করোনার কালে দারিদ্র্য-সফর

অবসরে যাওয়া ছুটা গৃহকর্মী বৃদ্ধা রূপভান বিবির চোখের চাউনিটা বুকের মধ্যে ভাঙা কাচের টুকরার মতো বিঁধে আছে। কানে কম শোনা বুড়ো মুচি জহরলাল দাস আমার প্রত্যেকটা নির্লজ্জ প্রশ্নে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘অ্যাঁ?’ সেই ভঙ্গিটা ভোলা কঠিন।

টিমটিম করে টিকে থাকা রুজির জন্য ভ্যানের সবজিবিক্রেতা প্রবীণ মো. খলিল শিকদার আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। তাঁর চোখ-কোঁচকানো কুণ্ঠিত হাসিটা মনে লেগে আছে। রিকশাচালক মো. আবদুল মান্নানের মার্জিত বয়ানে মিশে ছিল আত্মসম্মানের বোধ।

১৬ এপ্রিল দুটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা দেশে দারিদ্র্যের ওপর কোভিড-১৯ রোগ তথা নতুন করোনাভাইরাসের প্রভাব নিয়ে একটি দ্রুত জরিপের ফল প্রকাশ করেছে । গবেষকেরা বলেছিলেন, এপ্রিলের শেষ নাগাদ বেশি গরিব, কম গরিব আর প্রায়-গরিব থেকে নতুন করে গরিব হওয়া মানুষদের খাদ্য সংকট তীব্র হবে।

আর ২০ এপ্রিল সকালে আমি বেরিয়েছিলাম কিছু দরকারি-অদরকারি খাদ্য ও ওষুধ কিনতে। তখনই রূপভানদের সঙ্গে কয়েক ফুট দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলি। দেশজুড়ে লকডাউন অর্থাৎ করোনাবন্ধের সেটা ২৬তম দিন।

ধানমন্ডি ৪ নম্বর সড়কে ছয়তলা ভবনের ভেতরের দিকের একটা ফ্ল্যাটে থাকি। বাসায় ‘ছুটা বুয়া’, ফেরিওয়ালাসহ বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ হয়ে গেছে। নিজে না বেরোলে গরিব মানুষদের চেহারা বিশেষ দেখতে হয় না।

চাইলেই এখন ঝুটঝামেলা ছাড়া অখণ্ড অবসর আমার হতে পারে। কিন্তু করোনার আগ্রাসন আর তার নানা রকম প্রভাবের খবর পিলপিল করে আসতে থাকে। সময়টা একটা ভারী বোঝার মতো, একটা নিরাশা আর অনিশ্চয়তার চাদরের মতো, মনের ওপর চেপে থাকে।

ঘরের বাইরেটা এখন কী যে সুন্দর! আকাশ নরম নীল। গাছে নতুন পাতারা সতেজ সবুজ। পথে পথে লাল, হলুদ, বেগুনি ফুলের বৈশাখী আগুন। দুই-চারদিন পর পর সদাইপাতি করতে বেরোই, সেটা হাঁফ ছাড়ার জন্যও বটে।

ওয়াসার সুয়ারেজ লাইনের কাজ চলছে। ছবি: লেখক
ওয়াসার সুয়ারেজ লাইনের কাজ চলছে। ছবি: লেখক

কিন্তু তখন রাস্তাঘাটে পেটের তাগিদে বাধ্য হয়ে বেরোনো মানুষদের দেখি। দোকানপাটের সামনে ছোট ছেলেমেয়ে, বাচ্চা কোলে মা আর বুড়োবুড়িরা অপেক্ষায় থাকে। রিকশাচালকেরা আমাকে অনেক সাহায্য করেন। মনটা খুব দমে যায়।

২০ এপ্রিল সকালে গেট থেকে বেরিয়েই চোখে পড়ে, রাস্তার পাশে সুয়ারেজের লাইন খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। গর্তের মধ্যে দাঁড়ানো বুড়ো মজুরটি আমাকে দেখে দ্রুত মুখঢাকা পরেন। তাঁর সহকর্মী নারী মাথার ঝুড়িটা নামিয়ে সামনে এসে দাঁড়ান।

