৌকা ছিল। এখন কুলি।

: কেমন আছেন?
তিনি এক কাঁধের গামছা আরেক কাঁধে রেখে উদাসী ভঙ্গিতে বললেন, ‘কেমন আর থাকি! আগে কাম করি উকেশ (বিশ্রাম) পাই নাই। এহন তো দেইখপেরে নাইগচেন।’

: সরকার থাকি রিলিফ পান নাই? মেম্বর-চেয়ারম্যান কিছু দেয় নাই? সরকার তো গরিব মানুষের নাম তালিকা করতেছে।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘মিছে কথা না কই। রমনা ইউনিয়নের আজগর চেয়ারম্যান নাম চাছিল (চেয়েছিল), হামরা নামও দিছিলেম। হামার কুলি ৩০ জনের নাম দেখি কয়, মাল কম, ১০ জনার নাম দেও। পরে গতকাল ওই ১০ জনাক চাউল দিছে। তাহে (সেটুকুই) ভাগ করি নিছি সবাই।’

এ রকম কথা বলতেই মাঝি ধলু মিয়া পাশে এসে দাঁড়ান। তাঁকে এবার জিজ্ঞাসা করি, কেমন আছেন ভাই?

‘তোমরা বোজেন না, কেমন আছি?’ ধলু মিয়া বলেন। হামরা টোট্যাল ৬০ জন। লিপু মাস্টার (নৌযাত্রীদের টিকিট দেন যিনি) পরশুদিন ইউএনওক ফোন দিছে। ইউএনও কয়, চেয়ারম্যানক যায়া তালিকা দেও। তাই (উনি) বলে দেইখপে। হামরা যে না খায়া মরি, সেটা এলা কেডা দেখে?’

: তোমরা এলা কী কইরবেন?
: কী আর কইরমো! করোনা শ্যাষ হইলে হামরা আর নাও চালবার নাই। তখন তো আর ডিসি আসি কিছু কবার পাওয়ার নয়।

প্রথম আলোয় কলাম প্রকাশের পর, বাঁধের রাস্তা থেকে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলো চাল পেয়েছে ১০ কেজি করে। কিন্তু এরপর?

মমিনুল ইসলাম। রমনা রেলস্টেশনে বাড়ি। জেএস গাড়ির নিজেই মালিক, নিজেই শ্রমিক, বহন বন্ধ হওয়ার পর থেকে বসা। কেমন আছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘ভাই, যা জমা ছিল, সব শেষ। আত্মীয়স্বজনের কাছে ধার নিয়ে চলছি। ধারের ওপর আর কত দিন?’ একই অবস্থা সব জেএস গাড়িওলাদেরই। হাটবাজারের রেস্তোরাঁগুলোরও। তারা সামর্থ্যবান বলে শরমে ত্রাণ চাইতে পারেন না।

এদিকে চিলমারী ও উলিপুরে চাল উদ্ধার করেছে পুলিশ। যথারীতি গ্রেপ্তার দোকানের মালিক। আর ভিজিএফ কার্ডধারীরাই নাকি দোকানদারের কাছে চাল বিক্রি করেছে।

২.
‘মানুষের মতো মানুষ’সহ নানান বিদেশি কাহিনি পড়ে বড় হওয়ার দুর্ভাগ্য আমাদের হয়েছিল। পড়েছিলাম, তাঁরা কীভাবে দেশের দুর্দিনে জনগণের পাশে দাঁড়ান। এই করোনার দিনে আমাদের ডাক্তার আর পুলিশেরা অজস্র উদাহরণ তৈরি করে যাচ্ছেন। চেনাজানা ডাক্তার ও পুলিশেরাই সেই মানুষের মতো মানুষ।

কিছু লোক প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের আড়াল করতে প্রথমে ডাক্তারসহ অন্য পেশাজীবীদের দায়ী করল। পরে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে দায়ী করছে। যারা হাঁচি-সর্দির জন্যও সিঙ্গাপুর যান, তাঁরা কখনো ভাবেননি, এই দেশে তাঁদের চিকিৎসা নিতে হবে।

সবাই যখন জানে মেডিকেলে ফোন দিলে আসার মতো অ্যাম্বুলেন্স নেই, শ্বাস নেওয়ার ভেন্টিলেটর নেই, করোনায় মৃত্যুর আশঙ্কা ৫০ শতাংশ এবং আরও অনেকের ছড়ানোর ভয় আছে, তখন যেখানে-সেখানে লাশ খুঁজে পাওয়া যাবেই। এর মধ্যেও মানবিকতার সহস্র উদাহরণ তৈরি হচ্ছে। মানুষ দাঁড়াচ্ছে মানুষের পাশে।

নেতারা নয়, কুড়িগ্রাম ও রংপুরের পুলিশ সুপার তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে জনসচেতনতায় নামিয়েছেন। দুই শতাধিক তরুণকে তাঁরা ট্রেনিং দিয়েছেন। ত্রাণ ফান্ড খুলেছেন—মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে পড়ে।

লেখক: রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি।
[email protected]