বর্তমানের সংকট, ভবিষ্যতের আশা

মানবজাতি এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি যথাসম্ভব কম রাখার জন্য পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হচ্ছে, একাকিত্ব বরণ করতে হচ্ছে। কারফিউ, লকডাউন ইত্যাদি শব্দের উচ্চারণ দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। এভাবে জীবনযাপন কঠিন। এই অবরুদ্ধ দশায় মন আশার কথা শুনতে চায়। একটা আশার কথা শোনা গিয়েছিল গণ স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে, তারা করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষার কিট তৈরি করেছে। এটা বিদেশ থেকে আমদানি করতে বেশি খরচ পড়ত, এখন দেশেই পাওয়া যাবে কম খরচে। তারপর দেশে যখন কৃত্রিম শ্বাস–প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণযন্ত্রের প্রকট অভাবের খবর প্রচারিত হচ্ছে, তখন খবর এল কিছু তরুণ তেমন যন্ত্র তৈরি করেছেন। যন্ত্রটি বিদেশ থেকে কিনে আনতে অনেক টাকা ব্যয় হয়, এখন এটি অনেক কম খরচে দেশেই তৈরি হবে। আমাদের কিছু তৈরি পোশাক কারখানায় এখন পিপিই তৈরি করা হচ্ছে—এটিও একটি আশাব্যঞ্জক বিষয়। শুধু মূল্যের দিক থেকে নয়, এই সংকটে দেশেই এসব পাওয়া বড় ব্যাপার। দেশে তৈরি কোনো কিছুই সমাদৃত হয় না। আজকে যে শিল্পটি আমাদের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা দিচ্ছে, সেই শিল্পের প্রথম দিকের উদ্যোক্তাদের বিরাট লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল। এ দেশে সব খাতের উদ্যোক্তাদের সামনে বড় বাধা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, লালফিতার দৌরাত্ম্য।

দেশি উদ্যোক্তারা এই সংকটে কয়েকটি অতিপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম তৈরিতে এগিয়ে এসেছেন। আমলাতন্ত্রের তরফ থেকে এসবকে নিরুৎসাহিত করা হবে বা হচ্ছে কি না, বোঝা যাচ্ছে না। সাধারণত সরকারি ক্রয় ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন বেশি মূল্যে ও বিদেশ থেকে জিনিস কেনার পক্ষে। কারণ, এসব ক্রয়ে বিপুল অর্থের কমিশনের ভাগ–বাঁটোয়ারা হয়। বিদেশি পণ্য আমাদের বাজারে চালু করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু যেসব বিদেশি পণ্য আমরা ব্যবহার করি, তার একটা বড় অংশ খুব সহজেই এখানে তৈরি করা সম্ভব। প্রয়োজন দেশি উদ্যোক্তাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে মুক্তি দেওয়া, উৎসাহিত করা। প্রয়োজনে নতুন আইনকানুন প্রণয়ন করা। সমস্যা হচ্ছে কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানো। পৌঁছানোর দুটো উপায়ের মধ্যে একটি হলো গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা, অন্যটি আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে। গণপ্রতিনিধিরা এত ব্যস্ত যে তাঁদের এসব নিয়ে ভাবার ও কার্যকর করার সময় নেই। নিজেদের ব্যবসা আর তদবিরেই তাঁদের দিন কেটে যায়। এত বড় সংকটে গণপ্রতিনিধিদের তেমন কোনো সাড়াশব্দ নেই। ত্রাণের ব্যাপারেও তাঁদের উৎসাহ নেই। তাই বাধ্য হয়ে সরকারকে আমলাতন্ত্রকেই ব্যবহার করতে হচ্ছে। স্থানীয় সরকারকে কাজে লাগানো হয়েছে। সেখানেও দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু জায়গায় ত্রাণ চুরি হয়ে যাচ্ছে।

মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রে নানা উদ্ভাবনের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। গ্রামের কৃষক, তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষ অনেক কিছু নিজস্ব অভিজ্ঞতায় ও জ্ঞানে আবিষ্কার করে ফেলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তার আর খবর পাওয়া যায় না। তাই উদ্যোক্তারা হতাশ হন এবং ভেবে নেন যে এসব করে কোনো লাভ নেই। অতীতে পৃথিবীতে অন্য ধরনের সংকট এসেছে। মহামারি, বিশ্বযুদ্ধ এসবেও পৃথিবীর অনেক ক্ষতি হয়েছে। আবার সে সংকট কাটিয়ে মানুষ গা ঝাড়া দিয়ে নতুন উদ্ভাবন দিয়ে নতুন পৃথিবী তৈরি করেছেন। প্লেগের সময় মানবজাতি এক মহাসংকটে পড়েছিল। কিন্তু তারপর শিল্পবিপ্লব ঘটেছে। পাশাপাশি শিল্প–সাহিত্যও সমৃদ্ধ হয়েছে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত ও পরাজিত শক্তিগুলো দেশকে অগ্রগতির নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। জাপান হিরোশিমা–নাগাসাকিতে আঘাতের বিধ্বস্ত–পর্যুদস্ত হওয়ার পরও কীভাবে একটা আধুনিক ও শিল্পোন্নত দেশ হয়ে উঠল! জার্মানি এখন ইউরোপের সবচেয়ে শিল্পোন্নত আধুনিক রাষ্ট্র। করোনাভাইরাসের কালে আমাদের দেশেও ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সর্বত্র স্থবিরতা এসেছে। পারিবারিক, মানবিক বন্ধনগুলো যেন আলগা হয়ে গেছে। নৈতিক মান দিন দিন নিম্নমুখী। একদিকে অল্প কিছু মানুষ প্রচুর বিত্তের অধিকারী হয়েছে, অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক মানুষ বিত্তহীন হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। এখন ত্রাণের জন্য হাহাকার কোটি মানুষের।

এ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, তাই তো এত বিধিনিষেধ সত্ত্বেও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার দিকে তাদের মনোযোগ নেই। শিক্ষাব্যবস্থাটা নিয়েও ভাবা দরকার। যে শিক্ষাব্যবস্থা কোনো বাস্তব পরিস্থিতিতে কাজে লাগে না, তার কী প্রয়োজন! এখন সংকট চলছে, কিন্তু সংকট চলে গেলে আমরা নতুন একটা ব্যবস্থার যদি সূচনা করতে না পারি, তাহলে সবই বিফল হয়ে যাবে।

একটি ভাইরাসের কাছে আজ রাজা, প্রজা, আমির, ফকির সবাই সমানভাবে অসহায়। রাজন্যের দম্ভ, অর্থের দাপট, অস্ত্রের শক্তি কোনো কিছুই আজ কাজে লাগছে না। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র আজ সবচেয়ে বেশি অসহায়। আধুনিকতম মারণাস্ত্রগুলো আজ বোবা হয়ে বসে আছে। কাকে লক্ষ্যবস্তু করবে সে?

লকডাউনের দিনগুলো আমাদের কাজে লাগানো প্রয়োজন। কারণ, এই সংকট কেটে যাওয়ার পরে পৃথিবী ভবিষ্যতে আবারও অরক্ষিত হয়ে পড়তে পারে। প্রকৃতির ওপর আমরা এত নির্যাতন করেছি যে দুঃসময়ে আমাদের জন্য কতটুকু সহযোগিতার হাত বাড়াবে, তা–ও সন্দেহ। প্রথমেই বলেছিলাম, মানুষের উদ্ভাবনী ও সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। জাতি হিসেবে আমরা সৃজনশীল। মুক্তিযুদ্ধের সময় শত্রুকে ধ্বংস করার জন্য কত যে উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল পথ মুক্তিযোদ্ধাদের আবিষ্কার করতে দেখেছি, তা বলে শেষ করা যাবে না। বিদেশিরা ভাবত এই দেশ গানের দেশ, কবিতা ও ছবির দেশ। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীর সেনানীরা অন্য ধরনের সৃজনশীলতা ও শক্তিমত্তার স্বাক্ষর রেখেছেন।

একটি অন্য রকম উদাহরণ মনে পড়ছে। বাউল শাহ আবদুল করিম একদা বলেছিলেন, পৃথিবী একসময় বাউলের পৃথিবীই হবে। বলা বাহুল্য, তিনি বাউলের পৃথিবী বলতে প্রাকৃতিক পৃথিবী বুঝিয়েছিলেন। যুদ্ধ–বিগ্রহ–ধ্বংস–অস্ত্রের পৃথিবীর বদলে বাউলের গানের কথার মতোই ভালোবাসার পৃথিবী গড়ে উঠবে। আজ এই অবরুদ্ধ দিনে আমরা সাম্য আর শান্তির পৃথিবীটাকে নিয়ে একটু ভাবতে পারি না?

মামুনুর রশীদ নাট্যব্যক্তিত্ব