প্রায় শোনা না যাওয়ার মতো গলায় তিনি বলেন, ‘যদি একটু সাহায্য-মাহায্য করতেন!’ জানলাম, মজুরি ৪০০ টাকা করে। যাওয়া-আসার খরচ বাদ দিয়ে দিনাদিন হাতে ৩৫০ টাকা করে পান। এখন তাঁর আয়ের ওপরেই পরিবার চলছে।

মোড়ে সবজির ভ্যানের পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন খলিল। তাঁর নীল-কালো কাপড়ের মুখঢাকার নিচে লম্বা সফেদ দাড়ি। কিছু সবজি কিনি।

খলিল থাকেন কেরানীগঞ্জে, বুড়িগঙ্গার ওপারে। আগে সেখানকার আটিবাজার থেকে সবজি আনতেন। এখন শুধু কারওয়ানবাজারে সুবিধামতো পসরা পাচ্ছেন।

তিনি বললেন, কেজিপ্রতি ১৫-২০ টাকা করে দাম বেড়েছে। বেচাবিক্রি একটু কমেছে। আধাদিনে তিন শ থেকে চার-পাঁচ শ টাকা আয় হচ্ছে। বাড়িতে ছয়জন সদস্য।

চোখে কুণ্ঠার হাসি নিয়ে খলিল বলেন, ‘এই টাকা দিয়া আল্লাহ্‌পাকে চালাইতেছে আরকি!’ বলেন, তাঁর তো তবু চলছে, মহল্লার বেশির ভাগ মানুষ খুব কষ্টে আছে। বিশেষ করে যাঁরা দিনমজুরি করেন, রিকশা চালান।

ব্যাটারিতে চলা একটা রিকশায় উঠে সাত মসজিদ রোডে গেলাম। রাস্তার পাশে দু-তিনটা মাত্র ফলের দোকান খোলা। মান্নানের রিকশা যান্ত্রিক গোঙানি করে বটে, কিন্তু চলে সাঁই সাঁই করে।

ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রাস্তায় মীনাবাজারের উর্দিপরা দ্বাররক্ষী কারও সদাইয়ের বাক্স নিয়ে বেরোলেন। মুখঢাকা পরা দুজন দরিদ্র নারী অলস পায়ে তাঁর পিছু নিলেন। খালি-পা ছোট ছেলেটা নিরাসক্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল।

মিরপুর রোডে কলাবাগান এলাকায় গাড়ির হালকা ভিড়। পাটভাঙা ফতুয়া পরা একজন বৃদ্ধ হেঁটে আসছিলেন। কিছুক্ষণ পর তাঁকে ফিরতে দেখি। হাতে ওষুধের ঠোঙা।

আমি তখন ফুটপাতে নেমে মুচি জহরলাল দাসের সঙ্গে কথা বলছি। এক জেরিক্যান পানি আর জুতা সারাইয়ের সরঞ্জাম দুপাশে নিয়ে বসে ছিলেন তিনি। তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। বললেন, সকাল ৮টা থেকে মাত্র ২০ টাকার কাজ করেছেন।

পাশেই মামা হালিমের গলিতে এজমালি ভাড়ার বাসায় থাকেন জহরলাল। তাঁর ভাগের ভাড়া ৬ হাজার টাকা। ছয়জনের পরিবারে এক ছেলে দোকানে চাকরি করেন, বেতন ৫ হাজার টাকা। কাজটা চালু আছে।

মিরপুর রোডের ধারে মুচি জহরলাল দাস। ছবি: লেখক
মিরপুর রোডের ধারে মুচি জহরলাল দাস। ছবি: লেখক

স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকার এ তল্লাটের ফুটপাতে বসছেন তিনি। কানে খুব কম শোনেন, হয়তো সারা জীবন রাস্তার আওয়াজের মধ্যে কাটানোর জন্যই।

সকালে জহরলাল রাতের বাসি ভাত খেয়ে এসেছেন। বাজার নিয়ে ফিরলে অন্যদের জন্য রান্না হবে। ভেবে ভেবে বলেন, ‘এই ডাইল-ভাত, আলুভর্তা, শাকসবজি--এগুলা আরকি।’ এ যাবৎ দুই জায়গা থেকে ১০ কেজির মতো চাল সাহায্য পেয়েছেন। প্যাকেটে সাবানও ছিল।

করোনাভাইরাস সম্পর্কে তাঁর রায়, ‘পেটের দায়ে তো আমরা রাস্তায় বইসা রইছি। যেই রোগ সৃষ্টি করছে, উপরওয়ালা ছাড়া তো কেউ করতে পারে না। উনিই রাখবে, উনিই মারবে। আমার তো কোনো উপায় নাই।’

লাজফার্মা থেকে ওষুধ কিনে ধানমন্ডি ৬ নম্বর সড়কের পাশে ময়ূরী দোকানে ঢুকি। বাজার নিয়ে বেরোতেই দুটি ছোট মেয়ে সামনে হাজির। তাদের পিছে দুই বৃদ্ধাসহ চার নারী। এখানে বরাবর ভিক্ষার্থীরা ছেঁকে ধরেন। তবে এখন এঁদের সুরে দাবির চেয়ে অনুনয় বেশি।

রিকশার দুপাশে এসে দাঁড়ান বিপণিবিতানের দুই দারোয়ান। বেতন তাঁদের অল্পই। ভর্তুকি আসে গাড়িওয়ালা ক্রেতাদের বকশিশ থেকে। এখন সেটা অনেক কমেছে।

পাড়ায় ঢুকি। চেনা মুদিদোকানে থামি আমার মেয়ের আব্দারের চিপ্‌স কিনতে। রিকশা থামিয়ে মান্নান সেটা এনে দেন। আগের দিন আরেকজন রিকশাচালকও সাগ্রহে আমার সদাই নিয়ে দিয়েছিলেন। পরে জেনেছিলাম, তিনি দুদিন মুড়ি খেয়ে আছেন।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের বেলায় সর্বজনে সমতা এনেছে। কিন্তু মানুষে মানুষে বৈষম্যকে একেবারে উলঙ্গ করে দিয়েছে। পরিষ্কার সাদা লুঙি আর গেঞ্জি পরা মান্নানের মুখে কালো-লাল কাপড়ের মুখঢাকা, মাথায় ক্যাপ। তাঁর কথায় শিক্ষার ছাপ, আত্মমর্যাদার বোধ। কামরাঙ্গীরচরে দুই বাচ্চা আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। সেখানকারই ভোটার।

তিনি বললেন, চাল কিনে রেখেছিলেন। ২৬ মার্চ লকডাউনের পর ঘর থেকে বেরোননি। চাল শেষ হয়েছে। দুদিন হলো আজানের পর সকালটায় রিকশা নিয়ে বেরোচ্ছেন। জমা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। নিজের টেকে শ তিনেক টাকা।

মান্নান বললেন, সাহায্য কোথাও পাননি। ভোটার কার্ড নিয়ে এলাকার কাউন্সিলরসহ ‘অনেকজনের কাছে’ গিয়েছিলেন। শুনে এসেছেন, সরকারি অনুদান আসেনি, দেরি হবে। থানায় গিয়ে নাম ওঠানোর পরামর্শও পেয়েছেন।

আমরা কথা বলতে বলতে তিন বৃদ্ধা এসে দাঁড়ালেন। একজন বললেন, ‘আমরা দুই-চাইর-পঞ্চাশজনে কার্ড জমা দিছি, ছবি দিছি। কিছু পাইন্যাইক্যা।’

পুরোনো মনিবের দেখা পাননি রূপভান বিবি। ছবি: লেখক
পুরোনো মনিবের দেখা পাননি রূপভান বিবি। ছবি: লেখক

মান্নানের মতে, সরকার যদি ‘অনুদান’ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয় তা হলে সবাই লকডাউন মেনে নিতে পারেন। তিনি বললেন, ‘তা ছাড়া তো আমরা রোডেও বেরোতে পারছি না। বের হইছি রিস্ক নিয়ে। কোথাও গিয়ে মার খাচ্ছি, কোথাও গিয়ে গাড়ি ভেঙে দিচ্ছে, উল্টে দিচ্ছে।’

সরকার এখন কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করে লকডাউনের সময় বাড়িয়েছে। চিকিৎসার হযবরল দশার মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকির পরিণতি ভাবতেও ভয় করে। করোনাবন্ধ সব দিক থেকেই এক নিরুপায়তার নাম।

দারিদ্র্য পরিস্থিতির যে জরিপের কথা গোড়ায় বলেছি, সেটা করা হয়েছে শহরের বস্তি আর গ্রামের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার খানার প্রতিনিধিদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে। জরিপ বলছে, গত ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চের শেষে-এপ্রিলের গোড়ায় এই মানুষদের মাথাপিছু আয় ৭০ শতাংশের বেশি কমেছিল। কাজ হারিয়েছিলেন অর্ধেকের মতো মানুষ, বস্তিতে আরও অনেক বেশি।

গবেষকেরা দরিদ্র মানুষের মোট সংখ্যা হিসাব করেছেন ৩ কোটি ৮১ লাখের বেশি। তাঁরা বলেছেন, এখনই এই মানুষদের এক মাসের খাওয়ার সংস্থান করতে হবে। তার জন্য টাকা লাগবে ৫ হাজার ৬০০ কোটি। তারপর ‘নতুন দরিদ্র’ মানুষদেরও দ্রুত এমন সহায়তা দিতে হবে।

ধানমন্ডিতে সেই সকালে আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন রূপভান বিবি। স্বামী নাই। বড় ছেলে খোঁজ নেয় না। ছোট ছেলে ‘রিকশাটিকশা চালাইত’, এক মাস ঘরে বসা। তাঁর শীর্ণ মুখে কোটরে বসা চোখের দৃষ্টি ক্ষোভে-দুঃখে তীব্র।

রূপভান বাসাবাড়িতে ছুটা কাজ করতে করতে বুড়ো হয়ে তিন বছর হলো অবসর নিয়েছেন। মাসখানেক আগে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে কাঁধে-পায়ে চোট পেয়েছিলেন। ডাক্তার দেখাতে পারেননি।

সেদিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জিগাতলা থেকে এই রাস্তায় এক পুরোনো মনিবের বাড়িতে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি। আমাকে বললেন, ‘হেই কালে একতলা বিল্ডিং আছিল। এহন ওই যে আটতলা বিল্ডিং বানাইছে। দারোয়ানে সান্ধাইতে দেয় না।’

বৃদ্ধা হাত দিয়ে দেখিয়ে বলেন, ‘যেহানে এত গুন খাই, এত কয়টা তো খাওয়া লাগে মা! আবার এই যে ঘরভাড়ার লাইগ্যা কত চিল্লাচিল্লি করতাছে।’ দুই জায়গা থেকে কিছু চাল-ডাল সাহায্য পেয়েছিলেন, ‘হে তো খাইয়া হালাইছি মা।’

অনেক নাগরিক সাধ্যমতো মানুষকে সাহায্য করছেন। তবে এই মানুষদের বাঁচিয়ে রাখার সুষ্ঠু একটা ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। শুনি সরকার বড় বড় সব প্যাকেজে অনেক সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু দেওয়ার চালুনির ফুটো কি বন্ধ করতে পেরেছে?

তথ্যপ্রযুক্তি আর মোবাইল ব্যাংক সেবার যুগে এই মানুষেরা অদৃশ্য বা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে নন। শুনি সহায়তা সরাসরি পৌঁছানো সম্ভব। এই সব ভাবছি। দেখি, রূপভান খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফেরার পথ ধরেছেন।

কুর্‌রাতুল-আইন-তাহ্‌মিনা:
[email protected]